বল্টু মিয়া, বয়স ৩১। বাড়ি মানিকগঞ্ঝে। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে তানজিনিয়ার দার উস সালাম সিমানায় সিমান্ত পুলিশের হাতে আটক হন তিনি। তিনিসহ ২০ বাংলাদেশি তানজিনিয়ার কুখ্যাত জেল উকনগাতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আটক ছিলেন।
বল্টু মিয়া ২০১১ দেশ ত্যাগ করেছিলেন এক বুক স্বপ্ন নিয়ে।
দালালের সাথে কথা ছিল, তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে চালকের চাকরি দেওয়া হবে। স্বচ্ছল ভবিষ্যতের আশায় জমি বিক্রয় ও সুদে আনা ১০ লক্ষ টাকা তুলে দেন দালালের হাতে। যথারীতি বিদেশ গমণ..। মিয়া এবং তার সহযোগীরা উগান্ডার কামপালা, কেনিয়ার হয়ে তানজিনিয়ার দার উস সালামে পৌছে যান বিনা বাধায়। এর পরই বাঁধে গোল।
বল্টু মিয়া এবং তার ২০ সহযোগী আটক হন তানজিনিয়ান পুলিশের হাতে।
অবৈধ অনু্প্রবেশের অপরাধে কারাগারে প্রেরণ করা হয় তাদের। চলে তাদের উপর নিমম অত্যাচার।
অত্যাচারের ভয়াবহতা তুলে ধরে বল্টু মিয়া বলেন, তাদের একজনকে ৩ বর্গফুটের একখন্ড জায়গায় তাকে রাত কাটাতে হত। অল্প পরিমাণ খাবার তাদের কে দেওয়া হত।
জেলের টয়লেটের অবস্থা আরো শোচনীয়। টয়লেটে ভেসে বেড়াত মল-মূত্র। এছাড়া সিগারেট খোঁজার নামে চলত প্রহরীদের নির্মম নির্যাতন।
প্রহরীরা তাদেরকে প্রহার করার সময় ভিক্ষুক, তোরা নষ্ট ভিক্ষুক বলে গালি দিত। দালালরা আগেই পাসপোট ও টাকা নিয়ে সরে পড়লেও বেঁচে ছিলেন মিয়া এবং তার সঙ্গীরা।
কিন্তু পুলিশের প্রহার আর অনাহারে মারা যায় বল্টুর এক সঙ্গী।
বল্টু বলেন, ‘আমাদের পাসপোর্ট দালালরা নিয়ে নিয়েছিলো, তাদের কাছ থেকে যে টাকা নেওয়া হয়েছিলো তারও কোন ধরণের রশিদ দেয়নি দালালরা। তাদেরকে এই জেলে সারা জীবন কাটাতে হবে বলে তাদেরকে হুমকি দিত তানজিনিয়ার জেলের প্রহরীরা। ’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের এক সঙ্গী ক্ষুধার জ্বালায় ও রোগে ভুগে মারা গেলে, ভেবোছলাম এখানে হয়ত আমাকেও মরতে হবে। ’
১ বছর জেল জীবন কাটানোর পর বল্টু মিয়া এবং তার সহযোগীদেরকে ব্যুরো অব ম্যান পাওয়ার, ইমপ্লয়মেন্ট এন্ড ট্রেনিং এর সহযোগিতায় দেশে ফিরিয়ে আনে এমজিএইচ কোম্পানি।
বাংলাদেশ সরকারের ব্যুরো অব ম্যান পাওয়ার, ইমপ্লয়মেন্ট এন্ড ট্রেনিং, ২০১২ সালের আগস্ট মাসে মিয়া এবং তার সহযোগীদের বিদেশ যাত্রা এবং তাদের তানজিনিয়ায় আটকের বিষয়টি জানতে পারে। মিয়া এবং অন্যরা অবৈধ উপায়ে বিদেশ পাড়ি দেয়ায় ব্যুরো তাদের জন্য কিছুই করতে পারেনি ব্যুরোর কর্মকর্তারা।
ব্যুরো মিয়া এবং তানজিনিয়ায় আটক অন্য বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনার জন্য এমজিএইচ গ্রুপকে নিয়োগ করে। এমজিএইচ(বাংলাদেশের সর্ববৃহত্তম ব্যাংকিং, উপদেষ্টা, জাহাজীকরণ, খাদ্য, বেভারেজ কোম্পানি) ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মিয়াদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
বল্টু মিয়া এবং ২০ বাংলাদেশিকে তানজিনিয়ার জেল থেকে ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে এমজিএইচ কোম্পানির পরিচালক আনিছ আহমেদ বলেন, ‘প্রবাসী শ্রমিকরা আমাদের অর্থনীতির নেপথ্যের নায়ক, আমরা তাদের জন্য কিছু করে সমাজকে কিছু দিতে চাই।
আমরা তাদের কে দেশে ফিরিয়ে এনে ২০টি পরিবারের আলো ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। ’
এমজিএইচ কোম্পানি এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্য প্রাচ্যের জেলে থাকা বাংলাদেশিদের বিএমইটির সহায়তায় দেশে ফিরিয়ে আনে। ২০০৯ সালে এই কোম্পানিটি পাকিস্তানের জেলে বিনা বিচারে আটক ৭ বাংরাদেশিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছিল। আনিছ আহমেদের মতে, এই কোম্পানিটি ওলেবানা ও কাজাকিস্তানে আটক বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
বিএমইটির মতে, ২০১২ সালে প্রায় ৬ লক্ষ বাংলাদেশি কাজের জন্য বিদেশে পাড়ি দিয়েছে।
২০১১-১২ অর্থ বছরে তাদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১২.৮ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ৩০ গুন বেশি। তবে এই খাতটি বিপদে আসে বলে অনেক বিশেষজ্ঞদের অভিমত। তাদের মতে, আদম ব্যাপারীদের প্রতারণা, বিদেশের জেলে বাংলাদেশিদের অবস্থান এবং সরকারের পর্যাপ্ত সমন্বয় ও পর্যবেক্ষনের অভাব এই খাতকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে তাদের অভিমত।
ঢাকাস্থ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটিএর নির্বাহী পরিচালক আহসান মুনছুর এর মতে, বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের তিন বছরের আয়ের এক বছরের আয় বিদেশ যাওয়া এবং ভিসা পেতেই খরচ করে ফেলেন। নানা স্তরের মধ্য স্বত্বভোগীদের কারণে যে শ্রমিক বিদেশে যান তিনি যেমন কাজ সম্পর্কে কিছু জানেন না তেমনি যে ব্যক্তি এই শ্রমিককে নিচ্ছেন তিনিও শ্রমিকের সম্পর্কে কিছৃই জানেন না।
বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ দৈনিক ১.২০ ডলারের নিচে আয় করে। এই কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যক্তিই জীবনমানের উন্নয়নের জন্য বিদেশে পাড়ি জমান।
আর এদের অধিকাংশই বিদেশে যান অবৈধ উপায়ে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধ উপায়ে মধ্য প্রাচ্য ও আফ্রিকায় পাড়ি জমান এই সকল নিন্ম বিত্ত ব্যক্তিরা। যাদের অধিকাংশই দালালদের দ্বারা প্রতারিত হয় নতুবা দেনা মাথায় নিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
এই সকল অবৈধ দালালরা বিদেশ যেতে আগ্রহীদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা নেন এবং বিদেশে এরা ছায়া এজেন্ট নিয়োগ করে এই ধরণের প্রতারণা করে থাকে বলে অভিমত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফুজি এন্ড মাইগেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট এর গবেষক সেলিম রেজা।
তার মতে, অনেক বাংলাদেশি বিদেশে তাদেরকে আবিষ্কার করেন দাসদের পর্যায়ে। এখানে তারা যেমন বৈধ হতে পারে না তেমনি দেশেও ফিরে আসতে পারে না।
বাংলাদেশের প্রায় ৮০০ রিক্রুটিং এজেন্সির সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ এর সাধারণ সম্পাদক, আলী হায়দার চৌধুরী, আদম ব্যাপারীরা এই ধরণের কাজের যুক্ত এই কথা যেমন মেনে নেননি পাশাপাশি তার নিজস্ব এজেন্সির নামে অবৈধ উপায়ে মানুষকে বিদেশে প্রেরণের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, আমরা সরকারি এজেন্ট ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির সাথে তাদের না যোগাযোগ করার জন্য সতর্ক করে দেই।
তারপরও গ্রমের অনেকেই ঢাকায় না এসে গ্রামের দালালদের সাথে যোগাযোগ করেন।
তবে দেশে ফিরেও শান্তিতে নেই বল্টু মিয়া। পাওনাদারের জ্বালায় তিনি ও তার পরিবার দিশেহারা। তিনি দেশে ফিরে এসে এবং পরিবারের সাথে মিলিত হতে পেরে খুশি হলেও তার ভাগ্যে এখনো তার কোন কাজ জোটেনি।
বর্তমানে জীবন সম্পর্ক তার অনুভূতি, “মনে হয় আমি এখনো জেলে আটক আছি।
”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।