- নিজেকেই নিজে চিনি না, পরকে চেনার মিছে বাহানা -
জন্ম আর লালনভূমিতে বসবাসের আগ্রহ ও অধিকার মানুষের সহজাত। লালনভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশ মানুষের জীবনযাত্রার অনুকূল। বিভিন্ন ভৌগলিক সীমারেখা মানুষকে নির্ধারিত আলো-বাতাসে, খাদ্য পানীয়ে যেমন অভ্যস্ত করে তোল, তেমনি রুচিবোধ এবং লোকাচারেও করে তোলে সুসংহত। এ ব্যাপারে ধর্মীয় অনুশাসন বা কর্মজীবনের নিয়মনিষ্ঠা কোনো বাধার সৃষ্টি করে না। ভৌগলিক পরিচয় মানুষের ধর্মরক্ষার বা কর্ম করার পথে আদৌ অন্তরায় নয়।
নিজ নিজ আবাসভূমিতে বিভিন্ন ধর্মালম্বী মানুষ চিরকাল ধর্মনিরপেক্ষ সহবস্থানে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। কেননা কোনো ধর্মই তার ভৌগলিক সত্তাকে অস্বীকার করেনি। আমি মুসলমান- তার অর্থ, আমাকে বাধ্যগতভাবে কোনো "মুসলমানিস্তানের" বাসিন্দা হতে হবে না। আমি হিন্দু- তার অর্থ, আমাকে বসবাসের জন্যে একটি "হিন্দুস্তান" গড়ে তুলতে হবে না। তেমনি বৌদ্ধ ধর্মালম্বীর বসবাসের জন্যে "বৌদ্ধস্তান" প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা নেই।
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা) তাঁর জন্ম ও লালন ভূমির পরিচয়ে "আরবীয়"- তার ভাষা 'আরবী'। কিন্তু তিনি তো সমগ্র মুসলিম জাহানেরই নবী- তাঁর মাধ্যমে আরবী ভাষায় নাজেলকৃত পবিত্র কোরান সকল দেশের সকল ভাষাভাষী মুসলমানদেরই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। পবিত্র কোরানে ধর্মনিরপেক্ষ সহ-অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে সূরা আল-কাফিরুনে। অমুসলিমদের উদ্দেশ্যে মুসলমানদের বক্তব্য হিসেবে সূরাটি অবতীর্ণ হয়। যেমন-
পরম করুণাময় আল্লাহর নামে-
আমরা তাঁর উপাসনা করি না, যাঁর উপাসনা
তোমরা করে থাকো।
তোমরাও তাঁর উপাসনা করো না, যাঁর উপাসনা
আমরা করে থাকি।
আমরা তাঁর উপাসনা করবো না, যাঁর উপাসনা
তোমরা করে থাকো।
তোমরাও তাঁর উপাসনা করবে না, যাঁর উপাসনা
আমরা করে থাকি।
তোমাদের জন্যে তোমাদের ধর্ম,
আমাদের জন্যে আমাদের ধর্ম। ।
সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। এটি সে সময়ের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মালম্বী মক্কাবাসী বা আরববাসীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ সহঅবস্থানের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করছে। এতে অমুসলিম বাসিন্দাদের আরবভূমি থেকে উতখাত করার কথা বলা হয়নি।
অথচ আমাদের যুগে পাকিস্তান বলে কথিত একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ কোনো আদর্শের অনুসারী হয়েছে, তা বুঝি নে। একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার আনুকূল্যে এখন থেকে তেইশ বছর আগে সেই দেশটি দুস্তর ভৌগলিক ব্যবধানের পূর্ববঙ্গ এলাকাকেও বেধে নিয়েছিলো রাষ্ট্রীয় বন্ধনে।
কিন্তু তখন থেকেই প্রতিমুহূর্তে পূর্ববঙ্গ তথা আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধরা তাদের ভৌগলিক পরিচয় বাঙালি চেতনাকে রেখেছে অটুট। এখানে নির্বিবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা যেমন নিজেদের ধর্মকর্ম করছে, তেমনি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরাও। অতিসম্প্রতি পরিকল্পিতভাবে এই অবস্থার বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করেছে পাকিস্তানি হানাদার শক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশের পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকবলিত এলাকাগুলোতে তারা ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাবার জন্যে উস্কানি দিচ্ছে এবং এমনকি কোনো কোনো এলাকা থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদ করে উর্দুভাষী ও অন্য লোকাচারে অভ্যস্ত বিদেশী লোকদের দিয়ে বসত গড়ে তুলবার চেষ্টা করছে।
পাকিস্তানি নাতসি শক্তির অনুরূপ কার্যকলাপের মধ্যে যে-উদ্দেশ্যই নিহিত থাকুক, তারা একটি ভৌগলিক পরিবেশকে নিশ্চয় পারবে না পাল্টে দিতে।
নিশ্চয় তারা পারবে না ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জাতীয় সত্তাকে লোপ পাইয়ে দিতে। বাংলার মুক্তিবাহিনীর দুর্বার প্রতিরোধের মুখে তাদেরকে এ দেশ ছেড়ে চলে যেতেই হবে।
_______________________________
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে ০৮-০৫-১৯৭১ এবং ১০-০৫-১৯৭১ এ প্রচারিত। রচনা বেলাল মোহাম্মদ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।