আদিতে মানুষ যাযাবর ছিলো। সুদূর অতীতে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে যাদের যাত্রা শুরু, তারাই কালের গতিপথে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলো। আমাদের কোন পূর্বপুরুষ বা প্রপিতামহী প্রথম খাদ্যবস্তু হিসেবে ধাণ্য চিনতে পেরেছিলেন এবং তার তুষ থেকে শস্যকে পৃথক করে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তা আমাদের জানা নেই। প্রকৃতপক্ষে মানুষের নিত্য ব্যবহার্য খ্দ্যা, বস্ত্র, বাসস্থান প্রভৃতির আবিষ্কারক যারা তারা বিস্মৃতির অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছেন। কিন্তু তাদের আবিষ্কারের উত্তরাধিকারি আমরা, সমগ্র মানুব জাতি তথা মানবজাতির প্রভৃতি সভ্য ও সভ্যা।
সর্বজনীন এই উত্তরাধিকার এবং প্রতিটি মানুষের মধ্যে মানুষোচিত সমস্ত ক্ষমতার বিচ্ছুরণ, এই প্রক্রিয়াকে মূলত বিশ্বায়ন। ৩ এভাবেই বিশ্বায়নকে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু বিশ্বায়নের ধারণা আর সে জায়গায় নেই। বিশ্বয়ান হয়ে গেছে আজ পুঁজির বিশ্বায়ন। মানবজাতির প্রতিটি সভ্য/সভ্যার স্বার্থে এ বিশ্বায়ন কাজ করে না।
গোল দুনিয়া থেকে গোলকায়নের ধারণা নেয়া হলেও এ দুনিয়া হয়ে গেছে এখন পুঁজির দুনিয়া। পুঁজির দখলদারিত্বে এ রকমই যে ঘটবে তা অবশ্য কার্ল মার্কস অনেক আগেই বলে গেছেন। সম্রাট যেমন যুদ্ধে অন্য রাজাকে হারিয়ে সাম্রাজ্য বাড়াতেন এখানেও এ প্রক্রিয়াটি সেই একই কাজ কওে। গোলকায়ন শুনতে আরাম বোধ হয় বিধায় সাম্রাজ্যবাদ শব্দটি ঢাকা পড়ে গেছে। এ প্রক্রিয়ায় আমাদের মতো দেশের ক্ষতি হবে কি হবে না অনেক অনেকদিন মাথায় আনা হয়নি।
আমরা কেবল দেশ দশের জন্য উন্নয়ন করে গেছি। মাথায় না আনার এ কাজটুকু আমাদেও ডানপন্থী-বামপন্থী সকল মহলে সমান অবদান রেখেছেন। কিন্তু গোলকায়ন ইতোমধ্যে নিজেকে প্রকাশ করেছে প্রকান্ড এক গর্জিলা রূপে। নিজের ব্যাক্তিত্বের সাথে যোগ হয়েছে পুঁজি। ফলে গোলকায়ন হয়ে বাজারের গোলকায়ন।
এ বাজার শুধু ধনীদের, উত্তরের, বহুজাতিকের। অন্যদিকে বাজার বলতে একটি প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়, যার মাধ্যমে দ্রব্য সেবা-উপকরণ ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ সম্পাদিত হয়। আর অবাধ বাজার বলতে সময়ে হস্তক্ষেপহীন বাজারকে বোঝায়, যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা পরিপূর্ণ স্বাধীণতা নিয়ে স্বীয় ইচ্ছামাফিক বেচা-কেনা করতে পারে। এখানে প্রবেশ ও প্রস্থানের অধিকার সার্বজনীন। এখানে কতটুকু উৎপাদন হবে, কি উৎপাদন হবে, কিভাবে উৎপাদন হবে এসব সিদ্ধান্ত বাজারের শক্তি আপেক্ষিক প্রতিযোগিতামূলকভাবেই নির্ধারণ করা হয়।
৪
হাট, বাজার, গঞ্জ এ তিনটি জিনিস ঐতিহাসিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় কার্যকর ক্রিয়ানক হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু হালে সেগুলোর অবস্থা কী, তা পরিস্কার থাকা ভালো, তাহলে বিষয়টি বুঝতে সহায়তা করবে। কাছারিহাট, ওটারহাট ও মৃধ্যারহাট এ তিনটি নোয়াখালী সদরের তিনটি বিখ্যাত হাট। কাছারিহাটে সোম ও বৃহস্পতিবার অন্য দুুটিতে শনি ও মঙ্গলবাওে হাট বসতো। আলু চাষী আলূ নিয়ে আসতেন, চাল উৎপাদক চাল, তাঁতি নিয়ে আসতেন শাড়ি।
হাটে আলু চাষী আলু বেচে শাড়ি কিনতেন কিংবা চাল উৎপাদক চাল বেচে আলু কিনতেন। এভাবে চলছিলো আমাদের বাজার ব্যবস্থা। পুরো ব্যবস্থাপনায় ছিলো মূলত ‘বিনিময়’ এর ছাঁপ এবং ভারসাম্যতা। পণ্য উৎপাদক থেকে সরাসরি ক্রেতার হাতে চলে যেতো। কিন্তু সময়ের বিচাওে এখন আর হাট তিনটি বসে না।
তার বদলে পশ্চিমে জমেছে সোনাপুর ও পূর্বে জমেছে বসুরহাট। ক্রেতারা এখন সোনাপুর-বসুরহাট দৌড়ান। এখানে বিক্রেতা গিয়ে বসে থাকেন, ক্রেতারাও আসেন কিন্তু আগের সেই বিনিময় হয় না। যে মাছ বিক্রেতা মাছ বেচে শাড়ি কিনবেন তিনি আর তাঁতির কাছে যান না। চলে যান আলো ঝলমলে বিপনী বিতানে, সেখান থেকে তিনি কিনে নেন মিহি সুতার কাপড়।
এত করে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্য। দেশি উৎপাদকরা হারিয়ে যাচ্ছে। পুরো ব্যবস্থা জুড়ে তৈরি হয়েছে অন্যায্যতা।
মুক্তবাণিজ্যেও এ ঝলকানি আর্জেন্টিনার একই অবস্থা তৈরি করেছিলো। মুক্তদ্বার অর্থনীতি এক হিসেবে আর্জেন্টিনার চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছিলো।
বড় বড় শহরগুলো ভরে উঠেছিলো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং চেইন শপে। সীমিত সংখ্যক ক্রেতাবাহিনী গড়ে উঠেছিলো যারা নতুন ধরণের বিদেশী ভোগ্যপণ্যেও চাহিদা সৃষ্টি করল ব্যাপক হারে। বুয়েনস আয়ারস শহরটি ছেঁয়ে গেল মার্কিন কায়দায় ‘শপিংমল’ এ। অবশ্য একই সাথে বন্ধ হতে লাগল ছোট দোকানগুলি; বিশেষ কওে পুরোনো দেশি কারখানাগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনবসতির আশপাশের দোকান বাজারগুলি ক্রমশ বন্ধ হতে লাগলো। কারখানা বন্ধ, এসব দোকান বাজারে তাই কোন ক্রেতা নেই।
৭
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।