উনিশ , তিন , দুই হাজার নয় । চৈত্রের ভর দুপুর । চারদিকে খাঁ খাঁ রোদ্দুর । প্রকৃতি নিস্তব্ধ , নিঝুম হয়ে আছে । চারদিকে যেন এক শূন্যতা , এক হাহাকার ।
কোন কাজ নেই । অলসের মত রুমে শুয়ে আছি । চোখের সামনে ভেসে উঠছে সোনালী , রুপোলী কত স্মৃতি । মনের জানালায় উঁকি দিয়ে যাচ্ছে ফেলে আসা স্বপ্নিল দিনগুলো । হাতছানি দিয়ে ডাকছে বারবার ।
মনে হচ্ছে পাখা লাগিয়ে উড়াল দিয়ে চলে যাই সেই স্মৃতির জগতে ।
আজ আমি সবুজে ঘেরা , পাখি ডাকা , সুষমামণ্ডিত প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী । দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে এল । এই তো সেদিন , খুব বেশি দূরে নয় , মায়াবী আবেশে ঘেরা , অতি আপন বলে পরিচিত ছোটবেলার স্মৃতিবিজরিত বাড়িটাকে ছেড়ে এলাম । আব্বু-আম্মুকে ছেড়ে , প্রিয় জেলা আর কত পরিচিত মুখ-সবকিছুকে ছেড়ে চলে এলাম এক অপরিচিত গণ্ডিতে ।
দুই বান্ধবী- আমি আর সীমা উঠলাম হোস্টেলে । পেলাম এক আপুকে । কিছুদিন পর আরেক বান্ধবী ইমা এসে যোগ দিল । ভালই কাটছিল দিনগুলো । তিনজন একসাথে ক্যাম্পাসে আসতাম আর যেতাম ।
জোসনারাতে নিয়নবাতির আলোগুলো হঠাৎ নিভে গেলে জানালার ধারে আমরা বসে থাকতাম । দেখতাম জোসনা-ধোয়া ব্যস্ত শহরকে । মাঝে মাঝে ছাদে গিয়ে জোসনা-মাখা , তারা-ভরা রূপ দেখে তন্ময় হয়ে যেতাম । ছকে বাঁধা ধারায় চলতে সেই পরিবেশ ও ছেড়ে আসতে হল । চলে এলাম অপরূপ প্রকৃতির মায়াবী আবেশে জড়ানো আমাদের ক্যাম্পাসের হলে ।
এখনো যেখানেই আছি । প্রকৃতির মায়াবী আবেশ আমাকে আরো উদাস করে দেয় । মাঝে মাঝে কিছুই ভাল লাগে না । মনটা আমার উড়ে চলে যায় কোন এক গহীন স্মৃতির খোঁজে ।
* * * * * * * *
মনের গহীনে হাতড়ে হাতড়ে অনেক স্মৃতিই পেয়ে যাই ।
ডুবে যাই স্মৃতির রাজ্যের অতলে , গহীনে । ছেড়ে এসেছি আমার অতি প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইছামতির কোল ঘেঁষা পাবনা কামিল মাদরাসাকে । যেখানে আমার জ্ঞানার্জনের প্রথম হাতে খড়ি , ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত সেই পাবনা আলিয়া । স্যাররা আমাকে খুবই আদর করতেন । বড় আপুরা , বান্ধবীরা , আমার ছোটরা সবাই আমাকে ভালবাসত ।
ছয় বছর বয়সে পাবনা আলিয়ায় ঢুকে সতেরো বছর বয়সে বের হয়ে এসেছি । সেই মধুমাখা দিনগুলো , পাবনা আলিয়ার কলকাকলি , লতা-পাতা সবই মনের গহীনে গাঁথা রয়ে গেছে । বারে বারে মন-পাখিটা উদাস হয়ে গেয়ে উঠে :
"আলিয়ার ঐ দিনগুলি
মিষটি মধুর দিনগুলি
সোনালী সেই দিনগুলি
হায়- অনেক দূরে । "
* * * * * * * * *
মনে পড়ে - খুব বেশি মনে পড়ে ছোটবেলাটা । আমার ছোটবেলা ,কৈশোর বেলা সব কেটেছে পাবনা শহরে -নানুবাড়িতে ।
আর আমার দাদুবাড়িটা পাবনার সুজানগরে পদ্মার কোল ঘেষা নিশ্চিন্তপুরে । সবাই আমাকে ভালবাসত । নানাভাই , নানু , মামা- মামী আরো কত সবার আদর , ভালবাসা । মামাতো ভাই-বোনদের সাথে খেলতাম । খাল থেকে কচুরিপানা তুলে আনতাম ।
আমাদের বাড়িতে অনেক ফুলগাছ ছিল । এখনো আছে । একটা গাছ ছিল-মাধবীলতা । ফুল তুলে এনে মালা গাঁথতাম । মাথায় পরতাম, গলায় দিতাম ।
আকাশ-বাতাস , পাখিদের উড়া-উড়ি , ফুল-বাগান , ঘাসফড়িঙ- এসবই ছিল আমার আপন ।
যখন দাদুবাড়িতে যেতাম তখন আমি থাকতাম আম-বাগানে , সরিষা-ক্ষেতে , ধান-ক্ষেতে । আমার সঙ্গী থাকত চাচাতো বোন দিবা । আমার এক বছরের ছোট । দু'জনে ঘুরে বেড়াতাম আর ফুল তুলে আনতাম ।
আকন্দ , কলাবতী আরো কত ফুল । ধানের ক্ষেতে ঘুরে বেড়াতাম । দু’পাশ দিয়ে কচি শীষগুলোয় বাতাস দোলা দিয়ে যেত । বাড়ি থেকে দু’মাইল দূরেই পদ্মা নদী । কখনো বা চলে যেতাম নদীর কাঞ্চন-পাড়ে ।
নৌকায় করে ঘুরে বেড়াতাম ।
* * * * * * * *
শিশু কালকে বিদায় দিয়ে যখন কৈশোরে এলাম তখন বই , পত্রিকা আর আঁকা-আঁকি ছাড়া আর কিছুই বুঝতাম না । মাদরাসার ক্লাস শেষে বাড়িতে এসে বসতাম বই নিয়ে । সময় পেলেই দিতাম রঙ-তুলির আঁচড় । বইয়ের পাতার ভাঁজে রেখে দিতাম নিজের হাতে গড়া বাগানের গোলাপের পাঁপড়ি , বেলি-আরো কত ফুল ।
যখন ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামত তখন আমার টেবিলের পাশের জানালাটা খুলে বসে থাকতাম আকাশের দিকে চেয়ে । বৃষ্টি-ধোয়া রূপটার দিকে চেয়ে থাকতাম । আবার কখনো তার পরশও মেখে নিতাম ।
এখনো যখন বৃষ্টি নামে , যখন মনটা বইয়ের আশে-পাশে আর বাগানের আশে-পাশে ঘুরঘুর করে তখন কল্পনার পাখা লাগিয়ে চলে যায় আমার সেই ফুল-বাগানে আর রঙ-তুলির আঁচড়ে ভরে ওঠা স্মৃতি-বিজড়িত সেই ঘরে । বলতে ইচ্ছে করে খুউউব :
'আবার যেতে ইচ্ছে করে
স্মৃতিমাখা সেই গাঁয় ,
যার পরশ লেগে আছে
আমার দু'খান পায় ।
'
(১৯.০৩.'০৯ইং; ডায়েরীর পাতা থেকে নেওয়া )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।