আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার অসুখী চেহারা, মূল: হাইনরিখ ব্যোল, জার্মান থেকে অনুবাদ: তীরন্দাজ

সময়, কবিতা, ছোটগল্প, দেশ, দেশাচার

(গত ক'দিন ধরে সমাজতন্ত্র নিয়ে তুমুল আলোচনা চলেছে ব্লগে। তাতে এই গল্পটি অনুবাদ করতে অনুপ্রানিত হলাম। বলাবাহুল্য, এটা অনুবাদ মাত্র, অনুবাদকের নিজস্ব কোন মতামত নয়। তবে মনে হয় পড়ে আনন্দ পাওয়া যাবে) বন্দরে দাঁড়িয়ে গাংচিলের ঝাঁকের দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার মনখারাপ চেহারা এলাকায় টহলরত এক পুলিশের চোখে পড়ল।

বাতাসে পাখীদের উপর নীচ, হঠাৎ খাবারের আশায় জলের উপর নিশ্ফল ঝাঁপ, এসব দৃশ্যের মাঝেই ডুবে ছিলাম পুরোপুরি। পুরোনো ধ্বংসস্তুপের মতো বন্দরের চেহারা, পানির রং ঘন সবুজ, উপরে ময়লা তেলের পুরু স্তর, তার উপর ভাসছে ইতস্তত: জঞ্জাল। কোন জাহাজ নেই। মরচে ধরা ক্রেন, গুদামঘরগুলো ভেঙ্গে পড়েছে প্রায়। এমনকি কালো নোংরা জেটিতে ইঁদুরের বসতিও নেই, এতটাই নি:স্তব্ধ সব।

গত চার বছর ধরে বাইরের পৃথিবীর সাথে সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমি একটি নির্দিষ্ট গাংচিলের দিকে তাকিয়ে তার ওড়ার গতিপথে নজর করছিলাম। গাংচিলটিকে মনে হচ্ছিল একটা ভয় পাওয়া চড়ুইএর মতো, যেন এইমাত্র খারাপ আবহাওয়ার আভাস পেয়েছে। সারাক্ষন পানির সামান্য উপরেই উড়ছিল, মাঝে মাঝে সাহসী চিৎকারে করে একটু উপরের দিকে ঝাঁপ, যাতে সঙ্গীদের সাথে ওড়াপথ ঠিক রাখা যায়। যদি ইচ্ছেপূরণের কোন সুযোগ থাকতো, একটি রুটি হতো সবচেয়ে বড় ইচ্ছে।

টুকরো টুকরো ভেঙ্গে গাংচিলদের খাওয়াতাম, ওদের বিশৃঙ্খল ওড়ায় একটা শৃঙ্খলা আনতে পারতাম। একটা দিক স্থির করে ছুড়তাম, যেদিকে ওরা সবাই উড়তো। একটি রুটির টুকরো ছুড়েই একটি রেখা তৈরী করতাম, সুতোর মতো টানা টানা রেখা। কিন্তু আমিও ওদের মতোই ক্ষুধার্ত, ক্লান্তও বটে, তারপরও আমার বিষাদের মাঝেই সুখী। কারন পকেটে হাত রেখে ওখানে দাড়িয়ে থাকা, গাংচিলের দিকে নজর রাখা, নিজের বিষাদ আকন্ঠ পান করতে ভালই লাগছিল।

হঠাৎ কাঁধে কঠিন হাতের চাপ টের পেলাম ও একজন বলল, - আসুন আমার সাথে! কথার সাথে সাথে সে হাত হিঁচড়ে টানার চেষ্টা করলো আমাকে। আমি শক্ত হয়ে দাড়িয়ে ঝাঁকি মেরে সরিয়ে দিলাম সে হাত ও শান্তস্বরে বললাম, - আপনার মাথা খারাপ! তার চেহারা এখনো দেখা হয়নি আমার। বলল, - কমরেড! আপনাকে সাবধান করছি! - জনাব! উত্তর দিলাম আমি। - এখানে কোন জনাব নেই। আমরা সবাই কমরেড।

রেগে জোর গলায় জানালো সে। এবার আমার পাশাপাশি আসলো সে। পাশ থেকেই আমাকে পরখ করলো। আমিও আমার সমুদ্রের দিকের সুখী দৃষ্টিকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হলাম যাতে তার চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারি। তাকে একটা ষাড়ের মতো মনে হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল গত একশো বছরে কর্তব্যপালন বাদে আর কিছুই পেটে জোটেনি তার।

- কি কারণে ... ? আমিই শুরু করলাম। - আপনার বেজার চেহারাই কারণ হিসেবে যথেষ্ট। আমি হাসলাম। - হাসবেন না। তার রাগে কোন ভেজাল ছিল না।

প্রথম ভেবেছিলাম, একঘেয়েমির জন্যই এসব করছে সে। কোন লাইসেন্সবিহীন বেশ্যা নেই, মাতাল নাবিকও নেই, গ্রেপ্তার করার মতো কোন চোর-ডাকাতও নেই। একঘেয়ে লাগারই কথা। এখন বুঝলাম, আমাকেই গ্রেপ্তার করাই তার উদ্দেশ্য। - আমার সাথে আসুন! - কারনটি জানতে পারি কি? শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলাম।

কিন্তু উত্তরের বদলে টের পাবার আগেই আমার বা্থহাতে একটি সরু শিকল পরানো হলো। সেই মূহুর্তেই বুঝলাম, আবার ডুবছি আমি। শেষবারের মতো মুখ ঘুরিয়ে গাংচিলের ওঠানামা ও ধুসর আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ঘুরে পানিতে ঝাপিয়ে পড়ার কথা চিন্তা করলাম। মনে হলো, এই পুলিশ সার্জেন্টের হাতে কোন বাড়ীর পেছনে ফাঁসিতে ঝোলা, বা আবার বন্দী হওয়ার চেয়ে এই কালো নোংরা পানিতে একা একা ডুবে মরা অনেক ভাল। কিন্তু এই পুলিশ সার্জেন্ট এক হ্যাঁচকা টানে এত কাছে টেনে নিল যে, নড়ার কোন উপায় রইল না।

- কিন্তু কি কারনে? জিজ্ঞেস করলাম আবার। - আইনে বলা হয়েছে, আপনাকে আনন্দে থাকতে হবে। - আমি তে আনন্দেই আছি্থ। চিৎকার করে বললাম আমি। - কিন্তু আপনার বেজার চেহারা তার প্রমাণ রাখেনা ... ।

অবিশ্বাসে মাথা নাড়লো সে। - কিন্তু এই আইনটি আমার জন্যে নতুন। বললাম আমি। - এটা ছত্রিশ ঘন্টার পুরোনো আইন। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে, কোন আইন জানানোর চব্বিশ ঘন্টা পরই তা বলবৎ হয়ে যায়।

- কিন্তু আমি এই আইন জানিনা । - কিন্তু তাতে শাস্তি থেকে রেহাই পাবার কোন পথ খোলা নেই। গতপরশু সব মাইকে, পত্রিকায়, জানানো হয়েছে। যাদের রেডিও শোনা ও পত্রিকাতে পড়ার সৌভাগ্য নেই, তাদের ওখানে ও দেশের প্রতিটি রাস্তাতেই হ্যন্ডবিল ছড়ানো হয়েছে। আপনি গত ছত্রিশ ঘন্টা কোথায় কাটিয়েছেন, তা জানা যাবে এবার কমরেড।

বলেই আমার দিকে তিরস্কারের দৃষ্টিতে তাকালো সে। আমাকে টেনে নিয়ে চললো পুলিশ। এতক্ষনে টের পেলাম যে, শীত লাগছে ভীষন আর ওভারকোটও গায়ে নেই। ক্ষিদেও চেগে উঠলো, মনে হলো পেটের দরজায় গোত্তা দিচ্ছে সে ক্ষুধা। নজর করলাম আমার দাড়ি গোঁফ না কামানো জীর্ন, অপরিস্কার চেহারা।

অথচ আইনে রয়েছে, প্রত্যেককেই দাড়ি কামিয়ে পরিস্কার, সুখী চেহারায় থাকতে হবে। সে আমাকে একটি কাকতাড়ুয়ার মতো ঠেলে নিয়ে চললো, মনে হলো যেন চুরির আসামীকে তার সপ্নের রাজ্য থেকে বহিস্কার করা হচ্ছে। রাস্তাঘাট একেবারেই খালি, থানা খুব দুরে নয়। জানি, ওরা আমাকে আবারও আটকে রাখার কারণ খুঁজে বের করবে। বুক ভারী হয়ে আসছিল আমার, কারন যে এলাকা দিয়ে সে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিল, তাতে আমার ছেলেবেলার স্মৃতি জড়ানো।

বন্দর দেখা শেষ করে ওখানেই যাবার পরিকল্পনা ছিল। আগে যে বাগান ও গাছ ছিল ফলের ভারে ন্যুজ্য, সৃষ্টি বন্যতার কারণেই সুন্দর, এখন তার সবই পরিকল্পনামাফিক সাজানো ও পরিস্কার। রাস্তাঘাট পিতৃভুমির ক্যডেটদের জন্যে চারকোনা করে সাজানো, যাতে ওরা সোমবার, বুধবার ও শনিবার মার্চ করতে পারে। শুধুমাত্র আকাশটি আগের মতো ও আগেরই সেই বাতাস, যখন সপ্নে ভরপুর ছিল বুক। এদিক ওদিক দিয়ে যাবার সময় দেখতে পেলাম, পতিতালয়গুলোও যাতে সাস্থ্যরক্ষাবিধিতে অবদান রাখতে পারে, সেকারণে সরকারীভাবে বাইরে তাদের নামই ঝেলানো হয়েছে, যারা বুধবার ওখানে যাবার অধিকার রাখে।

কিছু কিছু পানশালা সরকারী অনুমোদন সাপেক্ষে তাদের মদের বিজ্ঞাপণ বাইরে ঝুলিয়ে রেখেছে, একটি এনামেলের বিয়ার গ্লাস, যাতে আড়াআড়িভাবে দেশের জাতীয় রং একে দেয়া। আজ বুধবার কিছু লোক মহানন্দে। তার নাম ঝুলছে তালিকায়, সুতরাং বিয়ার টানতে পারবে ইচ্ছেমতো। পথে যাদের সামনে পড়লাম, তাদের প্রতিজনের চেহারাতেই উচ্চাকাঙ্খার স্পষ্ট প্রকাশ। কর্মতৎপরতা একটি উজ্জল আলোর স্তর যেন ঘিরে আছে তাদেরকে।

পুলিশের সামনে পড়ে সে স্তর যেন আরো বেশী উজ্ঝল। আরো বেশী দ্রুত পদক্ষেপ তাদের, আরো বেশী কর্তব্যপরায়নতার ছাপ তাদের চেহারায়। আর যেসব মেয়েরা গুদামঘর থেকে বেরিয়ে আসছে, তারাও তাদের চেহারায় সেই আনন্দের প্রকাশেই সচেষ্ট, যা তাদের কাছে দাবী করা হয়েছে। আনন্দ প্রকাশ করতে বলা হয়েছে সবাইকে। সারাদিনের কাজ শেষে যখন মজুরেরা বাড়ী ফেরে, তখন তাদেরকে হাসিমুখে সন্ধ্যার খাবারে আপ্যায়ন করা গৃহবধুদের কর্তব্যের মাঝে পড়ে।

কিন্তু সাবধানে সবাই আমাদেরকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছে সবাই, যাতে কাউকেই সরাসরি আমাদের মুখোমুখি হতে না হয়। রাস্তার যেখানেই জীবনের চিহ্ন, আমরা কাছাকাছি হলেই কুড়ি কদম সরে যাচ্ছে তা। প্রত্যেকেরই চেষ্টা, কোন গুদামঘরে ঢুকে পড়ার বা কোন মোড়ে বাঁক নিয়ে ঢোকার। কেউ কেউ কোন অপরিচিত বাড়ীতে ঢুকে শংকিত মনে আমাদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। শুধুমাত্র একবার এক চৌরাস্তার মোড়ে এক বৃদ্ধের মুখেমুখি পড়ে গেলাম।

তার টোকেনটি হঠাৎ চোখে পড়ায় বুঝলাম ওনি এক স্কুলশিক্ষক। আমাদেরকে এড়াতে সক্ষম হলেন না ও পুলিশকে আইনমাফিক সম্ভাষন জানাতে সচেষ্ট হলেন। (সম্ভাষন হিসেবে তাঁর নিজের আনুগত্যের যথাযোগ্য প্রকাশের চেষ্টায় তিনবার নিজের কপালে চাপড় দিলেন)। তারপর তিনি তিনবার আমার মুখে থুতু দিয়ে ও বাধ্যতামূলকভাবে আমাকে 'বিশ্বাসঘাতক শুয়োর' ডেকে তার উপর অর্পিত কর্তব্য পূরণ করলেন। থুতু ঠিক জায়গায় পড়লেও, হয়তো গরম বেশী পড়ার গলা শুকনো ছিল তার।

সামান্যই লাগল আমার মুখে। আমি নিজের অজান্তেই সার্টের হাতায় তা মোছার চেষ্টা করলাম, যা আইনসঙ্গত নয়। পুলিশের লাথি পড়ল পশ্চাতদেশে ও মেরুদন্ডের মাঝামাঝি তিনবার মুষ্ঠাঘাত। 'এক নম্বর', শান্তস্বরে জানালো পুলিশ। অর্থ দাঁড়ালো, এক নম্বর স্তরের সবচেয়ে নরম ধরণের পুলিশীয় শাস্তি।

স্কুল শিক্ষক সরে গেলেন দ্রুত। উনি ছাড়া সবাই আমাদেরকে এড়িয়ে যেতে পারলো। শুধুমাত্র এক মেয়েলোক বাদে। সে পতিতালয় থেকে বেরিয়ে এসে আইনের ধারা অনুযায়ী খোলা বাতাসে দাঁড়িয়েছিল। একটু ফ্যকাশে ও একটু ফোলা চেহারার স্বর্ণাকেশী।

আমাকে চুমোর ইশারা দেখালো, আমিও প্রত্যুত্তরে হাসলাম। পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করলো। এ সব মেয়েদের পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেয়ার নির্দেশ তাদেরকে দেয়া হয়েছে। এ স্বাধীনতা অন্য কোন কমরেডের বেলায় হলে অবশ্যই কঠিন শাস্তির কারণ হতে পারতো। এই মেয়েদের কাজ হচ্ছে, সাধারণের মাঝে কর্মস্পৃহা জাগিয়ে তোলা ও সেকারণেই তাদেরকে আইনের বাইরে রাখা হয়।

একে সরকারী দার্শনিক ড: ড: ড: ব্লাইগ্রোথ সবার পড়ার জন্যে বাধ্যতামূলক পত্রিকাতে রক্ষনশীলতা থেকে সরে আসার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। রাজধানীতে আসার আগের দিন রেলষ্টেশনের এক পায়খানায় বসে পত্রিকার কয়েকটি পাতা পড়েছিলাম। হয়তো কোন ছাত্র, যে কোন চাষীর ছেলে ওখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল। এই সময়েই সাইরেন বেজে উঠলো। এই সাইরেনের সামান্য পরেই সমস্ত রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়।

প্রত্যেক চেহারায় থাকে হালকা আনন্দের ছাপ। কাজের শেষে বেশী আনন্দ না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাতে প্রমানিত হতে পারে, কাজ এক বোঝা মাত্র। বরং উল্লাস কাজের শুরুতে দেখানো কর্তব্য, সবচেয়ে ভাল হয় আনন্দ ও গানের মাধ্যমে। কাজ বেরিয়ে এসে মুখেমুখি হলে প্রত্যেকেকই আমার মুখে খুতু দিতে হতো।

তবে এখন যে সাইরেন বাজলো, তা কাজ শেষে বেরিয়ে আসার দশ মিনিট আগে। এখন সবাইকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হতে হবে। বর্তমান সরকারের চালু স্লোগান, 'সুখ ও সাবান'। পুলিশ ষ্টেশনটি ইট-শুড়কির কদাকার এক দালান। ফটকে দাড়ানো দুজন পাহারাদার।

তারাও আমাকে প্রথানুযায়ী প্রয়োজনীয় ্তুশারিরীক শিক্ষা্থ দিলো। তাদের দুপাশে ঝোলানো অস্ত্রে আমার কপালে ও পিস্তলের নল দিয়ে পায়ে জোরে আঘাত করলো। এটা ছিল এক নম্বর আইনের প্রয়োগ। "প্রতিটি পুলিশকে প্রতিটি ধৃত ব্যাক্তির উপর বল প্রয়োগের প্রমাণ রাখতে হবে, ব্যাতিক্রম শুধুমাত্র যে পুলিশ ধরেছেন, তিনিই। কারণ আসামীকে জেরাকালীন সময়ে 'শারিরীক শিক্ষা' প্রদানের এক মহান অংশীদারও তিনি নিজে"।

একনম্বর আইন আইনের বইয়ে এভাবে বর্ণনা করা আছে। "প্রতিটি পুলিশ আসামীকে শাস্তি দিতে পারেন, তিনি তাদেরকে শাস্তি দিতে বাধ্য, যারা কোন না কোন ভাবে অপরাধী। সব কমরেডের জন্যেই শাস্তি ক্ষমাযোগ্য নয়, শুধুমাত্র রয়েছে ক্ষমাযোগ্য করার সম্ভাবনা"। একটি লম্বা ঠান্ডা করিডোর পার হলাম আমরা, দু'পাশেই বড় বড় জানালা। নিজ থেকেই একটি দরজা খুলে গেল, কারণ ফটকের পাহারাদারেরা আমাদের আসার খবর আগেই জানিয়ে দিয়েছিল।

এমনি এক সুখী, শান্ত ও গোছানো দিনে - তাদের জন্যে বরাদ্ধকৃত এক পাউন্ড সাবানও পুরো খরচ করে সবাই যখন পরিস্কার, তেমনি এক দিনে এক কয়েদীর আগমন মনে রাখার মতো ঘটনা বৈকি। একটি খালি প্রায় কামরায় ঢুকলাম আমরা। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল, তার উপর একটি টেলিফোন ও দু্থপাশে দু্থটো চেয়ার। আমাকে ঘরের মাঝখানে দাঁড়াতে বলা হলো। পুলিশটি মাথা থেকে হেলমেটটি খুলে একটি চেয়ারে বসলো।

প্রথমে সবাই চুপচাপ ও কিছুই ঘটলো না। তারা এটা এভাবেই করে ও সবচেয়ে বেশী কষ্টকর। আমার মাথা ঝুলে পড়ছিল বারবার। প্রচন্ড ক্ষুধার্ত এ ক্লান্ত আমি, শোকের আনন্দও মিলিয়ে গেলো, কারণ টের পেলাম যে এবার ডুবেছি আমি। কয়েক সেকেন্ড পর এক পাংশু চেহারা লম্বা এক লোক প্রাথমিক জেরাকারীর নীল পোষাক পড়ে ঘরে ঢুকলো।

কোন কথা না বলে চেয়ারে বসে আমার দিকে তাকালো। - পেশা? - সাধারণ কমরেড। - জন্মতারিখ:? - ১.১.১। বললাম আমি। - সর্বশেষ পেশা? - জেলবন্দী।

একজন আরেকজনের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলো ওরা। - কবে ও কোথায় ছাড়া হয়েছে? - গতকাল, জেল ১২ ও কামরা ১৩। - কোনদিকে ছাড়া হয়েছে? - রাজধানীতে। - জেলমুক্তির সনদ! আমি আমার পকেট থেকে কাগজটি বের করে ওদের দিকে এগিয়ে দিলাম। সে সেটি সবুজ কার্ডটিতে আটকে দিল, যা আমার বর্ণনা থেকে সে পুরণ করা শুরু করেছে।

- সে সময়ের অপরাধ? - আমার সুখী চেহারা। - বুঝিয়ে বলুন। বললো প্রাথমিক জেরাকারী। - সুখী চেহারা নিয়ে এক পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলাম। সেদিন বসের মৃত্যুদিবসে সাধারণ শোকদিবস ঘোষনা করা হয়েছিল।

- কতদিন সাজা ভোগ করেছেন? - পাঁচ। - জেলের রিপোর্ট? - খারাপ। - কারন? - কাজে অলস। - শেষ। প্রাথমিক জেরাকারী উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো ও এক আঘাতে আমার সামনের তিনটি দাঁত খুলে ফেললো।

এতে দ্বিতীয়বার অপরাধ করার কারণে চিহ্নিত করা হলো আমাকে। আচমকা বেশ চরম পদক্ষেপ, যার জন্যে কোন মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিল না। তারপর প্রাথমিক জেরাকারী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই জেরাকারী হিসেবে ঘন বাদামী পোষাকে মোটা এক লোক ঢুকলো ঘরে। তারা সবাই আমাকে পিটিয়ে গেল। জেরাকারী, উপরের জেরাকারী, প্রধান জেরাকারী, বিচারক ও প্রধান বিচারক।

এবং পাশাপাশি পুলিশও আইন অনুযায়ী 'শারিরীক শিক্ষা' প্রদান করলো। আর অসুখী চেহারা শাস্তি হিসেবে দশ বছরের জেল হলো আমার, যেখানে সুখী চেহারার কারণে পাঁচ বছর জেল খাটতে হয়েছে। এখন আমাকে চেষ্টা করতে হবে, যাতে আমার আর কোন চেহারাই না থাকে। সেটা সম্ভব হবে তখনই, যদি সামনের দশটি বছর 'সুখ ও সাবান' এর শ্লোগানে ভালভাবে পার করতে পারি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।