খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।
চৈত্রের শেষ দুপুরেও রোদের তেজ একটুও কমেনি ৷ স্টেশনের সিমেন্টের বাঁধানো এক বেদীতে বসে কুলকুল ঘামি ৷ অপেক্ষায়, হাওড়াগামী ট্রেনের ৷ লেডিস কমরায় উঠব বলে এমন একটা জায়গায় এসে বসেছি যেখানে প্ল্যাটফর্মের মাথার উপর কোন আবরন নেই৷ আদ্ধেক ন্যাড়া এক গাছের ছায়া খুঁজে নিয়ে গাছের গোড়ার বাঁধানো বেদীতে বসি৷ পিঠ বেয়ে ঘামের ধারা নামে৷ রুমালের আকারের ছোট্ট তোয়ালে হাতব্যাগ থেকে বের করে মুখ গলা আর ঘাড়ের দিকটা মুছি৷ বৌদি কী হাওড়া যাবেন? প্রশ্ন শুনে মুখে তুলে তাকিয়ে দেখি হাঁটুর উপরে লুঙ্গি পরা খালি গায়ের এক লোক প্রশ্ন করেছে৷ লোকটিকে ভিখিরি ভেবে তার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাই৷ লোকটি বলে ওঠে, 'আমার মেয়েছেলেটাও হাওড়া চলে গেছে! ঘুমিয়ে ছিলাম আমি, পাশ থেকে কখন উঠে চলে গেছে টেরও পাইনি৷ মাগী বদমাইশ! বারোভাতারী, একটা ব্যাটাছেলেতে মন ভরবে তার? আমি কত খুঁজেছি মাগীকে, পাইনি৷ এখন গিয়ে আমি মদ খাব৷ দশটা টাকা আছে আমার কাছে, মদ খাব আর ঘুমাব!' ট্রেনের জন্যে অপেক্ষারত এক ভদ্রমহিলা পাশ থেকে বলে ওঠেন, 'ঐ করগে, তোমার আর কী হবে! ঠিক করেছে বৌ চলে গেছে!' লোকটি আর দাঁড়ায় না কে কী বলল শোনার জন্যে৷ এগিয়ে যায় প্ল্যাটফর্ম ধরে৷ চোখে পড়ে লোকটির সারা গায়ে দগদগে ক্ষত৷ যেন খাবলা খাবলা ছাল চামড়া ছাড়িয়ে নিয়েছে কেউ৷ ঐ ক্ষতের উপর বসে থাকা মাছিরাও যায় লোকটির সাথে সাথে, আগে পিছে ওড়ে তারা৷ গা শিরশির করে আমার, চোখ ফেরানোর চেষ্টা করি অন্যদিকে, রেললাইনের দিকে, ট্রেন কি আসছে!
শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছি আমি। অসুস্থ শ্বশুরমশাইকে দেখতে এসেছিলাম ৷ বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ তিনি, দুদিন আগে ফোন করে শাশুড়ি বলেন, তোমার বাবার শরীরটা বেশ খারাপ। শরীর প্রায়শই খারাপ থাকে তবু এভাবে তো বলেন না ওঁরা। জানতে চাই, আমি কী একবার বাড়িতে আসব মা? শাশুড়ি বলেন, আসবে? তা এসো! কবে যাব জেনে নিয়ে তিনি বলেন, এলে আর সেদিন ফিরে যাবে না, সেইমত ব্যবস্থা করে এসো ৷ সম্মতি জানাই ৷ রবিবারে নাকি ট্রেন এমনিতেই কম থাকে ৷ তায় প্রতিটি ট্রেনই দশ-পনের মিনিট করে লেট থাকে, প্ল্যাটফর্মে অস্থির পায়চারীরত সাদা চুড়িদার কামিজ পরা একটি মেয়ে নিজের মনেই বলে যায়৷ আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চায় লাষ্ট ট্রেন কখন গেছে৷ হেসে ফেলি আমি, লাষ্ট ট্রেন দেখতে পেলে তো আমি তাতেই চেপে বসতাম আর এতক্ষণে হাওড়ার কাছাকাছি চলেও যেতাম! এবারে মেয়েটিও হেসেই ফেলে৷
পাশে নামিয়ে রাখা ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হই এটাকে বয়ে সেই বাড়ি অব্দি নিয়ে যেতে হবে ভেবে ৷ দেখতে ছোট হলেও ব্যাগটি বেশ ভারী ৷ গাছের নারকোল, দু'রকমের আচারের শিশি, কাগজি লেবু কী নেই এতে! আর সেই বই দুটো ও তো আছে, সময় কাটানোর কথা ভেবে যে দুটো আমিই সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম অথচ একবারও খুলে দেখিনি! মন প্রসন্ন হয় ভোরবেলায় ছাদ থেকে কুড়িয়ে আনা আমের গুটিগুলো ও শাশুড়ি দিয়ে দিয়েছেন ভেবে! ক্ষুদ্র এক জিনিস, যার কোন মূল্যই নেই, আমি কুড়িয়ে না আনলে সেগুলো ছাদেই পড়ে থেকে শুকিয়ে যেত আর তারপর ঝরা পাতা ঝাট দেওয়ার সময় ওরাও চলে যেত শুকনো পাতাদের সাথে৷
ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই ছাদে চলে গিয়েছিলাম৷ ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখি, দাঁড়িয়ে থাকি রেলিং ধরে ৷ এই প্রথম শ্বশুরবাড়িতে একা রাত্রিবাস আমার৷ ও'র কথা ভাবি, গতকাল দুপুর থেকে আজ এই ভোর অব্দি এক মুহুর্তের জন্যেও সে মন থেকে সরেনি৷ রাতে আধো ঘুম আধো জাগরনের মাঝেও সে ছিল৷ কথা বলেছে, খুনসুটি করেছে, আদর করেছে৷ সে কী তবে স্বপ্ন ছিল!
খানিক পরেই শাশুড়িও উঠে আসেন ছাদে, হাতে অ্যালুমিনিয়ামের জাগ ভর্তি জল, টবে দেবেন ৷ শুকনো মরে যাওয়া গাছ সব, কয়েকটা ফণিমনসা শুধু বেঁচে আছে জল ছাড়াই৷ জলের জাগ শাশুড়ি মায়ের হাত থেকে নিয়ে একটু একটু করে সব কটা টবেই জল দেই৷ মা বলেন, হাঁটুতে ব্যাথা, কোমরে ব্যাথা, ছাদে উঠতে পারি না এখন আর, গাছগুলো সব শুকিয়ে গেল গো! এই ক্ষরায় কী গাছ বাঁচে জল ছাড়া! আমি শুনি, এই ছাদ নাকী ও'র খুব প্রিয়৷ অনেক আগে, যখন ও বাড়িতে থাকতো, বেশির ভাগ সময়ই এই ছাদে কাটাতো৷ মাদুর পেতে বই নিয়ে ছাদে চলে আসতো, ঘন্টার পর ঘন্টা ছাদেই থাকতো সে৷ তখন নাকি অনেক গাছ ছিলো ছাদে৷ দু'বেলা গাছেরা জল পেত, ইট আর সিমেন্টের এই ছাদে ছিল এক ছোট্ট বাগান৷ তবে সাজানো নয়৷ ইতস্তত: ছড়ানো ছিল সব টব৷ এখানে ওখানে৷ ঠিকই তো! যে বাগানে সে সময় কাটায়, যে যায়গা ও'র প্রিয়, সেই বাগান সাজানো হতেই পারে না!
(ডায়রিতে লিখে রাখা অনেকদিন আগের কিছু কথা। ।
সচলায়তনে প্রকাশিত। প্রথম পাতার জন্যে নয়। )
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।