কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, পানির অপর নাম কি? উত্তরটা সকলেরই জানা। উত্তরে অবশ্যই আসবে “জীবন”। পানি ছাড়া এ পৃথিবী এক মুহূর্ত কল্পনা করা যায় না। মাটির তলদেশের পানি, পুকুরের পানি, নদীর পানি, সমুদ্রের পানি। সব স্তরের পানি এ পৃথিবীকে টিকিয়ে রেখেছে তা নিঃসন্দেহে বলে দেয়া যায়।
আমি যদি বলি, সমুদ্রের পানি মানুষ ব্যবহার করতে পারে না। তাই সমুদ্র এ পৃথিবীতে না থাকলেও চলে। সমুদ্র এ পৃথিবীতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশী করে। বন্যা হয়, জলোচ্ছাস হয়, সুনামী হয়। এমনও ধারনা করা হয়, একদিন আমাদের এই ছোট্ট বাংলাদেশও নাকি চলে যাবে সমুদ্রের তলদেশে।
তারপরও যে যাই বলুক। পানির অপর নাম জীবন।
এবার আসি ভিন্ন প্রসঙ্গে। মানে, অন্য একটি জরুরী বিষয়ে। বিষয় হচ্ছে, তৈল।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সবচাইতে প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে “তেল”। যে নারীর কেশ সুন্দর। তাকে প্রথমেই প্রশ্ন করা হয়, আপনি কি তেল ব্যবহার করেন? যে নারীর রান্না ভালো, তাকেও প্রশ্ন করা হয়, আপনি কোন সয়াবিন তেল দিয়ে রান্না করেন? তার মানে কি দাঁড়ালো? তেল ছাড়া নারীর কেশ বলেন আর রান্না বলেন, দুইটাই কিন্তু অসম্ভব। আবার যদি অন্যদিকে তাকাই! যেমন- ধরুন, গাড়ী। গাড়ী কি তেল ছাড়া চলবে? যতই সি.এস.জি চালিত হোক না কেন! তেল ছাড়া গাড়ী কোন গাধাই চালাবে না।
সব বাহন, উড়োজাহাজ বলেন আর জাহাজ বলেন। তাও তেল। ঘোড়ার গাড়ী (ঘোড়ার গাড়ীর চাকাতে তেল দিতে হয়) থেকে বর্তমান প্রযুক্তির সব কিছু তেল ছাড়া চলবে?
এই জরুরী তেলও অনেক অশান্তির সৃষ্টি করে। ২০০১-এ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ বলেন, ‘এটা অনেকটা স্পষ্ট যে আমার দেশ, বিদেশী তেলের উপর নির্ভর করে। বেশীরভাগ তেল আমাকে আমদানি করতে হয় বাইরের দেশ থেকে।
যা অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে। ’ এই বক্তব্যের পরের গল্পটা সকলেরই জানা। ইরাকে প্রচুর তেল সম্পদ আছে। আর সেই তেল ভান্ডার দখল করতে ঝরেছে তেলের চেয়েও অধিক রক্ত। সুতরাং তেলের জন্য যুদ্ধ পর্যন্ত এ পৃথিবীতে হয়ে গেলো।
এতো গেলো, তেলের গল্প। এবার আসি ভিন্ন ধরনের তেলের গল্পে। তেল যে শুধু পানির মতই তৈল পদার্থ তা কিন্তু নয়। অদৃশ্য তেলও আছে এ পৃথিবীতে। সেটা হলো, কথার তেল।
কথা দিয়ে মানুষের মনকে জয় করতে পারাটাই হলো কথার তেল। অধিক আনুগত্য প্রকাশ করাটাকেও বলে তেলবাজি। এধরনের তেল আছে বহুপ্রকার। তেলকে ঠিক কি বলে সংজ্ঞায়িত করা যাবে তা আমার জানা নেই রে ভাই। তবে, কিছু মহান মানুষের উক্তি তুলে ধরতে পারি।
যেমন, জ্যান পাওল নামে এক মার্কিন তেল কম্পানির প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন, ‘জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সূত্র হলো, ঘুম থেকে ভোর বেলা জেগে ওঠা, প্রচুর কাজ করা, এবং অন্যকে তেল দিতে পারা। ’
শুধু এই মার্কিন তেল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাই নয়। একজন মার্কিন সিনেটর বলেছেন, তেল হচ্ছে তলোয়ারের চেয়ে শক্তিশালী।
অর্থাৎ সকল বাধাকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে তেলমারা কথামালার বৃষ্টি ঝরিয়ে। প্রদীপে তেল না দিলে যেমন আলো জ্বলে ওঠে না ঠিক তেমনি তেল না দিতে জানলে আমাদের জীবনের সাফল্যও ধরা দেয় না।
এই যে দেখুন, আমাদের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের। দলপ্রধানকে খুশী করতে, তাদের ভাষণে থাকে অধিকমাত্রায় তেল। উদাহরণও দেয়া যায়। নাম উল্লেখ না করেই উদাহরণ দেই। কিছুদিন আগে টিভিতে সংসদের আলোচনা দেখছিলাম।
এক সাংসদকে স্পিকার সাহেব সময় বরাদ্দ করলেন সাত মিনিট। সাংসদ ফ্লোর পেয়ে, দলের প্রতিষ্ঠাতা, দলের প্রধানের গুনকীর্তনে মেতে উঠলেন। হঠাৎ স্পিকার সাহেব বললেন, আপনার সময় শেষ মাননীয় সংসদ সদস্য। বলেই, মাইক অফ।
কি বুঝলেন? ঐ সংসদ সদস্য সংসদে গেছেন কেনো? তার এলাকার মানুষের দূর্দশার কথা সকলের সামনে তুলে ধরতে।
এবং দেশের ইস্যূ নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু তিনি কি তা করলেন? করলেন না। তিনি তাঁর দল এবং দলের প্রধানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন তৈল মার্কা কথা দিয়ে। যে তৈল পরবর্তী নির্বাচনেও কাজে আসবে। এলাকার মানুষ যাক জাহান্নামে তাতে ওনার কিচ্ছু আসে যায় না।
ওনার দরকার দলের প্রধানের কাছে আশ্রয়। আর তা কি এমনি এমনি পাওয়া সম্ভব? অবশ্যই না। তেল দিতে হবে। মিথ্যা প্রশংসা করতে হবে। ভুল হলেও বলতে জানতে হবে, আপনি যা করেছে তাই সঠিক।
এসব তৈলবাজে দেশটা ভরে গেছে। হানাদার গেছে। সৈরশাসক গেছে কিন্তু তৈলবাজগুলা রয়ে গেছে। যুগে যুগে তা বেড়েই চলেছে। সমাজের কোন স্তর বাদ আছে তৈলবাজ থেকে? রাজনীতি, সাহিত্য, শিক্ষা... সব জায়গায় তৈলবাজদের পদার্পণ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তো এদের বিচরণ ব্যাপক আকারে। শিক্ষার্থীদের তো রীতিমত প্রতিযোগিতা চলছে শিক্ষক পটানো নিয়ে। যে বেশী তেল দিতে পারবে তার ফলাফলও তত ভালো হবে। নিজের অল্প বয়স্ক অভিজ্ঞতা দিয়েই দেখি মেধাবীদের এই তৈলবাজ প্রবণতাটা একটু বেশী। ভালোর উপর ভালো ফলাফল চায় তারা।
গাছের সবচেয়ে উঁচুর ফলটাও যে তাদের চাই। এরাই তো একদিন সচিব হবে। এরাই তো একদিন দেশের সর্বোচ্চ জায়গায় নিজেদের নিয়ে যাবে। তখনও তৈলবাজ অভিজ্ঞতা দিয়ে এই দেশটাকে বিক্রি করবে। কারণ, এরা যে একদিন নিজেকে বিক্রি করেছে! দেশ বিক্রি করতে এদের খুব একটা সমস্যা হবার কথা না।
তাই তো বলতে চাই, এদের রুখো। এই তৈলবাজদের বিরুদ্ধে দাঁড়াও। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে কে? আছে কেউ? কেউ বিপ্লব করবে? বাঙালী বিপ্লব করতে ভুলে গেছে। আমাদের মধ্যে তো আর ফিদ্রেল কেস্ট্রো, চে গুয়াভারা নেই। বিপ্লব করবে কে?
তারপরও গুটি কয়েক মানুষ আছে তৈলহীন।
তাদের মাঝে তেল নেই। অন্যকে তেল দিয়ে সাফল্য অর্জন করবারও ইচ্ছে নেই তাদের। তারা জীবনকে অনুভব করে। তারা জীবনকে ভোগ করবার জন্য কাঁদে না। উপভোগ আর ভোগ দুটির মধ্যে যে বিস্তর ফারাক আছে তা তৈলবাজরা বুঝে না এবং যারা তেল খায় তারাও বুঝে না।
তারা নিজের প্রশংসা শুনে এবং বলে অভ্যস্থ। তাদের বিরুদ্ধে কেউ সোচ্চার হলে, তৈলবাজরা পিছে লাগে। এই জীবন উপভোগ করবার মানুষগুলো স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকে। তাদের কাছে স্বপ্নগুলো আকাশের তারার মতো। যে তারাকে কখনও স্পর্শ করা যাবে না কিন্তু তারাকে লক্ষ্য করে পথের সন্ধান পাওয়া যায়।
সেই সন্ধানেই তারা সন্তুষ্ট থাকে। তারা ভালোবাসে মানুষ, পাখির কিচিরমিচির। তারা ভালোবাসে সকালের সূর্য উঠা, ভালোবাসে শেষ বিকেলের সূর্যের ডুবে যাওয়া। ভালোবাসে বৃষ্টি। ভালোবাসে পৃথিবীর সমস্ত ভালোকে।
এমন ভালোবাসা কি আমাদের মাঝে আসবে? নাকি তেলবাজিতে কাটিয়ে দিতে হবে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর; এমনকি সারাটা জীবন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।