রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে খাতওয়ারি বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। ক্ষমতার শেষ সময়ে বেশ কিছু স্পর্শকাতর এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে সরকারের শীর্ষ মহল। কয়েকটি বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বিঘ্ন রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নির্ধারণ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যাতে কঠোর আন্দোলন ও সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বাস্তবায়ন নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলার প্রতিও নজর রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া পদোন্নতি ও বঞ্চনা নিয়ে জনপ্রশাসনে অসন্তোষ, মজুরি বাড়ানোর দাবি নিয়ে তৈরি পোশাকশিল্পে বিশৃঙ্খলা এবং শিক্ষাঙ্গনে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির ব্যাপারে সরকার সতর্ক রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আন্দোলন ও নাশকতা রোধে প্রতিরোধমূলক আগাম ব্যবস্থা নিতে সরকারি দল আওয়ামী লীগও কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছে। এরই মধ্যে রাজধানীর সব কটি নির্বাচনী এলাকায় প্রায় ১ হাজার ৭০০ কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের নৈরাজ্য ঠেকাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ঢাকা মহানগরের এমপিরাও আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নিষ্ক্রিয় নেতাদের সক্রিয় করা হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ শুধু রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায় সক্রিয় থাকবে বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক আন্দোলন : প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ২৪ অক্টোবর থেকে দেশ অচল এবং সারা দেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ পরিস্থিতি এড়াতে রাজনৈতিক কর্মসূচি চূড়ান্ত করেছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ।
কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী দলের নিষ্ক্রিয় নেতাদের সক্রিয় করা হচ্ছে। এ ছাড়া রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় কট্টরপন্থি বিএনপি নেতাদের প্রতিও নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। বিএনপি যাতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে ঢাকা বিচ্ছিন্ন করার মতো কোনো কর্মসূচি সফল করতে না পারে সেদিকেও সতর্ক রয়েছে সরকার। এদিকে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির প্রভাবিত এলাকাগুলোয় নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর যে ১৯ জেলার ৪২টি স্পটে তারা সহিংসতা চালায় সেসব এলাকায় মনিটরিং জোরদার করা হচ্ছে।
সরকারের বাকি সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে রায় বাস্তবায়নে যাতে জামায়াত-শিবির বড় রকমের আন্দোলন ও সহিংসতা না ঘটাতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের সারা দেশের নেতাদের প্রতি দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।
জনপ্রশাসন : সচিবালয়সহ জনপ্রশাসনে নিয়োগ, পদোন্নতি, বঞ্চনা নিয়ে যাতে কোনো আন্দোলন গতিশীল হতে না পারে সেদিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে যাতে কোনো সভা-সমাবেশ, লিফলেট বিতরণসহ উসকানিমূলক কার্যক্রম না ঘটতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সচিবালয়ে নজরদারি জোরদার করেছে।
এ ক্ষেত্রে অতীতে সচিবালয়ের বিভিন্ন আন্দোলনের ক্ষেত্র ও দৃষ্টান্ত বিবেচনায় রাখছে সরকার।
শিক্ষা খাত : ক্ষমতার শেষ সময়ে ক্যাম্পাস দখলের পালাবদলে যাতে শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তিসহ বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাজপথের আন্দোলন যাতে বেগবান না হতে পারে সেদিকে আগে থেকেই নজর রাখা হচ্ছে। এরই মধ্যে সরকার ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে। এসব স্কুলের প্রায় ১ লাখ ৪ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণের কাজ আগামী অক্টোবরের মধ্যেই সম্পন্ন করার চেষ্টা চলছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষক দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। সে দাবি বাস্তবায়নের ব্যাপারেও সরকার সহানুভূতিশীল। এরই মধ্যে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, ঘরভাড়া, মেডিকেল-ভাতা দ্বিগুণ হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ঘোষণা আসবে। সব মিলিয়ে শেষ সময়ে সরকার শিক্ষাঙ্গনকে আন্দোলনের উত্তাপমুক্ত রাখতে চায়।
পোশাকশিল্প : তৈরি পোশাকশিল্প খাতে কয়েক দিন ধরে বিশৃঙ্খল পরিবেশের কারণে শত শত কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন যাতে সেক্টরের কাজের পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে সেদিকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৈরি পোশাকশিল্পের সার্বিক পরিবেশ নিরবচ্ছিন্নভাবে মনিটর করছে। সরকার এরই মধ্যে নভেম্বরের মধ্যে গার্মেন্ট সেক্টরে নূ্যনতম মজুরি ঘোষণার কথা জানিয়েছে। পোশাকশিল্পের আন্দোলনে যাতে রাজনৈতিক ইন্ধন যোগ হতে না পারে সেদিকে কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে।
পোশাকশিল্প এলাকার বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের গতিবিধির প্রতিও নজর রাখা হচ্ছে। এ সেক্টর শান্ত রাখতে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ তৎপর রয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের শেষ সময়ে জানমাল রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে। রাজনীতি ও ধর্মের নামে যারা অরাজকতা সৃষ্টি করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশনা দেওয়া আছে। তিনি বলেন, যে পর্যায়ে তারা আক্রমণ চালাবে সেই পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মেধা, কৌশল এবং শক্তি প্রয়োগ করে তাদের মোকাবিলা করবে।
দেশের জনগণ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বিশৃঙ্খলাকারীদের প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত রয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেন, আগামী দিনগুলোয় বা জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাটাই হলো আমাদের চ্যালেঞ্জ। আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি রয়েছে। আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে বদ্ধপরিকর। কেউ যদি কোনো অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, কঠোরভাবেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পুলিশপ্রধান বলেন, পুলিশের প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেমের চেতনা নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। পুলিশ বাহিনীর মৌলিক প্রশিক্ষণ রয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা সদাপ্রস্তুত। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার হাবিবুর রহমান বলেন, র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
ধর্মের নামে বা জঙ্গি সংগঠনগুলো যেন কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে না পারে, সে বিষয়ে র্যাব সদস্যরা তৎপরতা বাড়িয়েছে। নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার আগেই সেসব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে র্যাব সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় প্রস্তুতি নিয়ে গতকাল পুলিশ সদর দফতরে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকারের সভাপতিত্বে সভায় মানুষের জানমাল নিশ্চিত করতে সচেতন ও সতর্ক থেকে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়। বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আইজি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করে কোনো অশুভ চক্র যাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে না পারে সে জন্য সজাগ থাকতে হবে।
কোনো ধরনের গুজব ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে কেউ যাতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে না পারে সে বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
সভায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের ঊধর্্বতন কর্মকর্তা, এসবির অতিরিক্ত আইজিপি, সিআইডির অতিরিক্ত আইজিপি, সব পুলিশ কমিশনার ও রেঞ্জ ডিআইজি, র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, আনসার, ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।