আমাদের ধর্ম, আমাদের সমাজ, আমাদের পরিবার ছোট বেলা থেকেই আমদের শেখায় সবসময় নিচের দিকে তাকাতে। মাটির দিকে চোখ নামিয়ে পথ চলা আমাদের উঠতি তরুণ-যুবার খুব ভালো লক্ষণ হিসেবে দেখা হয়। কে কত কম পেয়ে তবুও খুশি তাই উদহরণ দিয়ে দিয়ে দিয়ে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। নিজেকে বঞ্চিত করা, ত্যাগ স্বীকার করাকেই জীবনের স্বার্থকতা জানানো হয় আমার্দে । কম পেয়ে বা না পেয়েই সন্তুষ্ট হওয়াকে দেখা হয় মহান করে।
আমাদের পাঠ্য বইতে পড়ানো হয় ”একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে...”-এর মত নীতিকথা।
মাঝে মাঝে মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এসব হয়তো আমাদের মতো দেশ, জাতি বা পরিবারের জন্য আসলেই গুরুত্বপূর্ণ; এক জন আমার চেয়েও কষ্টে আছে, খারাপ অবস্থায় আছে, সেই তুলনায় আমি বরং ভালোই আছি--এ ধ্যান-ধারণা আমাদের পরিবার এবং সমাজে সত্য হলেও তা ধ্র“ব সত্য নয়। কেননা জীবনতো ঈড়সঢ়ধৎধঃরাব ঝঃঁফু নয় যে কারও তুলনায় আমাকে ভালো থাকতে হবে। পরীক্ষায় পাস মার্কস ৩৩-এ, কেউ একজন পনের পেল আর আমি বিশ পেলাম, তার মানেতো এই নয় যে আমি পাস করে গেলাম, যদিও তুলনামুলক বিচারে আমি তার চেয়ে আমি ভাল ছাত্র! কেউ একজন এসএসসি পাস করেছে, তার সাথে তুলনায় যদি আমি এইচএসসি পাস করে পড়ালেখা ছেড়ে দিই সেটা নিশ্চই ভালো কিছু নয়।
তাই মনটা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। আর আমাদের চাওয়াতো বিশাল কিছু নয়, তার পরও সেই চাওয়া পূরণ না হলেও মনকে সান্তানা দিয়ে বসে থাকাটা স্বাস্থ্যকার কিছু মনে হয়না আমার কাছে। কেউ একজন দুই বেলা না খেয়ে থাকে সেই তুলনায় আমি একবেলা না খেয়ে থাকি--এতে সন্তুষ্ট না হয়ে যদি আমি পরিশ্রম করে, সাধনা করে দৈনিক চারবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি সেটাইতো কাম্য হওয়া উচিৎ।
আর ত্যাগের ব্যাপারেও আমার কিছু মতামত আছে। ছোট ছোট সন্তান রেখে স্বামী মারা গেছেন, আমাদের দেশে অনেক নারী আছেন কেবল সন্তানের কথা চিন্তা করে আর কখনও বিয়ে করেন নি।
আমাদের দেশে এই অতুলনীয় ত্যাগ কে স্বাভাবিকই মনে করা হয়, বরং এর ব্যত্যায় ঘটলেই তা হয়ে যায় ’উদাহরণ’। এমন নারীর পায়ের কাছে আমি মাথা নত করতে পারি কিন্তু কখনই বলবো না এরকম পরিস্থিতিতে অন্য নারীরাও তাই করুক। আমি তাকে শ্রদ্ধা করতে পারি, কিন্তু প্রশংসা করতে পারি না। আমাদের জীবন কয়েকটা হলে একটা জীবন কাটিয়ে দিতাম ত্যাগে, একটা কাটাতাম শিক্ষা-সাধনায়, একটা শুধুই আলস্য-বিনোদনে। একটা কাটাতাম পিতা-মাতার নামে, একটা সন্তানের নামে আর একটা কেবলই নিজের জন্যে।
কিন্তু জীবন যেহেতু একটা, একজীবনেই সব কিছু করতে হবে। এজন্যেই আমি এইসব যাবজ্জীবন ত্যাগ, তিতিক্ষা আর মিছে সান্তনার ঘোরতর বিরোধী।
আর যেহেতু আমাদের সম্পদও সীমিত, তাই এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
যে চায়ের দোকানে আড্ডা দেই, মাসুদ টি-স্টল, রিক্সা ওয়ালারাও নিয়মিত চা খান সেখানে। মাঝে মাঝে দেখি দু একজন একটা রুটি নেয়, কেউ চায়ে ভিজিয়ে খায়, কেউ শুধু পানিতে ভিজিয়ে খায় ।
কখনও একটু চিনি চায়, মাসুদ ভাই কখনও দয়া করে দেয়, কখনও দেয় না, কেননা তাকেও একটা রুটি বেচা লাভে চিনির মূল্য সমন্বয় করতে হবে, কিন্তু সেই রিক্সাওয়ালাদের তৃপ্তি দেখে মনে একটা প্রশান্তি চলে আসে। সে রাতে যে কোন খাবারেই আমিও একটা বাড়তি তৃপ্তি পাই। মাঝে মাঝে খাবারে অরুচি আসলে আমি মনে করি কেভিন কার্টারের সেই সুদানি শিশুর কথা। ভালো রুচি পাওয়া যায়। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি, সেই যে তুলনামূলক ভালো থাকা--ইতিমধ্যেই রক্তে মিশে গেছে।
ইতিমধ্যেই আমরাও আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজের ছাচে গড়ে উঠতে শুরু করেছি।
কিন্তু আসলেই আমাদের চাওয়া খুব বেশী নয়, আমরা আসলেই অনেক অল্পতেও খুশী হতে পারি। দু-একটা উদহরণ দেব? পাবলিক বাসে এই গরমে ঠাসাঠাসি ভিড়ের মধ্যে এক হাতে খাবারের ব্যাগ আর আরেক হাতে কোনমতে হাতলটা ধরে ঝুলতে ঝুলতে প্রতিদিন অফিসে যাই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলা যে কী জিনিস তা আক্ষরিক অর্থেই টের পাই। তবু মাঝে মাঝে অফিসে যাবার পথে বাস থেকে নামি সব দু:খ-কষ্ট আর বঞ্চনা ভুলে।
কারণ? হয়তো যেই সিট টার পাশে দাড়িয়ে ছিলাম তাতে বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে বসেছিল!
কিংবা যেমন সে রাতে, সেদিন রাতে বেশ আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম। অনেক দিন যাবৎ ওডেস্কে লেগে ছিলাম, কিন্তু কোন কাজ পাচ্ছিলাম না। আমার সা¤প্রতিক জীবনে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল ওডেস্ক থেকে একটা ডলারও কামাতে না পারা। সেদিন আমি দুই ডলার রোজগার করতে পেরেছি! টাকার হিসেবে হয়তো মাত্র দেড়শ টাকা, কিন্তু আমার সাফল্যের হিসেবে তা শতভাগ।
ঘুমাতে যাবার আগে সামুতে একটু ঢু মারলাম।
একজন সহ ব্লগার সামুর সা¤প্রতিক ব্লাগিং এবং ব্লগারদের নিয়ে একটা আলোচনাধর্মী লেখা লিখেছেন। তিনি বেশ কয়েকজন ব্লগার-এর লেখা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। কে কেমন লিখছে, কারা ভালো করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষের দিকে ”এছাড়া আরও আছেন...” লাইনের শেষে আরও বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন। উত্তেজনা আর উৎকন্ঠা নিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎই একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম।
’এছাড়া আরও আছেন’ তালিকায় একদম শেষের দিকে নিজের নাম খুজে পেলাম! আমি ধন্য হয়ে গেলাম।
এরকম যখন ছোটখাট প্রাপ্তিযোগ হয় তখন খানিকটা সঙ্কুচিত হয়ে পরি, অস্বস্তিতে পড়ে যাই। অথচ ভিতরে ভিতরে মনে হয় এত এত অপ্রাপ্তির তালিকা বুকে নিয়েও এই বাংলাদেশে আরও পাঁচশত বছর বেঁচে থাকি। এটুকুই তো চাওয়া, এটুকু প্রাপ্তিতেই আমি খুশি, আমরা খুশি।
ভারত চন্দ্র রায়গুণাকরের ঈশ্বরী পাটনীর মতো আমাদের চাওয়া, স¤পূর্ণ তবে সংক্ষিপ্ত এবং সামান্য --আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।
.
.
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।