আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নানু’র কাছে ফিরে যাওয়া এক নিশুতি রাত

নানু’র শরীর খারাপ, দেখতে যাওয়া দরকার কিন্তু আমার কারণে যাওয়া আটকে গেছে। আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়েছে, ভাইবা যেদিন শেষ সেদিন সবাই মিলে রওনা হবো সিদ্ধান্ত নেয়া হল, সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা সবাই একত্রিত হবো টুটুল ভাইয়ার বাসায়। আমরা মানে আমরা তিন মামাতো-খালাতো ভাই আর দুই ভাগ্নে -- দলনেতা টুটুল ভাইয়ার নেতৃত্বে তখন আমাদের কাজ হচ্ছে বই পড়া, মুভি দেখা, গান শোনা, গান গাওয়া আর হুট-হাট যেখানে ইচ্ছে সেখানে চলে যাওয়া। বড়দের ভেতর আরেকজন আছেন মিঠু ভাই এবং তাঁরা বয়সে ঢের বড় হলেও আমাদের খুবই বন্ধু মানুষ; ভাগ্নে তন্ময় সবার ছোট, আরেক ভাগ্নে তমাল আর আমি কাছাকাছি বয়সী -- সব মিলে তুমুল হৈ-চৈ একটা দল।
হারানোর কোনকিছু থাকে না বলে পরীক্ষা আমার খুব প্রিয় বিষয়, জাহাঙ্গীরনগরে সবগুলো পরীক্ষা আমরা দিয়েছি ব্যাপক হৈ-চৈ করে কিন্তু অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় আমাদের হৈ-চৈ আর আনন্দ সবকিছু ছাড়িয়ে গেল (এখন ভাবতে গেলে অবাক হই এইরকম একটা সিরিয়াস পরীক্ষার সময় আমরা কিসব পাগলামি করেছি!) ভাইবা বোর্ডে একেকজন’কে বহু-সময় ধরে রাখা হচ্ছে, আমি এমনিতেই অস্থির, আরও অস্থির হয়ে গেলাম।

তিনটার ভেতর টুটুল ভাইয়ার বাসায় পৌঁছাতে হবে, তারপর সবাই মিলে রওনা দিবো কিন্তু এইভাবে চলতে থাকলে আমার দেরী হয়ে যাবে, বন্ধু’দের সে কথা জানাতে যেয়ে সবার চোয়াল ঝুলে পড়তে দেখলাম তারপর খেলাম রাম-ঝাড়ি! কার দু:খ কে বোঝে! একসময় ডাক এলো, বোর্ডে ঢুকলাম, যথারীতি প্রফেসর ড: নুরুল আলম ভ্রু কুঁচকে আমাকে দেখলেন, এমনকি অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার ভাইবা বোর্ডে-ও শার্ট-ইন (সে এক বিরাট ইতিহাস!) করে যাইনি দেখে তার কুঁচকে রাখা চোখ আরও কুঁচকে গেল। এক্সটারনাল হিসেবে এসেছিলেন প্রফেসর ড: বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আলম স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘এই একটা ছেলে তার যা পছন্দ সে তাই করে, ভাল পরামর্শ দিলে-ও শোনে না, পড়ালেখা করেনা, ক্লাস করেনা কিন্তু রেজাল্ট কিভাবে ভাল করে আমি বুঝতে পারিনা!’! মোটামুটি ভাল একটা পরিচয় দেয়া হয়েছে বলে আমি মেনে নিলাম কিন্তু তারপর আমার দিকে একটা ব্যাপক বক্র-চাহনি দিয়ে বললেন, ‘আমার কিছুই জিজ্ঞেস করার নেই, আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন। ’ প্রফেসর ড: বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর বহুক্ষণ আমাকে দেখলেন, তারপর জানতে চাইলেন, ‘এতবছর নৃবিজ্ঞান পড়ে কি শিখলেন আপনি?’ আমি তাকে জানালাম যে আমি কিছুই শিখতে পারিনি, তিনি থতমত খেয়ে গেলেন, আবার জানতে চাইলেন, আমি আবার-ও তাকে জানালাম যে আমি কিছুই শিখতে পারিনি। তিনি কিছু একটা বলতে চাইলেন কিন্তু আলম স্যার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওকে ছেড়ে দেন, এমন সব উত্তর দেবে যে মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে!’ জীবনে কোন কারণ ছাড়া বহু শত্রু তৈরি হয়েছে কিন্তু তাতে আমার জীবন থেমে থাকেনি, কাজেই আরও কিছুক্ষণ নিজের মত করে কথা বলে বের হয়ে ডেইরী-ফার্ম থেকে বাস ধরে সরাসরি সাইন্স ল্যাবরেটরি, তারপর বড় খালার বাসায় -- দেরী করে!
বড়খালা জানালেন যে সবাই চলে গেছে, ট্রেনে যাবে না বাসে যাবে তিনি কিছু জানেন না; লাভের ভেতর যা হল, তিনি জোর করে আমার পকেটে দুইটা একশ টাকার নোট দিয়ে দিলেন। চলে গেলাম কমলাপুর, জানা গেলো ‘মহানগর গোধূলি’ চলে গেছে।

চলে গেলাম গুলিস্তান, ভৈরব এর ডাইরেক্ট বাসে করে গেলাম ভৈরব, বাস-স্ট্যান্ড থেকে ট্রেন স্টেশনে; সন্ধ্যার লোকাল ট্রেন আছে, সেটাতে করে পাদানি’তে বসে বাতাস খেতে-খেতে, দেখতে-দেখতে যাওয়া’টা আমাদের সবার খুব পছন্দ। স্টেশনে যেয়ে আবার ধরা খেলাম; লোকজন’কে প্রশ্ন করে জানা গেল যে কয়েকটা ছেলে ‘মহানগর গোধূলি’ থেকে গিটার হাতে নেমে ব্যাপক ভাব-সাব দেখিয়ে আবার লোকাল ট্রেনে উঠে চলে গেছে। পরবর্তী ট্রেন, শেষ রাতের ট্রেন রাত মাঝরাতে। আবার গেলাম বাস-স্ট্যান্ড, জানা গেল বাস নেই, কিশোরগঞ্জের ডাইরেক্ট বাস আছে কিন্তু লাস্ট বাস ততক্ষণে চলে গেছে, লোকাল বাস আছে কিন্তু সেগুলোর কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। ততক্ষণে টের পেয়েছি ব্যাপক খিদে, দুপুরে খাওয়া হয়নি।

পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিতে হয়, হোটেলে যেয়ে পেট-পুরে খেলাম, রেস্তোরাতেই বসে থাকলাম দীর্ঘক্ষণ, রেস্তোরার মালিকের সাথে কথা বললাম, সাহায্য চাইলাম, তিনি নিশ্চয়তা দিলেন যে বাস এলে তিনি আমাকে সেটাতে উঠিয়ে দেবেন।
কতটা সময় কেটেছে জানি না, হুট করে একটা বাস এসে থামল, বলতে গেলে প্রায় সব যাত্রী নেমে গেল। রেস্তোরা মালিক জানালেন এই বাস কিশোরগঞ্জে যাবে, লোকাল বাস। বাসের ড্রাইভার নিজে এসে রেস্তোরা’তে বসলেন খেতে। মালিকের সাথে দেখলাম তাঁর খুব খাতির।

তাদের কথাবার্তায় একটা বিষয় স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে প্রয়োজন সংখ্যক যাত্রী না হওয়া পর্যন্ত বাস যাবে-না। মালিক আমাকে দেখিয়ে দিলেন, ড্রাইভার ভাই কোথায় যাব জানতে চাইলেন, বললাম। তিনি বললেন যে বাজিতপুর সরাসরি যাওয়া যাবে-না, আমাকে নামতে হবে ‘আগরপুর’ বলে একটা জায়গায়, সেখান থেকে রিকশা পেলে বাজিতপুর পর্যন্ত যাওয়া যাবে কিন্তু রাস্তা নিরাপদ নয়, ডাকাতের উপদ্রব আছে! সেই বাস একসময় ছাড়লো, জায়গায় জায়গায় থামতে থামতে যখন আগরপুর পৌঁছলাম ততক্ষণে রাত কয়টা বাজে জানি-না, আমার ঘড়ি পড়ার অভ্যাস কোনদিন-ই ছিল-না, বাস থেকে নামলাম আমি একা। রাস্তার দুইপাশে বেশ কিছু দোকান, একটা ছাড়া সব বন্ধ, দুইটা রিকশা দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু চালকেরা এতদূর যেতে নারাজ, বেশি ভাড়া দেবার প্রলোভনে যখন কাজ হল-না তখন তাদের ভেতর মায়া-মমতা বাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম, সব চেষ্টা বিফলে গেল। খুলে রাখা দোকানে হারিকেনের টিমটিমে আলোয় একজন বৃদ্ধ বসে আছেন।

গেলাম তাঁর কাছে, তিনি শুরু করলেন নাড়ী-নক্ষত্রের খোঁজ নেয়া। সবসময় শুনেছি গ্রামের মানুষ লতায়-পাতায় আত্মীয়, সেরাতে প্রথম তার উদাহরণ পেলাম, আমি আত্মীয়-স্বজন তেমন চিনি না কিন্তু তিনি ঠিকই খুঁজে বের করে ফেললেন যে আমার সাথে তাঁর দূ----র সম্পর্কের আত্মীয়তা আছে। তারপর তিনি একজন রিকশাচালক’কে ডেকে নিয়ে কি বললেন জানি-না, আমি শুধু টের পেলাম রিকশাচালক আমাকে নিয়ে যেতে রাজি!
নিশুতি রাত চন্দ্রাবতী নয়, রাস্তা এবড়ো-থেবড়ো। রিকশাচালক প্রায় চিৎকার করে কথা বলছে আমার সাথে আর বারবার বলছে, ‘আল্লা-খোদার নাম নেন, জুরে-জুরে কথা বলেন, ডেহাইতে (ডাকাত) জুরে কথা কইতে শুনলে কাছে আইতো-না’। ‘জুরে-জুরে’ কথা বলতে বলতে চলেছি, একসময় জহুরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজে’র সামনে আসতেই সাহস বেড়ে গেল।

নানুবাড়ী’র কাছে যখন নামলাম তখন চারপাশে কোন আলো নেই। ভাঙা একটা পুকুরপাড় ধরে যেতে যেতে হোঁচট খেলাম কয়েকবার। বাড়ীর কাছে আসতেই ভুত সাজতে ইচ্ছে করলো, ইচ্ছে’টা মাথায় আসতেই সমস্ত প্রাণশক্তি ফিরে পেলাম, আমি নিশ্চিত খুশী’তে দাঁত বের হয়ে গিয়েছিলো আমার! ম্যাচ জ্বেলে ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে শুরু করলাম ঢিল মারা, কোন লাভ হল-না। আবার একই কাজ করলাম, এইবার মনে হয় ঘুম ভাঙল কারও কারও! ততক্ষণে আমার হাতের ভেতর সমস্ত উদ্দীপনা চলে এসেছে, বাহির ঘরে ঢাকা থেকে আগত ‘ভাব-সাব’ দল আছে টের পেয়ে সেখানে ঢিল মারার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলাম, বাড়ীর ভেতর দোয়া-দরুদ পড়ার আওয়াজ পেলাম; তমাল ম্রিয়মাণ স্বরে বললো, ‘কে যেন ঢিল মারছে মিঠু মামা!’ মিঠু ভাই এইসব বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞানী, তিনি টের পেয়ে গেলেন, ‘তানিম’ বলে ডাকলেন, কিন্তু বাকি কেউ সেটা’কে বিশ্বাস করতে নারাজ বলে মনে হল। মেজ-মামা বের হয়ে এলেন, শক্তিশালী টর্চের আলো পড়লো এদিক-সেদিক কিন্তু আমি ততক্ষণে আরও আঁধারে চলে গেছি, বাহির ঘরের কোনায়।

তমাল আবারও কি-যেন বললো, আমি এইবার ঢিলের পাশাপাশি দুমদুম করে টিনের উপর ঘুসি মারলাম কয়েকটা, চারপাশ চুপচাপ হয়ে গেল পুরোপুরি -- তারপর নিজের উচ্ছ্বাস আর ধরে রাখতে না পেরে কখন যে ‘ওয়েএএএএ’ (এইটা ছিল আমাদের একটা কোড) বলে একটা চিৎকার দিয়েছি জানি-না, সেই চিৎকার শুনে প্রথমে মিঠু ভাই ‘তানিম আসছে, তানিম আসছে’ বলে জোরে চিৎকার করতেই বাড়িসুদ্ধ শুরু হয়ে গেল ব্যাপক হৈ-চৈ, দুম করে জ্বলে উঠলো সব বাতি, তারপর শুধু আড্ডা, গান আর আড্ডা...
আমরা গেলেই নানু সুস্থ হয়ে উঠতেন, সেবার-ও তাই হল। সবাই আমার এইসব পাগলামি মেনে নিয়েছে ততদিনে, এতো রাত করে আসার জন্য শুধু নানু’র কঠিন বকা খেলাম, সেই কাঠিন্যের আড়ালে তাঁর চোখে-মুখে যে আলো আর হাসি খেলা করে গেল সেটা দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত আজ কত বছর! একটা লাল টুকটুকে আশ্চর্য সুন্দর মুখ, এতো বয়স হয়েছে কিন্তু বয়সের বলিরেখা নেই কোথাও, হাসির ভেতর সনাতন বহুমাত্রিক সারল্য আর মমতা, এই এখন মনে পড়তেই মনে হল তিনি তাঁর পরম মমতামাখা হাত আমার মাথার উপর রাখলেন! প্রবল মানসিক শক্তিতে চারপাশ আলো করে রাখা এই মানুষটার পরম মমতাময়ী হাতের আদরে আদরে বড় হয়েছি আমরা, বড় হয়েছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সৌভাগ্যবান কিছু শিশু যারা একটা বিশেষ দিনের পর তাদের ‘বড় নানুমনি’কে খুঁজেছে বহুদিন... তারপর আর কোথাও কোন বৃহৎ বনস্পতি’র ছায়া নেই আলোকিত!

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।