আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেজন্মা বেসামরিক আমজনতাই সব সময়ে জিতে যায়



ব্লাডি সিভিলিয়ান। অর্থাৎ, বেজন্মা বেসামরিক আমজনতা। এই বেজন্মা বেসামরিক আমজনতাই সব সময়ে জিতে যায়। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও তাই দেখা গেল। ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে আমাদের দেশপ্রেমিক (!) সেনা সদস্যরা তাদের ছাউনি গুটিয়ে ব্যারাকে ফিরে গেছেন।

অন্যভাবে বলা যায় পাততাড়ি গুটিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে আমি নিজে উপস্থিত থেকে দেখেছি, জলপাই রঙের পোশাক পরা জোয়ানরা জলপাই রঙের গাড়িতে চেপে চলে যাচ্ছেন। এমন দৃশ্য সিনেমাতেও অনেক দেখেছি। মিত্র বাহিনীর কাছে পরাজিত হিটলারের নাজি সেনারা একরাশ গ্লানি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে দেশে। সেনাদের বিদায়ের দৃশ্যে তাদেরই নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের কয়েকজনকে হাততালি দিয়ে উল্লাস করতেও দেখেছি।

যা সন্দেহাতীতভাবেই সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের পুলিশ বাহিনীর বিরাগ ও বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ। ব্লাডি সিভিলিয়ান, শব্দটির অবতারণা করলাম এই কারণে যে, বিশ্বের সব দেশেই উর্দি পরা সেনা সদস্যরা সাধারণ মানুষকে বিশেষ এই শব্দযুগলের আশ্রয় নিয়ে গালি দিয়ে থাকে। ব্লাডি সিভিলিয়ান শব্দটি সম্পর্কে অভিধানে বলা আছে, অশিষ্ট বেসামরিক আমজনতা। অশিষ্ট-এর যথাশব্দ তালাশ করতে গেলে পাওয়া যায় অনার্য, ম্লেচ্ছ, অভদ্র, অসভ্য, অভব্য, ইতর ইত্যাকার শব্দগুলো। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমজনতা মনে করে ব্লাডি শব্দের যথার্থ সমার্থক বাংলা শব্দ বেজন্মা।

বলাবাহুল্য, ব্লাডি সিভিলিয়ান গালিটি দিয়ে তাবৎ বিশ্বের সেনারা দারুণ পুলকবোধ করে থাকেন। সন্দেহ নেই, আমাদের খাকি পোশাক পরা জোয়ানরাও একই রকম পুলকে পুলকিত হয়ে থাকেন। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলোÑ ব্যতিক্রম কিছু না ঘটলে নিশ্চিত করে বলা যায়, সেনাদের মা-বাবাও আমাদেরই মতোই অনার্য কিংবা বেজন্মা বেসামরিক গোত্রেরই সদস্য। অসভ্য সাধারণ হিসেবে ব্লাডি সিভিলিয়ান গালিটি বেশ কয়েকবার শোনার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। এর মধ্যে দুটি ঘটনা বেশ মনে পড়ে।

মনে পড়লে আমিও বেশ পুলক বোধ করি। ১৯৮৩ সালে মফস্বল শহরের একটি ঘটনা। শহরের রাস্তা দিয়ে সেনাবাহিনী, মানে স্বৈরাচার এরশাদের বাহিনীর একটি গাড়ি যাচ্ছিল। ওঁৎ পেতে থাকা প্রতিবাদীদের কেউ একজন ঢিল মেরে বসল গাড়িটি লক্ষ করে। ঢিল খেয়েই চাকায় ঘর্ষণজনিত গর্জন তুলে গাড়িটি থেমে গেল।

ততোধিক তর্জন-গর্জন করতে করতে জলপাই রঙের উর্দিপরা সেনা সদস্যরা গাড়ি থেকে নেমে এলো। তাদের বুটের ডগায় পিলে চমকানো ধুপধাপ শব্দ। যাকে সামনে পেল তারই পশ্চাদ্দেশ বরাবর দু’তিনটে করে লাথি কষে দিল। গানের সঙ্গে যেমন তবলা চলে, তেমনি লাথির সঙ্গে অনুষঙ্গ হিসেবে তাদের মুখ দিয়ে বের হয়েছিল ব্লাডি সিভিলিয়ান শব্দটি। সেদিনের সেই লাথির ভর-বেগ সেনাদের জন্য যতটা আনন্দদায়ক ছিল, ঠিক ততটা পীড়াদায়ক ছিল যে লোকটি লাথি হজম করেছেন।

আর ব্লাডি সিভিলিয়ান গালিটি তাদের কাছে ছিল নিঃসন্দেহে শ্রুতিমধুর বিষয়। কিন্তু যার জন্য গালিটি বরাদ্দ হয়েছিল তার কাছে এ নেহায়েতই বেদনাবিদুর বিষয়। সে যাকগে, আট বছর পর এই অসভ্য আমজনতাই সুসভ্য সেনা সমর্থিত স্বৈরাচারকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করেছিল। শেষবার ২০০৫ সালের কোনও এক সময়ের ঘটনা। আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারে এলো টেলিটক।

তখন পর্যন্ত লোভনীয় ও সাশ্রয়ী টেলিটকের সিমকার্ড কেনার জন্য লোকজনের মাঝে রীতিমত প্রতিযোগিতা। কারণ ততদিনে গ্রামীণফোন, সিটিসেল আর একটেলের ট্যারিফ সন্ত্রাসে গ্রাহকদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কোনওক্রমে টেলিটকের একটি সিম পেলেই যেন রেহাই পায়। নির্ধারিত ব্যাংকে পূরণ করা ফরম জমা দিয়ে টেলিটকের সিমকার্ড তুলতে হবে। সিম নেয়ার জন্য ব্যাংকগুলোতে বিশাল লাইন পড়ে গেল।

ভিড় এড়ানোর জন্য আমরা কয়েক সাংবাদিক বন্ধু চলে গেলাম গুলশানে। ধারণা ছিল ব্যাংকের গুলশান ব্রাঞ্চে ভিড় কম হবে। কিন্তু তা আর হয়নি। গিয়ে দেখি আগে থেকেই শখানেক লোক সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে। লাইনধারীদের অবস্থা এমন ছিল, যে কোনও মূল্যে সিম পেতেই হবে।

সেজন্য ফাঁকতালে মাঝখান থেকে কেউ যাতে লাইনে ঢুকে পড়তে না পারে সেদিকে সবার ছিল সতর্ক দৃষ্টি। এই সতর্কতার মাঝেই জুনিয়র এক সেনাকর্মকর্তা লাইনে না দাঁড়িয়েই সিম তোলার জন্য ব্যাংকে ঢোকার তৎপরতা শুরু করলেন। সাধারণের প্রতিরোধের মুখে এক পর্যায়ে ভদ্রলোক তার অপতৎপরতা বন্ধ করে বিরস বদনে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এলেন। গুরুগম্ভীর স্বরে জানালেন, তিনি সিম নয়, টাকা তোলার জন্য ব্যাংকে ঢুকবেন।

তার স্থূল চাতুর্যতায় কাজ হয়নি। আমজনতার প্রতিরোধ এবং ধুয়োধ্বনি শুনতে শুনতে তিনি অবস্থান ত্যাগ করেন। তার আগে অভ্যেস মাফিক বলে গেলেন, ব্লাডি সিভিলিয়ান। কিন্তু লাইনে দাড়িয়ে থেকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সুসভ্য সেনাসদস্যটি নাকাল হয়েই রণেভঙ্গ দিয়ে ফিরে গেলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠটি তৈরি হয়েছে ছাত্রদের খেলাধুলার জন্য।

সেখানে সেনা ছাউনি অবশ্য দৃষ্টিকটু বিষয়। তার ওপর মাঠ দখল করে যদি সেনারা বাম-ডান, ডাইনে ঘোর-বায়ে ঘোর জাতীয় কর্মকা- করে বেড়ান সেটাও নিশ্চয় দৃষ্টিনন্দন নয়। ঘটনা সম্পর্কেও আমরা যতদূর জেনেছি, নিতান্তই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাসদস্যরা ছাত্রদের মারধর করেছে। তাদের রোষ এবং তোপের তীব্রতা অত্যধিক হওয়ায় নিরীহ ছাত্রদের হজম করতে হয়েছে কিল-ঘুষি ও লাথি। আর নাজেহাল ও অপদস্থ হতে হয়েছে শিক্ষকদের।

কিন্তু আমাদের তরুণ সেনাসদস্যরা হয়তো জানেন না, বা জানলেও বিস্মৃত হয়েছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জায়গাটি তাদের জন্য ভীষণ অপয়া। এই অপয়া জায়গাতেই তাদেরকে ১৯৪৮ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত দফায় দফায় নাকাল ও পর্যুদস্ত হতে হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে সেনাবাহিনীর জন্য বিষয়টি যে আবারও গ্লানিকর এবং সম্মান হানিকর হবে তা এখন নাইবা বললাম। বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন ইতিহাস থেকেই সবাইকে শিক্ষা নিতে হয়। কিন্তু তাবৎ বিশ্বের সেনাগোত্রের কাছে এ যেন নিতান্তই কথার কথা।

বোধকরি তারা ইতিহাস শিক্ষাকে নেহায়েতই অশিক্ষা মনে করে থাকেন। নইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি দুঃখজনক অধ্যায়ের সূচনা হতো না। সূচনা বললাম এই কারণে যে, ঘটনা আরও অনেক দূর গড়াবে। মাঝে ঘটে যাবে বহু ঘটনা। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও কিছু ঘটনা ঘটেছে।

প্রথম আলো পত্রিকায় পড়েছি ১৫ আগস্ট কুমিল্লায় আলমগীর হোসেন নামের তেত্রিশ বছর বয়েসী এক রাজমিস্ত্রিকে সেনা সদস্যরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। আবুল কালাম নামে তার এক প্রতিবেশীকে বেদম ধলাই-মলাই করা হয়েছে। থেতলানো হাত-পা নিয়ে লোকটি কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছেন। ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, বৃষ্টির উৎপাত থেকে নিস্তার পাবার জন্য ইতরগোত্রীয় (!) আলমগীর সুসভ্য এক সেনা কর্মকর্তার আত্মীয়ার ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছিল। এর অপরাধে নিজ বাড়ি আলেখার চর থেকে সেনাসদস্যরা আলমগীরকে পাকড়াও করে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর তার প্রতিবেশী কালামকেও নিয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের দু’জনের ওপরই অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। সেই নির্যাতনে আলমগীর মারা গেছেন। অথচ আলমগীরের মৃত্যু সম্পর্কে কুমিল্লায় যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ছিনতাই করতে গিয়ে আলমগীর গণপিটুনিতে আহত হন। তারপর মারা যান।

সত্যি, বিস্ময়কর বিবৃতি, কিংবা বলা যায় বিকৃতি! আলমগীর সম্পর্কে হলফ করে বলা যায়, মৃত্যুর আগে তাকেও অসংখ্যবার ব্লাডি সিভিলিয়ান গালিটি শুনতে হয়েছিল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.