সুন্দরী বালিকাদের যত্ন করে কামড়াই
সব স্কুলেই বোধহয় প্রতি ক্লাসে এক বা একাধিক ক্লাস ক্যাপ্টেন থাকে। ক্যাপ্টেন শব্দটার আরো ঘষামাজা করা রূপও ব্যবহৃত হয়, ক্লাস মনিটর, ক্লাস প্রিফেক্ট, কিন্তু যার নাম চালভাজা তারই নাম মুড়ি। আমার বুদ্ধিতে যতটুকু কুলিয়েছে, ক্লাস ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব হচ্ছে ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব করা, শিক্ষকের অবর্তমানে ক্লাসে যারা বাঁদরামো করে তাদের পরিচয় কালোতালিকা ওরফে ব্ল্যাকবোর্ডে সোনার অভাবে চকের অক্ষরে অঙ্কণ, টিফিনের সময় ছাত্রসংখ্যা হিসাব করে নিজের ও কতিপয় লঘুসাংখ্যিক বন্ধুর কথা স্মরণ করে অতিরিক্ত টিফিন ইসু্য করা, কোন এক্সকারশনে গেলে গলাবাজি ও পোদ্দারি করা, এবং আরো অনুরূপ আইনের চোখে সাদা কুকর্ম সম্পাদন।
সাধারণত ক্লাসে ফার্স্ট বয়কে ক্যাপ্টেন হিসাবে মনোনীত করেন ক্লাস টীচার। সে যদি মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ভেতো হয়, অথবা ভীতু হয়, কিংবা পঞ্চাশের কাছাকাছি ছাত্র সামলানোর মতো বুকের পাটা ও মোজোসম্পন্ন না হয়, অথবা দুর্দান্ত সাহসী ও দুর্মুখ হয়ে এই দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে সাধারণত তার পরিবর্তে মস্তান কিসিমের টীচারের অনুগত কোন ছাত্রই ঐ পদ অলঙ্কৃত করে।
ক্লাস ক্যাপ্টেনের সাথে খারাপ সম্পর্ক থাকা খুব দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। সাধারণত এরা প্রতিশোধপরায়ণ ও টেকসই স্মৃতিসম্পন্ন হয়। বছরের গোড়ার দিকে তার সাথে মনোমালিন্য বাধানোর মতো কোন পাপ ঘটে গেলে বছরের শেষে গিয়ে হলেও তার জের টানতে হয়। সহৃদয় কোন স্যার বা চপলা কোন ম্যাডামের ক্লাসের আগে যতখুশি লাফাও, মারপিট করো, কাগজের গোল্লা বানিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলো, ফ্লাস্কের পানি উপুড় করে দাও প্রতিপক্ষের প্যান্টে, ক্যাপ্টেন ব্যাটা কিছুই বলবে না, মৃদু মৃদু হাসবে শুধু। কিন্তু সেই লক্ষীমন্ত টীচারের ক্লাস ফুরিয়ে গেলে, পরের ক্লাসে যখন কোন যমদূতসদৃশ লোমশ পালোয়ান বেতোয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডুর ক্লাস পড়বে, যখন সবাই মূর্তির মতো স্থির ও সুশীল, তখনই সে একটা চক হাতে নিয়ে পটাপট কিছু নাম লিখে ফেলবে বোর্ডে।
সাধারণত সেই নামের মালিকানা বর্তায় তুলনামূলকভাবে নিরীহ ও সাময়িক মস্তানির জোশে আত্মহারা সুশীলদের ঘাড়ে (একেবারেই দাগী পান্ডা যারা, তারা ক্লাসের ভেতরে সাধারণত শান্তই থাকে, শিশুতোষ দুষ্টুমিতে তাদের আগ্রহ কম, তারা মেয়েদের স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আনমনে কুঁচকি চুলকায় কিংবা সঙ্কটের মূহুর্তে কাটা শটগান আনা নেওয়া করে)। চেঁচিয়ে যে এর প্রতিবাদ জানানো হবে, তার জো-টি পর্যন্ত নেই। কারণ ঐ তো দেখা যাচ্ছে, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডু তার ঘর ছেড়ে বেরোলেন, পেছনে দপ্তরীর হাতে কয়েকটি নির্বাচিত বেত, সেগুলি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ঈর্ষণীয় রকমের স্বাস্থ্যবতী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তখন বড়সড় কোন দুঃখজনক ঘটনা নিয়ে ভাবতে হয়, যাতে মারটা কম অনুভূত হয়। একই সাথে প্রচুর চেঁচাতে হয়, যাতে হেডু স্যার বোঝেন যে মারটা ঠিকমতোই প্রযুক্ত হচ্ছে, নইলে বেতের বাড়ির পেছনে ওয়াটেজ বেড়ে যাবে।
ছুটির পরও যে ক্যাপ্টেনকে ধরে প্যাঁদানোর সুযোগ মিলবে, সে আশাও কম। কারণ তার পরদিনও সে ক্যাপ্টেন থাকবে। হেডুও স্কুল ছেড়ে চটজলদি কোথাও যাচ্ছেন না। তাছাড়া স্কুল ছুটির পর সাধারণত সবাই মিলে চুরি করে জিমনেশিয়ামে টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলে, ক্যাপ্টেন সে পাপের বেশ বড়সড় সহঅংশীদার। অথবা ভলিবল কোর্টে ভলিবল খেলার জালটা তার ব্যাগ থেকেই বের হয়, কিংবা ক্রিকেটের স্টাম্পগুলি তার সাইকেলে রাখা আছে।
আহত পিঠের কথা ঠিক মনে থাকে না তখন।
তবে একই পোলা বার বার ক্যাপ্টেন হয়ে কিছু চিহ্নিত ছেলেকে শ্রেণী-সংগ্রাম, মানে ক্লাসের ভেতরে মার না খাওয়ার জন্য যে সংগ্রাম, তার দিকে ঠেলে দেবে, তার গাণিতিক সম্ভাবনাও কম। তাছাড়া ক্যাপ্টেনসির জন্যে লালায়িত হয়ে ওঠে অনেকেই। নিরঙ্কুশ পান্ডামোর সুযোগ পেলে কে ছাড়ে? অনেক সময় কোন দুনর্ীতিবাজ ক্যাপ্টেন কূটনৈতিক অদক্ষতার কারণে মাঝক্লাসেই খারিজ হয়ে যায়, সবাই মিলে কোন বলিয়েকইয়ে ছোকরাকে স্পোক্সম্যান বানিয়ে ক্লাসটীচারের দিকে ঠেলে দেয়, সে আবেগকম্পিত স্বরে এক দারুণ প্রাণবন্ত ভাষণ দেয় (ওরকম থিয়েটারি বীর দুয়েকজন ক্লাসে থাকলে ক্যাপ্টেনকেও সাবধানে সামনে চলতে হয়, যাতে সুশীল বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী তার বিপক্ষে চলে না যায়), এবং ক্লাসের ছেলেদের সরব সমর্থনে ক্যাপ্টেন বেচারা তার জলপাইপাতার মুকূটটি খুইয়ে বসে, সেটি নির্ভরযোগ্য কারো কাছে হস্তান্তর করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐ বিকল্প ছোকরাটি গদিচূ্যত ক্যাপ্টেনের হাতে মজলুম জনতার একজন নিকলায়, এবং সে-ও স্কুলে এসে শুধু বই পড়ে আর টাস্ক কষেই সময় কাটায় না, দেখে আর ঠেকে অনেক কিছু শেখে।
তখন একদা-ক্যাপ্টেনকেও পিঠে ছালা বাঁধতে হয়।
এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে ওঠার সময় এই চক্র চলতেই থাকে, কারণ ক্যাপ্টেনসির তরবারি ঘনঘন হাতছাড়া হয়, জাতীয় ক্রিকেট দলের মতো, কিন্তু সব ক্যাপ্টেনই তার একদমউপরোক্ত কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান, তাই অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডু স্যার ক্লাসে এসে কখনোই খালি বেত নিয়ে ফিরে যান না, টিফিনও প্রত্যেকদিন কয়েকটা ওভার-ইনভয়েসিং হয়। ক্ষতিগ্রস্থ সংক্ষুব্ধদের সংখ্যা যদি বেড়ে যায়, এবং তাদের মধ্যে তীর্যকগ্রীব দুয়েকজন থাকলেই সমস্যা। ভালো ক্যাপ্টেন পর পর কয়েক বছর ক্লাস শাসন করতে পারে, যদি সে মার খাওয়ানোর চেয়ে দুষ্টুমিতে বেশি উৎসাহী হয়, আর তার অতিরিক্ত টিফিনের বখরাদারের তালিকায় ঘুরে ফিরে মোটামুটি সবাই না হলেও সেই থিয়েটারী বীর আর বুদ্ধিজীবীরা আসে। এই হচ্ছে পলিটিক্স।
বড় কঠিন জিনিস। এর জের টানা কষ্টকর। বেশিদিন একটানা কেউ ক্যাপ্টেন পদে থাকলে কিছুটা স্থিতিজড়তা তাকে পেয়ে বসে, তখন ক্লাসে নির্যাতিতদের দল ভারি হতে থাকে।
আমি যখন হাই স্কুলে উঠি তখন এরশাদকে মোটে কান ধরে নামানো হয়েছে, দেশে তখন একেবারে আনকোরা সংসদীয় গণতন্ত্র। আমার কাছে এরশাদকে ভালো লাগতো না, ঘোড়ার মতো মনে হতো, খারাপও লাগতো না, কারণ এরশাদ আমাকে কিছু করেনি।
এরশাদকে প্রথম অপছন্দ করি যখন সে একবার আমার স্কুলের পাশ দিয়ে জীপ ছুটিয়ে গিয়েছিলো, আর তাকে অভ্যর্থনা জানাতে নেহায়েত শিশু আমাকে রোদের মধ্যে পাঁচ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো। আমি দুবলা গোছের ছিলাম, পা টনটন শুরু করার পর অস্থির হয়ে বলেছিলাম, আসে না ক্যানো? এ কথা শুনতে পেয়ে আমার তৎকালীন হেডমাস্টার আমাকে কান ধরে টেনে লাইন থেকে বার করে কঠোর হাতে থাপ্পড় মেরেছিলেন। তখন আমার গালির জ্ঞানের পারদ ছিলো কুত্তা ও শুয়োর পর্যন্ত, কিন্তু এখন আমি অনেক গালি জানি, পত্রিকায় বা টিভিতে যখন দেখি দেশের বড়সড় কেউ কোন রাস্তা দিয়ে যাবে, আর তার দুইপাশে ছোট ছোট বাচ্চাদের দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে, আমি চিৎকার করে বলি, মাদারচোদ। কিংবা ... অমুক, তোর মায়রে চুদি। এ আমার শিক্ষার দোষ, নাকি ক্ষমতাশালীদের, আমি ঠিক নিশ্চিত নই।
যা-ই হোক, হাই স্কুলের ক্যাপ্টেনরা বেশির ভাগই আমার বন্ধু ছিলো, তাদেরকে পথেঘাটে দেখলে আমি জড়িয়ে ধরি, আমরা এককালে একে অন্যের যে পিঠে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডুকে দিয়ে বেতের বাড়ি খাইয়েছিলাম, সেটা চাপড়াতে থাকি। আমি খুব সৌভাগ্যবান, আমার সেই বন্ধুরা এক একজন চমৎকার মানুষ। কিন্তু গণতন্ত্রের সবল সুঠাম শরীরেও যে অন্ডকোষ আছে, সেই বিচিতে লাথি মেরে যে গণতন্ত্রকে কাবু করে ফেলা যায়, সেটা সেই হাই স্কুলেই আমরা টের পেয়েছিলাম। গণতন্ত্র সেই নিপীড়নের সুযোগ করে দেয়, যে নিপীড়ন ক্যাপ্টেনের গদিকে তিষ্ঠাতে দেয় না। ফলাফল, বিষচক্র।
পত্রিকায় পড়লাম, অনেক হোমরাচোমরা রাঘববোয়াল কর্মকর্তা-মন্ত্রী-ব্যবসায়ীরা দেশ ছাড়ছেন। পূর্বমুখী নীতির জোরালো সমর্থক বলেই হয়তো তাঁরা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে ঘাঁটি গাড়ছেন। হঠাৎ তাঁদের এই প্রবল প্রবাসপ্রেমের কারণ হতে পারে একটাই, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তাঁদের হাত থেকে সেই যাদুদন্ড, সেই জলপাইপাতার মুকুট, সেই ক্লাসক্যাপ্টেনের ব্যাজ হস্তান্তরিত হবে। আমীর আব্দুল্লাহ নিয়াজি 71 সালে কোমর থেকে পিস্তলসহ বেল্ট খুলে ফেলার পর একটা জামা পড়া জানোয়ার হয়ে গিয়েছিলো, জেনেভা কনভেনশনের মহাগ্রন্থ দেখিয়ে তাকে পদে পদে হয়তো কাঁদতে হতো, আমি একজন পিওডাবি্লউ, আই ডিজার্ভ প্রোটেকশন অ্যান্ড রেসপেক্ট। নিয়াজির মতো নামজাদা খানকির বাচ্চা রেসপেক্ট না হলেও প্রোটেকশন পেয়েছিলো, আমাদের হিজরৎপন্থীরা কি সেটাও পাওয়ার আশা করেন না? পিঠে ছালা বেঁধে আমাদের ক্যাপ্টেনরা দু'চার ঘা সহ্য করে নিতো, এনাদের সেই সাহস বা ভরসাও বোধহয় নেই।
কীসের বশে এঁরা ক্ষণিকের প্রবাসী হচ্ছেন, আমরা বুঝি। আবারও পরিস্থিতি অনুকূলে এলে আমাদের এই প্রবাসমুখী ক্যাপ্টেনরা আবার ফিরে এসে জেঁকে বসবেন।
একটা যুগ কি তাহলে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি? আমরা স্কুলজীবনের ক্যাপ্টেন বন্ধুরা একসাথে হলে গলাগলি করি, পুরানো দিনের কথা মনে করে হাসি, কাঁদি। গণতন্ত্রের ক্যাপ্টেনরা ক্লাস ছেড়ে পালিয়ে যান। এঁদের হাতে একটা টিফিনের সিঙ্গারাও তো নিরাপদ না, আমরা দেশ তুলে দিয়ে হায় আফসোস করি।
এত কিছুর পরও বাংলাদেশ আমার নিজের দেশ। দিনের শেষে, সব ঢেউ স্তিমিত হয়ে আসলে তার চেহারা চোখে ভাসে। খুব ভয় হয়, আতঙ্ক হয়, দুঃখ হয়, কাঁদতে ইচ্ছা করে, টুঁটি চেপে ধরতে ইচ্ছা করে এক একটা শুয়োরের বাচ্চার। কিন্তু আমার মধ্যবিত্ত হাত আস্তিনের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে আর কোথাও বেরোয় না। বড়জোর চোখের পানিটুকু মোছে।
বাংলাদেশকে ভালোবেসে আর কতো কাঁদতে হবে আমাকে, আমাদের?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।