মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় সর্বপ্রথম মানুষ যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিরলস সংগ্রাম করেছে, তা হচ্ছে গণতন্ত্র। আমাদের দেশেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল চেতনার অন্যতম ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। একাত্তর থেকে বর্তমান পর্যন্ত নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে প্রায় ৪২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এখনো আমরা একটা সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে সঠিক পন্থায় বিকশিত করতে পারিনি। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের পর্বতসঙ্কুল সমস্যা, দারিদ্র্য বিমোচন তথা সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ আজ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
জাতি হিসেবে আমাদের একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে; বিশাল এক ত্যাগের মহিমা আছে। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর কোনো জাতিগোষ্ঠীর এত ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর হয়নি, যা আমাদের ক্ষেত্রে হয়েছে।
১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের পর প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র আজ নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা জাতি-রাষ্ট্র গঠন করার জন্য যে কোনো একটা সংগ্রাম বা আন্দোলনই যথেষ্ট।
একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পরবর্তী সময়ে নব্বই সালেও একইরূপ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদ্বয় যথাক্রমে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে সেরকম ঐকমত্য আমরা দেখতে পেয়েছিলাম এবং পরবর্তী সময়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে প্রত্যেক দলই দুবার করে বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। মনে হয়েছিল গণতন্ত্র সঠিক ও সুস্থ ধারায় ফিরে আসবে। শুরুটা হয়েছিলও ঠিক সেভাবেই। কিন্তু রাজনীতির ধারক-বাহকদের অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথ আবার ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একটা সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি দেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
গণতন্ত্র এখন চরমভাবে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
বিশেষ করে পেছনে ফিরে তাকালে নবম সংসদ নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গণতান্ত্রিক নর্মসকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারকে সব ধরনের সাহায্য করার মানসিকতা নিয়ে চমৎকার এক বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অসহিষ্ণু, অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে দুই নেত্রীর মধ্যে সম্পর্কের ক্রমাবনতি হয়েছে। ফলত ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আবার এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয়েছে। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তৈরি হয়েছে বিভাজন।
কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সব দল এবং জনমতের প্রতিফলন ঘটবে, সে বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা না করে, অযথা কালক্ষেপণ করছে। জাতীয় নির্বাচনের পদ্ধতিটি সুরাহা না হওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। পরস্পরের মধ্যে দোষারোপের রাজনীতি শুরু হয়েছে, যা আদৌ কাম্য নয়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমগ্র শ্রেণী-পেশার মানুষসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা পর্যন্ত এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানালেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
অধিকন্তু বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক ছাড়াও জাতিসংঘের মহাসচিব দুই নেত্রীকে সংলাপের মাধ্যমে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করার মানসে একটা জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন।
তার পরও সরকার থেকে তেমন গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। অথচ সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার অভিভাবক হিসেবে এটা মূলত সরকারেরই দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে, একটা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর তার আঞ্চলিক নিরাপত্তার সম্পর্ক জড়িত থাকে।
ইদানীং প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো_ বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো নির্বাচিত সরকার ও সংবিধানের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন হবে।
পক্ষান্তরে বিরোধীদলীয় নেতা বলছেন, নির্দলীয়-তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সে নির্বাচনে তারা যাবেন না। উভয়ের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে নিরাসক্ত মন নিয়ে বলা যায়, বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উভয় দলের মধ্যে যেখানে চরম আস্থার সংকট বিদ্যমান সেখানে অতি আবশ্যিকভাবে দেশ তথা দেশের মানুষের স্বার্থে জাতীয় নির্বাচনের একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে পেঁৗছানো প্রয়োজন। কেননা সত্যি বলতে গেলে, আমাদের দেশ এখনো পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আদলে গড়ে ওঠেনি। এমনকি পাশর্্ববর্তী দেশ ভারতের শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের মতো আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনও তেমন নয়। সব সরকারের আমলে তারা কোনো না কোনোভাবে বিতর্কিত হয়েছে।
স্বাধীন, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে তারা সার্বিক দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হয়েছে। আবার বিরোধী দল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলে দল-নিরপেক্ষ সরকারের যে দাবি করছে_ তা কোনোভাবেই অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক নয়। বরং এ ক্ষেত্রে তারা অনেক সহনশীলতার পথে ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবি আদায়ের পথ বেছে নিয়েছে। হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট, ঘেরাও ইত্যাকার সহিংস ও ধ্বংসাত্দক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, সম্মেলনের মাধ্যমে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা নিয়েছে, যা সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তন হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
পক্ষান্তরে সরকারও যে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে না, তা কিন্তু নয়।
সরকারকেও বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে বা ভাবা উচিত। জনমতের গুরুত্বকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কেননা জনমতকে উপেক্ষা করলে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়বে বই কমবে না। সরকারের জনপ্রিয়তায়ও ধস নামবে। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী এবং সর্বশেষ গাজীপুর সিটি মেয়র নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটেছে।
এরপরও যদি সরকারের বোধোদয় না হয়, তাহলে করুণ পরিণতি তাদের ভোগ করতে হবে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে, সবাইকে আজ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ কথা সত্য যে, প্রবীণদের দেখে কিন্তু নবীনরা শেখে। তাই নতুন নেতৃত্ব তৈরি করার মানসে হিংসা-দ্বেষ ও ঔপনিবেশিক মানসিকতার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে একে অপরের মতামতকে গুরুত্ব ও স্বাগত জানাতে পারলেই রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন সম্ভব হবে, নচেৎ নয়। ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থের উপরে জনস্বার্থকে প্রাধান্য না দিলে যত বড় দলই হোক না কেন, জনগণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে এটা অনুধাবন করতে হবে যে, এ দেশের সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া কিন্তু খুব বেশি নয়। তদুপরি তারা রাজনৈতিক সচেতনও বটে। সে ক্ষেত্রে যারাই সরকারে থাকবে তাদের দলীয় অন্ধ আনুগত্য, স্বজনপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, দলীয় মস্তানি, টেন্ডারবাজি, দলীয়ভাবে পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহারের প্রবৃত্তি থেকে বেরিয়ে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার দ্বারা সর্বসাধারণের জন্য মৌলিক পরিবর্তন সাধন করতে হবে। কেননা সুষ্ঠু রাজনৈতিক ব্যবস্থাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এ পরিপ্রেক্ষিতে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে সবার মতামতকে সম্মান প্রদর্শন করে আগামী ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা হবে সরকারের প্রধান কাজ।
সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের 'ক' উপ-ধারায় বলা আছে, সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন করতে হবে। একই সঙ্গে 'খ' উপ-ধারায় বলা হয়েছে, সংসদের মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের উভয় অপশন অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠান নির্ভর করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ওপর। তাই এই জটিল পরিস্থিতিতে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে গেলে জাতীয় ঐকমত্য দরকার।
কোনো বৃহৎ দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে গেলে সে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হবে। কেননা এ দেশটি কোনো একক দল, গোষ্ঠী বা পরিবারের নয়। দেশটি সবার। বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। এ দেশের মানুষ সব কিছু সহজ-সরলভাবে দেখতে ভালোবাসে; মারপ্যাঁচ, জটিলতা-কুটিলতা বোঝে না।
বরং অতীতে দেখা গেছে, যারা এ ধরনের কাজ বেশি বেশি করে, শেষ পর্যন্ত মানুষ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
বস্তুত অফুরন্ত সম্ভাবনার দেশ এই বাংলাদেশ। একদিকে যেমন রয়েছে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অপরদিকে রয়েছে এক বিশাল মানবসম্পদ। যাকে ইচ্ছা করলে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা ও কর্ম-উদ্দীপনার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব। কাজেই এসব বিবেচনায় বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে।
সরকারকে অনুধাবন করতে হবে, জনগণ যদি জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তায় ভোগে তাহলে মানুষের কাছে তারা আরও অপ্রিয় হয়ে উঠবে। তাদের সব সম্ভাবনা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিষয়টি অনেকাংশে সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। সেই সঙ্গে পক্ষপাতহীন নির্বাচন ব্যবস্থা করলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অনিবার্য সংঘাত বা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে, দেশে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা ব্যাহত হবে।
তা ছাড়া এ বিষয়ে তথা নির্বাচন পদ্ধতি ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য উভয় দলকে সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করে সমঝোতার মাধ্যমে একটা পরিপূর্ণ-স্থায়ী ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে। জনগণ সে প্রত্যাশাই করে।
পরিশেষে বলা যায়, একে অপরকে দোষারোপ নয়; গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো আলাপ-আলোচনা, সংলাপ, একে অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া, জনকল্যাণমূলক মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন, গুম-হত্যা, নির্যাতন, জনতার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া নয়; বরং নৈরাজ্যকর, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা থেকে সহনশীল, সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ চর্চার লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা। সবাইকে বুঝতে হবে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড় আর দলের চেয়ে দেশ বড়।
দেশকেই সবার উপরে স্থান দিয়ে দল-মত-নির্বিশেষে সহাবস্থানের মাধ্যমে ঐক্যের রাজনীতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি।
ই-মেইল : kirondebate@gmail.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।