আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল
গত শীতে অফিসের কাজে আমাকে এবং আমার এক সহকর্মীকে ভারত যেতে হবে শুনে, ভারত এবং ভারতীয়দের নিয়ে থাকা “খেয়ে এসেছেন না গিয়ে খাবেন” জাতীয় প্রচলিত কথাগুলো জানা থাকার কারণেই হয়ত একটু অস্বস্তিতেই পড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছিল আমাদের কোম্পানিটির ভারতের অফিস। ভয়টি ছিল সেখানেই!
যাহোক ঠিক হলো ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে করে প্রথমে আমরা কোলকাতা যাব। তারপর সেখান থেকে দিল্লী। দিল্লীকে কেন্দ্র করে পাঞ্জাব ও বোম্বে যাওয়ারও পরিকল্পনা করা হলো।
নির্ধারিত দিনে কোলকাতা অবতরণ করলাম নিরাপদেই। বিমানবন্দরের বাইরে এসে দেখি একটি চকচকে গাড়ি নিয়ে সেখানে অপেক্ষা করছে আমাদের কোলকাতা অফিসের একজন বাঙালি সহকর্মী। গাড়িটি দেখে আমার ভেতরে থাকা অস্বস্তি অনেকটাই কমে গিয়েছিল। মনে মনে মানুষ টানা রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম বোধহয়! তবে আমরা হয়ত একটু তাড়াতাড়িই বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম; তাই যখন দুপুরের খাবার খাওয়ানোর জন্য আমাদের একটি ফাইভ স্টার হোটেলের বিলাসবহুল রেস্তোরায় নিয়ে যাওয়া হলো, তখন তো রীতিমত ভিরমি খাবার জোগাড়! আমরা তো আরও ভাবছিলাম খাবারটা বোধহয় নিজেদেরই কিনে খেতে হবে; তাই বাঙালী কলিগটিকে গাড়িতে উঠার পর থেকে ডলার ভাঙ্গানোর দোকান খুঁজে দিতে বলছিলাম বারবার। আমাদের মনোভাব সম্পর্কে কিছুটা হলেও সে হয়ত আঁচ করতে পেরেছিল আর তাই রাস্তায় আমাদের এটা ওটা দেখাচ্ছিল সে ঠিকই কিন্তু বিকেলের আগে মানি এক্সচেঞ্জের দোকানটা সে দেখিয়ে দেয়নি।
আসল কোলকাতার সাথে, কোলকাতা সম্পর্কে আমাদের ধারণার পার্থক্য ছিল আকাশপাতাল! আমরা আসলেই এমন আধুনিক, ভিড়ভাট্টাবিহীন কোলকাতা আশা করিনি, যদিও জানতাম ওরা অনেক এগিয়ে গেছে। যাহোক, ভরপেট খেয়ে কোলকাতার বাঙালী সহকর্মীটিকে মুখে ও মনে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে সন্ধ্যায় চড়ে বসলাম ইন্ডিগোর দিল্লিগামী একটি উড়ালে। পরের দিন দিল্লী অফিসের আন্তরিক পরিবেশে অত্যন্ত ব্যস্ত কিন্তু চমৎকার একটি দিন কাটিয়ে পরের দিন বাই-রোডে গেলাম পাঞ্জাবের চণ্ডীগড়। প্রায় সাড়ে তিনশ কিলোমিটার পথ আমরা চার কি সাড়ে চার ঘণ্টায় পাড়ি দিয়েছিলাম একটি ১৫০০ সিসির নিশান গাড়িতে চড়ে। ফসলের মাঠে মোড়ানো ঐশ্বর্যমণ্ডিত পাঞ্জাবে দুটো অফিস ঘুরে রাত প্রায় বারোটার দিকে আমরা দিল্লী ফিরে এলাম।
দীর্ঘ যাত্রায় এক মিনিটের জন্যও কোথাও জ্যামে পড়তে হয়নি। এত চমৎকার ডিভাইডার দেয়া সড়ক যে রাস্তার পাশের ‘ধাবা’ গুলোয় ঘুম পাড়িয়ে দেয়া অভাবনীয় প্রশান্তির ও স্বাদের লাচ্ছি বা এটা-সেটা খাওয়ার জন্য যে কয়বার গাড়িটি থামাতে হয়েছিল, শুধু সে কয়বারই চালককে বাধ্য হয়ে গাড়িটির গতি একশ মাইলের নিচে নামিয়ে আনতে হয়েছিল।
পাঞ্জাব থেকে দিল্লী ফিরে আসার পরের দিন আমাদের যেতে হলো বোম্বে; আজকের মোম্বাই। ইন্ডিগোর আধুনিক উড়োজাহাজটি যখন সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে বোম্বের রানওয়েটির দিকে ধীর-স্থির ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার জানালায় শহরটির যে দৃশ্য ফুটে উঠেছিল তা দেখে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া স্বত্বেও আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম! আমি বস্তি দেখেছি অনেক কিন্তু বস্তি দ্বারা নির্মিত প্রাসাদ দেখিনি, পাহাড় দেখিনি! স্তরে স্তরে সাজানো হাজার হাজার ছোট ছোট অস্থায়ী ঘর কিংবা ছাউনির সমন্বয়ে তৈরি যেন একটি নোংরা পাহাড়ের দেয়ালে ঘেরা শ্বাসরুদ্ধকর বলিউড-খ্যাত চাকচিক্যময় বোম্বে! উড়োজাহাজটি ধরা-পৃষ্ঠের আরও কাছাকাছি নেমে এলে বস্তির পাহাড়টি যেন এবার জানালায় উঁকি দিয়ে আমাদের মতো বিস্মিত যাত্রীদের সংবর্ধনা জানাল। শহরটি জুড়ে শত শত আধুনিক সুউচ্চ ইমারতও দাঁড়িয়ে ছিল বটে, কিন্তু দাঁত মেলে থাকা বস্তির পাহাড়ের কাছে সেগুলো নিতান্তই ম্লান, প্রায় বিপন্ন হয়ে ছিল।
বোম্বের কাজ সেরে ঐ দিনই সন্ধ্যার ফ্লাইটে দিল্লী ফিরে এলাম। পরের দিনটি আমরা ফাঁকা রেখেছিলাম দিল্লীর আশপাশটা ঘুরে দেখার জন্য। ভাগ্যক্রমে দিল্লীর আশপাশেই ছিল আগ্রার অবস্থান! তাই হয়ত দিল্লী অফিসের একজন সহকর্মী আগ্রা নিয়ে গিয়ে আমাদের তাজমহল দর্শন করিয়ে আনার সুবন্দোবস্ত করে রেখেছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক পরের দিন খুব ভোরে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমরা খোলা প্রান্তরের মতো ফাঁকা সদ্য নির্মিত চমৎকার এক্সপ্রেস হাইওয়ে ধরে ছুটে চললাম তাজমহল খচিত আগ্রার উদ্দেশ্য। সুন্দর ছিমছাম পুরনো ঘ্রাণে ভরা শহর আগ্রা।
সেখানে তাজমহল দেখার আগে লালকেল্লা ঘুরে দেখাল একজন গাইড। দুর্লভ পাথর দিয়ে তৈরি রাজকীয় যে আসনটিতে বসে শাহজাহান দূর থেকে তাজমহলের অনুপম সৌন্দর্য উপভোগ করতেন, সে জায়গাটি থেকে আমরাও সেদিন শাহজাহানের হয়ে কুয়াশায় ধূসর কিন্তু অপরূপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা তাজমহলকে ‘অবলোকন’ করলাম। লালকেল্লা ঘুরে দেখা শেষ করে তারপর আমরা চললাম তাজমহলকে কাছ থেকে দেখার জন্য। দুর্ভাগ্যক্রমে দিনটি রবিবার হওয়ায় অসম্ভব রকম ভিড় ছিল সেদিন। অবশ্য সে কারণে বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাবও ছড়িয়ে ছিল চারিদিকে! একটা নির্দিষ্ট জায়গার পর থেকে মোটর চালিত যান ঢোকা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে ওখান থেকে তাজমহল পর্যন্ত রাস্তাটায় চলে ঘোড়া এবং উট টানা গাড়ি।
আবার ব্যাটারি চালিত গাড়িও আছে। তারই একটিতে চড়ে আমরা বেশ খোশমেজাজে চললাম অবশেষে তাজমহল দর্শনে।
কিন্তু তাজমহলকে ঘিরে রাখা উঁচু বেষ্টনীর ভেতরে ঢোকার ফটকগুলোর পেছনে অস্থির লাইনগুলোর আকার দেখে, ‘তীরে এসে তরী ডুবে’ কি না, সেই আশঙ্কায় আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম! ভাগ্য ভালো ছিল যে সঙ্গ দিতে আমাদের একজন ভারতীয় কলিগ গিয়েছিল আমাদের সাথে। সে’ই কিভাবে যেন জেনে নিয়ে মূল ফটকটি দিয়ে না ঢুকে ঘুরে অনেকের অজানা পেছনের দিকের একটি ফটক দিয়ে আমাদের তাজমহলের চৌহদ্দির ভেতরে ঢোকানর ব্যবস্থা করল। এ স্বত্বেও ঢুকতে গিয়ে বেশ বড়সড় একটি লাইনে আমাদের দাঁড়াতে হয়েছিল।
লাইনে যখন দাঁড়িয়েছিলাম, ব্যথায় পাগুলো আমাদের টনটন করছিল। আর ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে করা দীর্ঘ যাত্রায় আমরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ভেতরে ঢুকে আমাদের যখন তাজমহলের অনিন্দ্য সুন্দর রূপের সম্মুখীন হতে হলো, আমাদের সব ক্লান্তি, ব্যথা-বেদনা-কষ্ট, সব নিমিষে কোথায় যে হারিয়ে গেল, আমরা তার ঠাহরও পেলাম না! আমরা তিনজন (ভারতীয় সহকর্মীটিও আমাদের সাথেই প্রথম তাজমহল দেখতে গিয়েছিল। মক্কার মানুষ হজ্জ পায় দেড়িতে!) হা করে দাঁড়িয়ে রীতিমত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম তাজমহলের দিকে। এই শুভ্র সুন্দর স্থাপনাটিকে উপমায়িত করার ক্ষমতা আমার নেই।
তাই তার সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা দিতে আমি অপারগ। সম্বিত ফিরে পেলে ছবি তুলতে তুলতে যেন পাগল হয়ে গেলাম আমরা!
টেলিভিশন কিংবা ছবিতে দেখা তাজমহল আর এই তাজমহল এক নয়। তাজমহলের পেছন দিকে বয়ে গেছে একটি নদী। তার ওপারে ছোট্ট একটি বনের মত। মুগ্ধ হয়ে আমার হাতের ভিডিও ক্যামেরাটি দিয়ে সেই দৃশ্য শুট করতে গিয়ে আমাকে আবার শুনতে হল সতর্কবাণী।
ভেতরে নাকি ভিডিও করা নিষেধ! করলে নাকি ৫০০০ রুপি জরিমানা! তা বেশ। তার আগেই বেশ কিছুক্ষণ চালু রেখে ভিডিও ক্যামেরার স্মৃতিতে পুড়ে নিয়েছিলাম অপূর্ব সে দৃশ্য।
সারাটি দিন সেখানে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাটিয়ে সন্ধ্যার দিকে রওয়ানা হয়ে যেতে হলো ফের দিল্লীর উদ্দেশে। পরের দিন জেট এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজে চড়ে যখন ঢাকায় ফিরে এলাম, তখনও আমার মাথা থেকে তাজমহল দেখার মুগ্ধতার আবেশ কেটে যায়নি। ভারতের বেশ কয়েকটি শহরে প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে তুমুল ঘুরে আসা স্বত্বেও আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন শুধু এক তাজমহল দেখে এলাম! একটি মনুষ্য নির্মিত ভবন যে আমাকে এতটা মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে, তাজমহলের দেখা না মিললে, কোনো দিন আমি তা স্বীকার করতাম না।
http://www.notun-din.com/?p=8244
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।