আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পদার্থ অপদার্থ

"পসার বিকিয়ে চলি জগৎ ফুটপাতে, সন্ধ্যাকালে ফিরে আসি প্রিয়ার মালা হাতে"

আমি পদার্থবিদ নই। তাই পদার্থ নিয়ে নিরেট বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। ছোটবেলায় যখন পদার্থ কী (?) জানতাম না তখন মনে অনেক প্রশ্ন জমা হতো। আচ্ছা পন্ডিত স্যার আমাকে মাঝে মাঝে অপদার্থ বলেন কেন? অপদার্থ কি? অপদার্থ কাকে বলে? বাসায় ফিরে মা'কে একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা অপদার্থ কী ? মা তো হেসেই বাঁচে না।

আমি বেশ ঘাবড়েছিলাম। পরে অবশ্য মা বলেছিলেন অপদার্থ এক ধরণের বকা। আমি ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম। আর জিভ কেটে লজ্জা ঢেকেছিলাম মা'কে বোকার মত ঐ প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার জন্য। অথচ ছোটবেলায় অনেকদিন পর্যন্ত অপদার্থ কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে বসেছিল।

বড় হয়ে পদার্থ কি জানবার পর অপদার্থ কথাটা আর তেমন করে ভাবায়নি। তাই নিজে কখনও কাউকে অপদার্থ বলে বকা দেইনি। কারন আমি জেনেছিলাম আসল পদার্থ কি। লেখাপড়া জানা কম বেশী সব মানুষই জানে পদার্থ কি। পদার্থ বিষয়ক পাঠে আমার হাতে খড়ি সেই স্কুল জীবনে।

সম্ভবত কাশ সেভেনে। সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়টি পাঠসূচীর অন্তভর্ূক্ত হওয়ায় বিজ্ঞানের প্রতি আমার আগ্রহ ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। তাই বিজ্ঞানের খুঁটি নাটি বিষয় নিয়ে নানা চিন্তা সব সময় মাথায় ঘুরপাক খেত। তার প্রমাণ বাসার কোন খেলনা আস্ত (আস্তমেয়ে কিন্তু না) থাকতো না। আর সেইজন্য কাকার কানমলা থেকে শুরু করে বাবার বকা কোনটাই বাদ যেত না।

এই প্রচেষ্টা আমার জীবনে দীর্ঘকাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। অবশ্য এর কুফল সুফল দুটোই পরবতর্ীকালে টের পেয়েছি এবং অদ্যাবধি পেয়ে যাচ্ছি। আমি প্রকৌশলী নই। তবুও আমার বাসা ভর্তি যন্ত্রপাতি। ড্রিল, গ্রাইন্ডার, নানা সাইজের করাত, হাতুর, বাটাল, জিগ 'স, র্যান্দা, তাঁতাল, প্ল্লায়ার্স, স্লাইড রেঞ্জ এবং হরেক রকম স্ক্রু ড্রাইভার আরও অনেক কিছু।

আরো আছে যত রকমের ভাঙ্গাচোড়া ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী। শ' পাঁচেক ভিডিও ক্যাসেট। আমাকে কোন কিছুর জন্য মিস্ত্রি ডাকতে হয় না। যার ফলে ঘরবাড়ি গোছানো থাকেনা। বউয়ের কাছে এটা একটা মস্তবড় জ্বালা।

সতীনের চেয়েও নাকি আমার এই সব উপদ্রপের যন্ত্রনা বেশী (সতীন আনলে টের পেত, ইচ্ছে হয় এনে দেখাই)। বউয়ের এক কথা- আমি কোন মিস্ত্রিকে বিয়ে করিনি। তার বিরাট বিষ্ময় একটা কবিতা পাগল, কাব্যরসিক মানুষ কি করে এই ভাবে যন্ত্রপাতির দাসত্ব করে সে কিছুতেই ভেবে পায়না। আমিও পাই না। অথচ কোরবানীর আগের রাতে যখন রাতের বেলা বিগড়ে যাওয়া ফ্রিজ ঠিক করে দেই তখন বলে, "যাক বাবা (আমিও সময়ে বাপ হয়ে যাই) বাঁচা গেল, নইলে সবকিছু ফেলে দিতে হতো"।

আবার কাট আউট চলে গেলে যখন ঘরে আলো ফিরিয়ে আনি তখন অন্ধকার মুখ আলোকিত করে চুপ করে বসে থাকে। আত্মীয় স্বজনের কারও টিভি/ফ্রিজ কিংবা কম্পিউটার কিনতে হলে আমি। ঠিক করতে হলেও আমি। কোন ছবিটা ভাল, কোন মার্কেটটা ভাল, কোন শাড়িটা ভাল, কোন রঙটা ভাল, কোন হোটেলের খাবার ভাল _ সব কিছুতেই আমি। আর এই আমিই পান থেকে চুন খসলেই অপদার্থ।

হুম! যা বলছিলাম। একটু উঁচু কাশে পদার্থ নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি করেছি। বায়ু পদার্থ কিনা পরীক্ষা করেছি। বেলুন ফুলিয়েছি, ওজন করেছি। আরও পরে জেনেছি বায়ুর চেয়ে হালকা গ্যাস সেগুলোও পদার্থ।

আমার চোখে দেখা না দেখা অনেক কিছুই পদার্থ- যা আমাদের চারিপাশে বিদ্যমান। প্রচলিত একটা সংজ্ঞাও মনে পড়ছে এই মুহূর্তে, দৃশ্যতঃ মহাজাগতিক প্রায় সকল বস্তুই পদার্থ। আলো চোখে দেখা যায় অথচ তা পদার্থ কিনা মোটেও জানা ছিল না। পদার্থ মানেই যাহার অবস্থান, ভর ও ওজন আছে এবং যাহা কিছু না কিছু জায়গা দখল করে। পদার্থ দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান দুটোই হতে পারে।

পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ খালি চোখেতো দূরের কথা শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও ভালভাবে দৃশ্যমান নয়। এমন অনেক কিছুই পদার্থ হিসেবে প্রমাণিত সত্য। অনু, পরমানু, ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন সবই পদার্থ। এই পর্বে সর্বশেষ সংযোজন 'কোয়ার্ক' যা আধুনিক বিজ্ঞানের নিরলস গবেষণার ফসল। সেটাও নাকি পদার্থ।

তাহলে নিশ্চয়ই মানুষের ডিএনএ অতি ক্ষুদ্র এক পদার্থ কণিকা। একটা পরিপূর্ণ বস্তু বা পদার্থ সামগ্রিক ভাবেও পদার্থ, আবার এর ভগ্নাংশও পদার্থ। তাই পদার্থ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে পদার্থগতভাবে আমরা কেউ এক মুহূর্তের জন্যেও অপদার্থ নই। অথচ বাক্য বিন্যাসের মারপ্যাঁচে আমরা সহজেই অপদার্থের উদাহরণ টানতে পারি। অপদার্থ বানাতে পারি।

আমার আয় কম। ঘুষ খেতে পারিনা তাই আমি অপদার্থ। আমার গাড়ী নেই বাড়ী নেই তাই প্রবাহমান সংসারের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি অপদার্থ। ছেলেটা ভাল রেজাল্ট করতে পারলো না, বাবা মায়ের চোখে ছেলেটা অপদার্থ। মেয়ে বিয়ে দিল অথচ জামাই ঠিক মত শাড়ী গয়না দিতে পারে না, জামাইটা একটা অপদার্থ।

কাজের ছেলেটা বা বুয়াটা ঠিক মত কাজ সামলাতে পারে না, তাই তারাও অপদার্থ। সরকার দেশ চালাতে পারেনা তাই সরকার একটা অপদার্থ। আরও অনেক অনেক অপদার্থকে আমরা অনায়াসে চিহ্নিত করতে পারি। উদাহরণ টানতে পারি। কিন্তু কথা হলো তারা অপদার্থ কেন? তাদের দোষটা কোথায়? কিসের ভিত্তিতে তারা অপদার্থ এর সঠিক ব্যাখা কে দেবে? আসল কথা হলো, আমরা আমাদের পারিপার্শিক ও পারষ্পারিক অবস্থানের ভিত্তিতে সমাজের যে চেহারাটা দেখছি এবং আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত যা ঘটছে এবং যে পরিবর্তনগুলো অহরহ ঘটে যাচ্ছে তাতে করে আমরা নিজেদের মনের মধ্যে একটা কাল্পনিক অবস্থান সূচক বা স্টান্ডার্ড ইনডেক্স তৈরী করে নিয়েছি, যার ভিত্তিতে আমরা কথায় কথায় অপদার্থ বলি।

আর এটাই হলো আমাদের পদার্থ হওয়া না হওয়ার মাপকাঠি। যার উপর ভিত্তি করে আমরা অন্যকে অহরহ অপদার্থ বলে যাচ্ছি। আর এই অপদার্থের গ্লানি ঘুচাতে তথাকথিত পদার্থের নামে নিজেদের শুধুমাত্র অপদার্থ বানাচ্ছি। শুধু তাই নয় চাহিদাকে প্রিজার্ভেটিব না করার খেসারত হিসেবে সমাজকে আমরা নিজেরাই দ্রুত পচনশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আর আমাদের এই পচনশীল চিন্তা চেতনার নিয়ামক বা জীবানুগুলো আমরা আমাদের পরবতর্ী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছি।

সেটা কি অপদাথের্র চেয়ে ভাল কিছু ?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।