পাখি এক্সপ্রেস
১.
বখতিয়ার সাহেবের বড় শ্যালক স্বাধীনতা বিরোধী। খবর নিয়ে দেখেছেন তার শ্বশুর মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছেন। একদিন রাতে একই সাথে এ দু’টো বিষয় আবিষ্কার করলেন। তার পরদিন অফিস গিয়ে জানতে পারেন সবচেয়ে কাছের কলিগের কাছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন হচ্ছে এই অঞ্চলের সবচেয়ে ঘৃণিত ঘটনা। এমনকি এই ভদ্রলোক মাসে তিন হাজার টাকা করে স্বাধীনতা বিরোধী সংগঠন জামায়াতকে দিয়ে থাকেন।
পরপর তিনটি বড় আঘাত বখতিয়ার সাহেবকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। এখন তার মনে হয় বাসার দারোয়ানটাও স্বাধীনতা বিরোধী এবং সে জানে বাসার তিন তলার স্যার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানুষ। নিশ্চয় এ দারোয়ান বিষয়টি শিবির ক্যাডারদের বলে দেবে। তারপর একদিন রাতে বাসায় ফেরার পথে ওরা আক্রমণ করে ঘাড় মটকে দেবে। ঘাড় মটকে চলে যাওয়ার পর একজন রিকশাওয়ালা এগিয়ে এসে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মারা যাবেন।
এইসব আতংকের বাইরে বখতিয়ার সাহেবের দৈনন্দিন জীবনচর্চা আরো অনেক বেশি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন অফিসে গিয়ে যে মিনারেল ওয়াটারের বোতল থেকে পানি খান, তার মালিক স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। বড় শ্যালকের সুপারিশে নিজের জন্য একটা পেনশন বীমা করেছেন। জানা গেছে বীমা কম্পানির মালিকও ওরা। বখতিয়ার সাহেব বাবা জর্দা দিয়ে পান খান।
অন্য কোন জর্দায় মজা পান না। উনার আশংকা বাবা জর্দার মালিকও স্বাধীনতা বিরোধী হতে পারে। অনেককে জিজ্ঞাসা করেও বিষয়টি জানতে পারলেন না। যেহেতু সন্দেহ জন্মেছে সেহেতু তিনি পান খাওয়া ছেড়ে দিলেন। চাইলে জর্দা ছাড়া পান চালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু একটু জর্দা খাবেন বলেইতো পানটা খেতেন।
জর্দা নাইতো পানও নাই।
আসলে ভদ্রলোক শিওর যে, দেশের জন্য তার তেমন কিছু করার নাই। দশ বছর ধরে অফিসে যে বোতলের পানি খেয়ে আসছেন, তার মালিক এ দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে এবং এখনো সার্বভৌমত্ব বিরোধী কাজ কর্ম করে যাচ্ছে। অথচ তিনি বিষয়টা জানতেনই না। এখন ওদের হাত থেকে মালিকানা কেড়ে নিয়ে দূর সম্পর্কের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর হাতে বুঝিয়ে দেয়া আসলেই তার পক্ষে সম্ভব না।
বেতন পান মাত্র পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা। যার বেশিরভাগই ছেলের পড়াশোনার পেছনে চলে যায়। নইলে যেসব ছেলেমেয়ে এখন রাজাকারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছে, তাদেরকে মাসে কিছু টাকা দিয়ে দিলে ওরা বখতিয়ার সাহেবের হয়ে দেশের জন্য কাজ করে দিতো। কিন্তু সেই সামর্থ্য তার নেই। নিজের ছেলেকেও এসব বিষয়ে কখনো কিছু বলেননি।
আদৌ তার ছেলে জামায়াত শিবিরের বিষয়ে সচেতন কিনা, তিনি শিওর না। শুনেছেন ছেলে কয়েকদিন প্রজন্ম চত্বরে গিয়েছে। কিন্তু অনেকেতো সেখানে ঘুরতেও গিয়েছে। হয়তো তার ছেলেও বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেছে। এ নিয়ে ছেলের সাথে কখনো বিস্তারিত কথা হয়নি।
দায়বোধ, নিজের অজ্ঞতা, সীমাবদ্ধতা, অসহায়ত্ব লোকটাকে কুঁজো করে দিলো। সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো। কিছুদিন হলো মানুষের সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা গিয়ে গিয়ে আবিষ্কার করলেন চারপাশে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মানুষ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা মেনে নিতে পারেনি। অথচ দিব্যি এই দেশের জাতীয় পরিচয় পত্র, পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি কথাও বলে বাংলা ভাষায়।
এসব বৈসাদৃশ্য নিয়ে ভাবতে ভাবতে মনের বল ভেঙে গেছে, শরীরের বলও টের পান না। অফিসের কাজকর্ম এখন অবধি চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মনে হচ্ছে দু’দিন পর আর কোন কিছুই চলবে না। দিনের কাজ দিনে শেষ করতে পারবেন না। পরের দিনের জন্য থেকে যায়।
এটাতো মালিক সহ্য করবে না। চাকুরি চলে যাবে। তারপর ছেলের পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যাবে। মানে, এরকম হলে দারুন মুশকিল হবে। বৃদ্ধ বয়সে এসে এমন কঠিন মানসিক অস্থিরতার কারণে রাতে ঘুমের মাঝে খারাপ স্বপ্ন দেখেন।
সার্বিক পরিস্থিতি শেয়ার করার মতও কেউ নেই। একমাত্র ছেলে শাওনের জন্মের তিন বছর পর দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সময় স্ত্রী ও সন্তান দু’জনেরই মৃত্যু ঘটে। এরপর আর বিয়ে করেননি। শাওনের সাথে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত নন। এসব অস্থিরতা তাই নিজের মনেই বসত করছে, প্রজনন হচ্ছে এবং ভেতরে ভেতরে তিনি বিধ্বস্ত হচ্ছেন।
২.
রাত আড়াইটা। বখতিয়ার সাহেবের ভ্রু কুচকায়, আবার মিলিয়ে যায়। সিনা টানটান হয়ে ওঠে। পায়ের গোড়ালি টান খায় আবার সোজা হয়, আবার বাঁকা হয়। ইলেকট্রিসিটি আছে, ফ্যান ঘুরছে, কিন্তু তিনি প্রচন্ড ঘামছেন।
ডানে বামে মোচড় খাচ্ছেন। এক হাত বুকের উপর উদ্দেশ্যহীন ঘষে যাচ্ছেন। হঠাৎ চোখের পাতা খুলে যায়। প্রতিদিনের মত আজও স্বপ্ন দেখলেন। নিশ্চয় কোন দুঃস্বপ্ন হবে।
তাকে যথেষ্ঠ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। পাশে শাওন ঘুমিয়ে আছে। ঘাড় কাত করে তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন। খাটের পাশে টেবিলে ঢেকে রাখা জলের গ্লাসে হাত বাড়িয়েও হাত ফিরিয়ে নিলেন। শাওনের মাথায় হাত বুলিয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলেন।
সফল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। গায়ের জামা ঘামে ভিজে গেছে। জামা খুলে গামছা দিয়ে গা মুছে নিলেন।
চোখে একটুও ঘুম নেই। মাথার ভেতর গভীর কোন চিন্তা খেলছে।
ঘরময় কিছুক্ষণ চিন্তিত পায়ে হাঁটাহাঁটি করে আলমারি থেকে ব্যাগ বের করে নিজের ও ছেলের কিছু জামা কাপড় গুছিয়ে একপাশে রেখে দিলেন। বালিশের তলা থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে কাকে যেন কল করে দু’বারের চেষ্টায় কথা বলতে পারলেন। ড্রয়ার থেকে বেশ কিছু ক্যাশ টাকা নিয়ে টিশার্ট পরে খালি হাতে বেরিয়ে পড়লেন।
শাওনের ঘুম ভাঙার আগে ফিরে এলেন। হাতে কালো পলিব্যাগে মোড়ানো একটি প্যাকেট।
ব্যাগের ভেতর রেখে ফ্রেশ হয়ে ছেলেকে জাগিয়ে পাউরুটি, কলা, ডিম নিয়ে টেবিলে বসলেন। রাতের স্বপ্নের কোন প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। বেশ ঝরঝরে মনে হচ্ছে। অনেকটা চনমনেও। স্বাভাবিকভাবে বখতিয়ার সাহেব এতটা চনমনে কখনো থাকেন না।
বিশেষত স্ত্রী মারা যাওয়ার পর শাওনকে নিয়ে ভালোই বিপদে আছেন। প্রায়ই বন্ধুদের বলেন, কখনো যেন বউকে মরতে না দেয়। বউ মরে গেলে মহাবিপদ। বউকে যেকোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
ওয়াশরুম থেকে ফিরে গোছানো ব্যাগ দেখে শাওন জিজ্ঞাসা করে তার বাবা কোথায় যাবে।
বাবার জবাব শুনে যারপরনাই খুশি হয়। বাবা অফিসে যাবে না, ছেলে স্কুলে যাবে না; দু’জনই বেড়াতে যাবে! অথচ স্কুল ফাঁকি দিয়ে নানু বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার অনুমতিও কখনো শাওন পায়নি। আজকের সকালটা কেমন যেন অবিশ্বাস্য হয়ে উঠলো তার কাছে। ক্লাস সেভেনে পড়ুয়া একটা ছেলের কাছে পিতা কর্তৃক স্কুলে না যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যে কী মজার, তা বখতিয়ার সাহেবও জানেন।
৩.
বাস চলছে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে।
কুমিল্লা পার হয়ে ফেনীর কাছাকাছি। মাঝখানে যাত্রা বিরতিতে ছেলেকে নিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলেন। শাওন সর্ষে ইলিশ খেতে পছন্দ করে। এটাই তার সবচে প্রিয় খাবার। বখতিয়ার সাহেব এই বিশেষ খাবার রান্না করতে পারেন না।
বাসার একটু দূরে একটি ভালো রেস্তরা আছে। ইলিশের মৌসুমে ছেলেকে নিয়ে সেখানে যান। যাত্রা বিরতিতে হাইওয়ে রেঁস্তোরায় ছেলেকে নিয়ে ইলিশ ভাত খেলেন। রাতেও দু’জন মিলে সর্ষে ইলিশ দিয়েই ভাত খাবেন।
দুপুরে ভাত খাওয়ার পর শাওন ঘুমায়।
আজও ভাত খাওয়ার আধঘন্টার মধ্যে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলেটা যখন ঘুমায়, ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে থাকে। প্রতিদিন রাতে ঘুমন্ত ছেলের ঠোঁটের কোণের হাসি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েন তার বাবা। অবশ্য শাওন জেগে থাকলেও হাসে। যখন তখন হাসে।
এটা তার স্বয়ংক্রিয় শারিরীক ভাষা। কারো চোখে চোখ পড়লেই গালের দু’পাশ জমে গিয়ে ঠোঁট দু’টো প্রসারিত হয়ে যায়। এতে কার কী হয় জানে না, কিন্তু তার বাবা যে যথেষ্ট সুখে থাকেন, সে কথা জানা আছে।
জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাংলাদেশ দেখছেন শাওনের বাবা। নির্দিষ্ট করে বিস্তৃর্ণ সবুজ দেখার সময় তার মনে হয় সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশকেই দেখছেন।
প্রথম প্রথম ভাবতেন এটা কেবল তার বেলায় ঘটে, কিন্তু এটা শাওনের বেলায়ও ঘটে এমনকি তার যে মামা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী, তার কাছেও নাকি বিস্তৃর্ণ সবুজ খুব ভালো লাগে। সবুজ ভালো লাগে এমন কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করতে পারে, বিশ্বাস হয় না শাওনের বাবার। অবশ্য পাকিস্তানের পতাকার রংও সবুজ। শাওনের মামা সম্ভবত সবুজের মাঝে ওই লাল টুকটুকে সূর্যটা পছন্দ করেন না। কী রোমান্টিক, পতাকার মাঝে কামড়ে খাওয়া চাঁদ আর তারা না দেখলে তার ভালোই লাগে না!
শাওনের ঘুম ভাঙে।
বাবার কাধে মাথা রেখে জিজ্ঞাসা করে -
: বাবা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
: অনেক দূরে। পাহাড়ের দেশে। আমরা উঁচু উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মেঘ ধরবো।
: বাহ্ কী মজা! আমি যদি হাত দিয়ে নাগাল না পাই, তাহলে তোমার কাঁধে উঠে ধরবো।
শাওন খুশি হয়।
হাসিটা একটু বড় করে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে ছেলের হাসির প্রতি সমর্থন জনায় বখতিয়ার সাহেব।
শাওনের মাথার উপর চলতে থাকা হাত ধীরে ধীরে থেমে যায়। হঠাৎ স্বাধীনতা বিরোধীদের বেয়াদবির কথা মনে উঠে। এরা কিছুদিন আগে তাদের এক নেতাকে চাঁদে দেখা গেছে বলে কতগুলো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে দুই ভাগ করেছে। শহীদ মিনার ভেঙেছে। দেশের কোথাও কোথাও পাকিস্তানের পতাকা নিয়ে মিছিল করেছে। বাংলাদেশের এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্য নিজেকে দায়ী করেন তিনি। তার ভুলের কারণে, উদাসীনতার কারণে পাকিস্তানী কীটগুলো স্বাধীন বাংলাদেশে এসব দৃষ্টতা দেখায় বলে বখতিয়ার সাহেবের শতভাগ বিশ্বাস।
দায় এড়ানোর কোন যুক্তিই খুঁজে পান না তিনি। তার ধারনা তিনি যদি যৌবনে দশ জন মানুষকে সচেতন করতে পারতেন, তাহলে শাওনের জন্মের আগে সারাদেশের সব দেশপ্রেমিক মানুষ এসব বোধহীন জানোয়ার সম্পর্কে সচেতন হয়ে যেত। শাওনের জন্ম হতো রাজাকার ও তাদের ছানাপোনাহীন বাংলাদেশে। কিন্তু তার একটা ভুলের কারণে আজ দেশকে ভোগ করতে হচ্ছে ভয়াবহ পরিণতি, নেমে এসেছে ভয়ংকর সব দুর্যোগ।
৪.
বান্দরবন শহর।
ছেলেকে একা হোটেলে রেখে খাবারের হোটেলে ইলিশ মাছ খুঁজতে বের হয়েছেন বখতিয়ার সাহেব। কয়েকটি হোটেল খোঁজার পর একটি ইলিশওয়ালা হোটেলে পাওয়া গেছে, কিন্তু সেটা লবন দেয়া ইলিশের ঝাল রান্না। ইলিশ হলেই চলবে। দু’জনের জন্য ভাত, ইলিশ, ডাল নিয়ে নিলেন। ইলিশ না পাওয়া গেলে মহা সর্বনাশ হয়ে যেতো।
শাওনকে আজ রাতে ইলিশ অবশ্যই অবশ্যই খাওয়াতে হবে।
টানা পনের ষোল ঘন্টা বাসে চড়ে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছেন। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া উচিত। ভোরে ভোরে ঘুম থেকে উঠে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যেতে হবে। কিন্তু সাথে করে শাওনের বালিশটা আনতে ভুলে গেছেন।
জন্মের পর শাওন যে বালিশে প্রথম মাথা রেখেছে, এরপর যতবার বালিশের তুলা পরিবর্তন করেছেন, আগের বালিশ থেকে একটু তুলা নতুন তুলার সাথে মিশিয়ে রেখেছেন। বালিশটা শাওনের মা নিজের হাতে বানিয়েছেন। মায়ের কোলতো শাওন হারিয়েছে, ও কোলে মাথা রাখার সুযোগ ক’বছরই আর পেয়েছে; কিন্তু মায়ের হাতে বোনা বালিশে বারো তেরো বছর বয়স পর্যন্ত মাথা রেখে চলছে শাওন। এসব হচ্ছে নিরবিচ্ছিন্ন আবেগ। একান্ত নিজস্ব ফ্যাশন।
ভালো লাগা।
হোটেলে ফিরে দেখেন শাওন ঘুমিয়ে গেছে। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়া শাওনের মুখে হাসি নেই। দীর্ঘ বাস ভ্রমণ তাকে হাসতে ভুলিয়ে দিয়েছে। বখতিয়ার সাহেবের কেন যেন মনে হলো মায়ের বোনা বালিশহীন ঘুমে শাওন হাসছে না।
ঠিক এই মুহূর্তে খুব সূক্ষ্ম এক অপরাধবোধে দগ্ধ হচ্ছেন তিনি।
শাওনকে জাগালেন। সেও জাগতে ইচ্ছুক। না খেয়ে ঘুমালে বাবা মন খারাপ করবেন, তাই চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে মুখ না ধুয়ে খেতে বসলো। বাবা বললেন শুধু ডাল দিয়ে খাবেন।
শাওন কেবল তার প্লেট থেকে ইলিশ দিয়ে মাখানো এক লোকমা খাইয়ে দিলেই চলবে। আসলে বখতিয়ার সাহেব এতক্ষণে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছেন না। খুব অস্বাভাবিকভাবে ছেলে নিয়ে বান্দরবন আসার হেতু শাওন জানে না। শাওনের খাওয়া শেষ হয়ে আসলেও তার বাবার খাওয়া শেষ হতে এখনো অনেক দেরি হবে। অথচ প্রতিদিন নিজের খাওয়া শেষ করে ছেলের খাওয়া শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকেন।
আজ কী হয়েছে, শাওন জানে না।
ওয়াশ রুম থেকে হাত ধুয়ে এসে বাবার পাশে বসলো। ততক্ষণে বাবার খাওয়া শেষ। শাওনকে জামা কাপড় বদলে নিতে বলে ওয়াশ রুমে গেলেন তার বাবা। ব্যাগের জিপার খুলে নিজের জামা বের করতে গিয়ে দেখে কালো পলিব্যাগে মোড়ানো একটা প্যাকেট বের হয়ে এলো।
প্যাকেট খুলে দেখে আস্ত একটা পিস্তল। শাওন অবাক হয় না। বরং অপিরিচত প্রেক্ষাপটে শাওন বেশ রোমঞ্চিত। হাতে নিয়ে বিভিন্ন স্টাইলে পিস্তল ধরে পোজ দিচ্ছে। বাবা ফিরে এসে শাওনের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসিমুখে পিস্তলটা নিয়ে ব্যাগে রাখলেন।
ছেলেকে বললেন, পাহাড়ি এলাকা, কখন কোন বিপদ হয়, তাই এক বন্ধু থেকে নিয়ে আসলেন। শাওন হাসতে হাসতে বলে তুমি কি পিস্তল চালাতে পারো? কিছু না বলে একটু হাসিমাখা মুখে ছেলেকে বুঝালেন তিনি পিস্তল চালাতে পারেন।
৫.
শাওন ও তার বাবা শুয়ে পড়েছে। ছেলের ডান হাতটা ধরে বুকের উপর রাখলেন বখতিয়ার সাহেব।
: তোমার মোবাইলে যদি দেশাত্মবোধক গান থেকে থাকে, একটা গান চালিয়ে দাও।
অনেকদিন দেশাত্মবোধক গান শুনি না।
‘ভেবো নাগো মা, তোমার ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছে পথে’ গানটি প্লে করে বাবার কানে হেডফোনের এক প্রান্ত গুঁজে দিলো। আরেক প্রান্ত নিজের কানে। গানের প্রথম অংশ শুনেই মনে হলো এসব ছেলেরা কারা, তিনি নাকি তার ছেলে শাওন? একবার ভাবলেন শাওনকে জিজ্ঞাসা করবেন। আবার ভাবলেন সময়ের কথা সময়ে জিজ্ঞাসা না করে অসময়ে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই।
গান শুনতে শুনতে শাওন ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু বাবার চোখে ঘুম নেই। বিছানা থেকে উঠে ব্যাগ থেকে পিস্তলটা নিয়ে রুমের দেয়াল ঘড়ি, টেবিলে রাখা জলের মগ, ওয়াশরুমের দরজার ছিটকিনি, শাওনের জুতাসহ এটা সেটা টার্গেট করছেন। প্রতিবারই তার হাত কেঁপে উঠছে। ফ্যানের রেগুলেটর ঘুরিয়ে দেখলেন ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে।
গা ভিজে গেছে ঘামে। এবার ফ্যানের রেগুলেটর টার্গেট করলেন। হাতের কাঁপুনি অনেকটা কমেছে। পিস্তলটা শাওনের দিকে তাক করলেন। এবার চমকে উঠে পিস্তল রেখে শাওনের পাশে গিয়ে বসলেন।
দেখেন ছেলের ভ্রু কুচকায়, আবার মিলিয়ে যায়। সিনা টানটান হয়ে ওঠে। পায়ের গোড়ালি টান খায় আবার সোজা হয়, আবার বাঁকা হয়। শাওন হয়তো স্বপ্ন দেখছে। নিশ্চয় কোন দুঃস্বপ্ন হবে।
তাকে যথেষ্ট অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। ভীষণ ঘেমে পুরো শরীর ভিজে গেছে। গামছা নিয়ে বুকের ঘাম মুছে দিলেন। পায়ের কাছে বসে পা টিপে দিলেন। পায়ের আঙুল টেনে দিয়ে দু’পা সোজা করে রাখলেন।
ভোরে সূর্য উঠার আগে উঠতে হবে, কিন্তু ঘুমতো আসছে না। বখতিয়ার সাহেব সিদ্ধান্ত দিলেন আজ আর ঘুমাবেন না। বালিশ খাড়া করে দিয়ে আধশোয়া হয়ে এটা ওটা সেটা ভাবছেন। বেশ কিছু অপরিচিত গল্প মনে পড়ছে। দারুণ সব সাজানো গল্প।
গল্পগুলো স্বাধীনতা যুদ্ধের। একাত্তরের জুলাই মাস। বর্ষার পানিতে গ্রামের রাস্তা ডুবে গেছে। গভীর রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে রুহুল আমিন নামের এক ছেলেকে বিদায় দিচ্ছে তার মা বাবা। ছেলে যুদ্ধে যাবে।
কিছুদূর এসে বাড়ির দিকে দৌড় দিতে চায় রুহুল আমিন। মা দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে ধরে ফেলেন। রাস্তা ডুবা হাঁটু জলে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে। ছেলের ঘাড় ধরে বললেন পালিয়ে বাঁচতে পারবে না, যুদ্ধে যেতেই হবে। নইলে বাবা মা মিলে জলে চুবিয়ে মারবেন।
বাধ্য হয়ে রুহুল আমিন যুদ্ধে যায়। এরকম অনেক না শোনা গল্প তার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।
শাওনের মোবাইলে এলার্ম বেজে উঠে। অসমাপ্ত ঘুম নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে দেখে বড় বড় লাল চোখ নিয়ে বসে বসে কী যেন ভাবছেন। গতকাল ভোর থেকেই বাবার এমন অদ্ভুত সব আচরণে অভ্যস্ত বলে বড় বড় লাল চোখ নিয়ে বিস্মিত নয় শাওন।
বরং বাবাকে ওভাবে রেখেই ওয়াশ রুমে চলে গেলো। বাবা বলেছেন ভোরে ভোরে বের হতে হবে।
৬.
শহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে। জন মানবহীন গহীন পাহাড়ী অরণ্যে ছেলেকে নিয়ে হাঁটছেন বখতিয়ার সাহেব। সূর্য এখনো অত সবল হয়নি।
কিন্তু সমতলের মানুষ অনেক উঁচুতে উঠতে উঠতে পায়ের হাঁটু জড়াজড়ি খাচ্ছে। বাবাকে অনেক অস্থির দেখালেও ছেলেকে খুব ধীর স্থির শান্ত দেখাচ্ছে। পাহাড়ের এই দিকটা অনেক শান্ত। একটি গাছের ছায়ায় শাওন বসে পড়ে। শাওনের দেখাদেখি বাবাও বসে পড়েন।
কাঁধে ঝুলানো জলপাত্রটা ছেলের হাতে ধরিয়ে দেন। বান্দরবনের শহর থেকে কেনা আধাকেজি আপেল থেকে একটি নিজে নেন, আরেকটি ছেলেকে দেন।
: বাবা, ডান পা টা খুব ব্যাথা করছে। তোমাকে বলা হয়নি, পরশু স্কুলে ফুটবল খেলতে গিয়ে এই পায়ে ব্যাথা পেয়েছি। একটু মালিশ করে দিবে?
বখতিয়ার সাহেব ছেলে পা মালিশ করছেন।
আপেল কামড়াতে কামড়াতে ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অপরিচিত চাহনি। অনেক কিছু বলতে চায়। তিনিও ছেলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পা টিপে যাচ্ছেন। আপেল খাচ্ছেন না।
কারো মুখে কোন কথা নেই। বাবার চোখের কোণে জলের কণা জমতে শুরু করেছে। তার মনে হলো একই দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকার কারণে এমনটি হচ্ছে।
: এতক্ষণ কোন দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে জল আসে। চোখ নামিয়ে নে।
: আচ্ছা বাবা, তোমার বয়স যখন বারো ছিলো, তখন তোমার বাবার বয়স কত ছিলো?
: মনে নেই। কেন?
: তিনিতো দেখতে অনেক সুন্দর ছিলেন। তুমি কি তাকে বাবা বলে ডাকতে, নাকি আব্বা?
: আব্বা।
: তাহালে আমাকে বাবা শেখালে কেন? আমিও তোমাকে আব্বা বলেই ডাকতাম। এখন থেকে তোমাকে আব্বা বলে ডাকবো।
: ডাক।
: আচ্ছা আব্বা, মানুষতো এমনি এমনিই স্বামী অথবা স্ত্রীকে বলে যায়, আমি যদি মরে যাই, তাহলে আমার সন্তানটাকে এভাবে এভাবে বড় করবে। মা কি আমাকে নিয়ে তেমন কিছু বলেছিলো?
বখতিয়ার সাহেব এড়িয়ে গেলেন। হাত দু’টো ছেলের দিকে বাড়িয়ে বললেন আঙুল টেনে দিতে। শাওন আঙুল টানতে টানতে বলে, ‘তুমিতো বুড়ো হয়ে যাচ্ছো।
চামড়া কুঁচকে যাচ্ছে। আমিতো এখনো বড় হইনি। তোমাকে খাওয়াবে কে? বড় মামার করে দেয়া পেনশন বীমার টাকা দিয়ে চলবে?’
এবারও ছেলের প্রশ্নের জবাব দেননি। আবার হাঁটা শুরু করলেন। ওই পেনশন বীমার টাকাটা নেবেন না বলে ঠিক করেছেন।
আবার ভেবেছেন তাহলে এই টাকাতো ওরা দেশটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বিনাশ করার কাজে লাগাবে। তারপর আবার ভাবলেন, সে সুযোগতো আর ওরা পাচ্ছে না। সুতরাং ওই টাকা তিনি নিবেন না। নিশ্চয় রাষ্ট্র সব টাকা নিজের মালিকানায় নিয়ে আসবে।
গতকাল রাতে দেখা স্বপ্নের সাথে সব মিলে যাচ্ছে।
নির্বিকার শাওন স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে যাচ্ছে। বাবার কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে নিজের কাঁধে নিলো। তার আগে গামছাটা বের করে গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর ঘাম মুছে নিচ্ছে। বখতিয়ার সাহেব বার বার ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন।
প্রতিবারই দেখেন শাওন তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোন বার গম্ভীর, কোন বার হালকা হাসিতে। দু’টোর একটাতেও তিনি সাড়া দিচ্ছেন না। এতদূর হেঁটেও ছেলের মুখটা শুকিয়ে গেলো না। ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
এরকম উজ্জ্বল মুখ দেখলে শাওনের বাবা আতংকিত হোন। বৃদ্ধা মায়ের মৃত্যুর আগে তিনিও এরকম উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন। মায়ের মুখে থেকে শুনেছেন বাবার মৃত্যুর সময়ও মুখ এমন উজ্জ্বল ছিলো।
৭.
অনেকটা সমতল একটা যায়গা। কিছু রঙিন পাখির উড়াউড়ি।
ছোট ছোট অনুজ্জ্বল ফুল সমেত কয়েকটি গাছ। মাত্র একটি ডালওয়ালা লম্বা একটি গাছে অনেকগুলো পাখি বসে আছে। সবকিছুই আজ এ ঘটনার সাক্ষি। ফুল, পাখি, গাছ সাক্ষি থাকলে কোন সমস্যা নেই। মানুষ না থাকলেই হলো।
বখতিয়ার সাহেব ছেলেকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বললেন।
পিতা পুত্র আপেল খাচ্ছে। গামছা দিয়ে ছেলের শরীরের ঘাম মুছে নিজের ঘাম মুছছেন। কিন্তু পরক্ষণেই আবার গা ভিজে যাচ্ছে। ঘাম মুছতে মুছতে ক্লান্ত হয়ে গামছাটা পাশে একটা ছোট গাছের উপর মেলে দিলেন।
আর মাত্র একটি আপেল আছে। শাওন খেতে চাইলে দিলেন না। বললেন এটা পরে খাবে।
: আচ্ছা শাওন, ধর তোকে এখানে রেখে গেলাম। তাহলে তুই থাকবি কিভাবে?
শাওন হাসে।
বলে, ডিসকভারি চ্যানেলে অনেক সারভাইভাল পোগ্রাম দেখেছে। এসব ছোটখাটো পাহাড়ে টিকে থাকা মোটেও কঠিন কাজ না। ঠিকই লোকালয়ের সন্ধান নিয়ে ঢাকায় পৌঁছে যেতে পারবে।
: ধর কোনভাবেই যেতে পারলি না।
শাওন আবারো হাসে।
তাহলে সমস্যা কী? থেকে যাবো!
ব্যাগ খুলে পিস্তল বের করে নিলেন বখতিয়ার সাহেব। এতক্ষণে তার শরীরের সব কাপড় ঘামে ভিজে গেছে। গায়ের শার্টটা খুলে আরেকটা গাছে মেলে রাখলেন। হাতের আপেল নিয়ে ছেলের কাছে গিয়ে বললেন একটা সিনেমাটিক ক্যারিশমা দেখাবেন। ছেলের মাথার উপর আপেলটি রাখলেন।
শাওন আপেল মাথায় নিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে রইলো। ছেলের কাছ থেকে হাত দশেক দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন।
: তুই বলছিলি না, আমি পিস্তল চালাতে পারি কিনা? এখন দেখবি আমি কত পাকা পিস্তল চালনেওয়ালা।
শাওন হাসে।
: তোর মাথার উপর রাখা আপেলটি এখান থেকে গুলি করে উড়িয়ে দিবো।
তুই টেরও পাবি না।
শাওন হাসে। খানিকটা জোরে। সবকিছু গত রাতে দেখা তার স্বপ্নের সাথে মিলে যাচ্ছে।
: খবরদার নড়বি না।
আমি ঘাম মুছে আসি। একটু জল খেয়ে নিই। সোজা দাঁড়িয়ে থাক।
জলের পাত্র পুরো শেষ করলেন। কিন্তু গলা ভিজছে না।
পাত্রটা রেখে ভালো করে ঘাম মুছে পজিশন নিয়ে দাঁড়ালেন। শাওন হাসছে। কে জানে, হয়তো বাবার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস আছে। যেমন বিশ্বাস থাকে ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তা হেঁটে পার হওয়ার সময়। শাওন জানে, বাবার হাত ধরে হাঁটলে কখনো দূর্ঘটনা ঘটবে না।
হয়তো আজও শাওন নিশ্চিত তার বাবা ঠিকই আপেলটি উড়িয়ে দিতে পারবে।
: আব্বা, তুমি বোধ হয় একটু বেশি দূরে চলে গেছো। আরো কাছে আসো। প্রথমে কিন্তু এখানে দাঁড়াওনি। ওই যে শুকনা ফুলওয়ালা গাছটা আছে না, ওখানে ছিলে।
বখতিয়ার সাহেব এগিয়ে আসেন। ছেলের মাথার উপর আপেলের দিকে পিস্তল তাক করেন।
: আব্বা, আমি শাহাবাগে ছবির হাটে গিয়ে একদিন বন্দুক দিয়ে বেলুন ফুটিয়েছিলাম। বেলুনওয়ালা বলেছে বন্ধুক কাঁধ বরাবর রেখে ঘাড় ও মাথা সোজা রেখে তারপর গুলি করতে। তোমার হাত আরো উপরে উঠবে।
বাঁকা হয়ে দাঁড়ালেও তোমাকে ভার্টিক্যালি সোজা থাকতে হবে। নইলে কিন্তু গুলিটা আমার নাকে মুখে পড়তে পারে। তাহলে কিন্তু মরে যাবো।
বখতিয়ার সাহেব ছেলের কথায় ভয় পেয়ে যান। তিনি বার বার পজিশন নিচ্ছেন।
তার ছেলে বার বার সংশোধন করে দিচ্ছে।
: আব্বা, আমি একটা পরিকল্পনা করেছি। শুনবে?
: পরে শুনবো। আগে আপেলটা উড়িয়ে নিই।
: আরে না, শোনই না।
খুব ভালো পরিকল্পনা।
: আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। বোতলে জল নাই। গলা ফেটে মরে যাবো। আগে আপেলটা উড়িয়ে নিতে দে।
: শোনো একশ গজ পেছনে ছোট্ট একটা ঝরনা দেখে এসেছি। তুমি ঠিকই জল খেয়ে নিতে পারবে।
পিস্তলের পজিশন ঠিক করতে করতে বললেন, আচ্ছা বল।
: আমাদের ইংলিশের স্যার বলেছেন দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধীরা। এদেরকে কেন্দ্র করেই নাকি দেশের সব সমস্যা ঘুরপাক খায়।
কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ নাকি বিষয়টা বুঝছে না।
মাথার উপর থেকে আপেলটা নিয়ে কামড় বসিয়ে দেয় শাওন।
: আমারতো পড়াশোনা বাদে আর কোন কাজ নেই। ভাবছি পড়াশোনার বাইরে বাকি সময়টা সাধারণ মানুষের সাথে কাটাবো। তাদেরকে বিষয়টা বুঝাবো।
স্যার বলেছেন আমাকে অনেকগুলো বই আর পেপার কাটিং পড়তে দিবেন। এসব বই আর পেপার কাটিং থেকে তথ্য প্রমাণ নিয়ে ফাইল করে তারপর মানুষের কাছে যাবো। স্যার বলেছেন এসব প্রমাণ দিয়েই নাকি মানুষকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে দেয়া যাবে। আর তোমার ছুটির দিনেতো তুমি আছই।
আপেল খেতে খেতে বাবার কাছে আসে।
অর্ধেক পরিমান খেয়ে বাবার হাতে আপেলটা ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘আসলে পেছনে কোন ঝরনা দেখিনি। তুমি বরং আপেলটুকু খাও। কিছুটা গলা ভিজবে। ’
বখতিয়ার সাহেব খানিকটা অচেতন হয়ে গেলেন। কী থেকে কী ঘটে গেলো কিছুই বুঝতে পারলেন না।
হাঁটুগেড়ে বসে ছেলের গালের দু’পাশে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরলেন। ছেলের কপালে কপাল লাগিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। শাওন কাঁদবে কি কাঁদবে না, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বাবার হাত থেকে পিস্তলটা নিয়ে দেখছে।
: হা হা হা, আব্বা; তুমিতো পিস্তলে গুলিই নাওনি।
নাকি গুলি আনতেই ভুলে গেছো!
হাসতে হাসতে ব্যাগ থেকে কিছু জামা কাপড় বের করে মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়ে। বাবার জন্য আরো কিছু কাপড়সহ ব্যাগটা রেখে দিয়ে শুয়ে পড়তে বলে।
: আব্বা, ডিসকভারি চ্যানেলে দেখেছি অনেক বেশি ক্লান্ত হলে গভীর ঘুম দিয়ে নেয়ার পরামর্শ দেয়। সূর্যটা গাছের আড়ালে চলে গেছে। একটু ঘুমিয়ে নাও।
তারপর আমরা ফিরে যাবো।
ছেলের কথা মত ব্যাগ টেনে নিয়ে মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লেন শাওনের বাবা।
: গত রাতে খুব ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখেছি। এক অপরিচিত লোক এসে বলে তুমি নাকি আমাকে হত্যা করার জন্য এখানে নিয়ে এসেছো। আমিতো তোমার খুব প্রিয়, আমাকে কোরবানি দিলে নাকি এই দেশে আর কোন স্বাধীনতা বিরোধী থাকবে না।
দেশের প্রতিটি মানুষ নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিদ্ধ হবে। একটু ভয় পেলেও স্বপ্নটা কী হাস্যকর! গুলি করে একটা আপেল উড়ানোর সাহস পাওনা, তুমি নাকি নিজের ছেলেকে হত্যা করবে। তাও আবার বুলেট আনোনি! হা হা হা!!!
বখতিয়ার সাহের ছেলের পাশে শুয়ে তার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ডান হাতটা টেনে এনে নিজের বুকের উপর রাখলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।