কঠোর আদেশ, শাস্তিভীতি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরদারি সত্ত্বেও পুলিশে বিশৃঙ্খলা থামছেই না। দিন দিনই অসদাচরণ, চাকরিবিধি লঙ্ঘন, শৃঙ্খলা বিনষ্টসহ অপরাধমূলক নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপি কমিশনারের কঠোর খবরদারিত্ব পাশ কাটিয়ে অপরাধী পুলিশের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, হরতাল-অবরোধের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে দলবাজ পুলিশ সদস্যরা আরও বেশি অপরাধে মেতে উঠেছেন। অথচ বরাবরই তারা থাকছেন বিভাগীয় শাস্তির আওতার বাইরে।
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, গত তিন মাসেই অসদাচরণ, কর্তব্যে চরম অবহেলা, চাকরিবিধি লঙ্ঘন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ অমান্য করাসহ বিশৃঙ্খলামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকাসংক্রান্ত পাঁচ শতাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ কনস্টেবল থেকে শুরু করে এএসআই, এসআই ও ইন্সপেক্টর পদবির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগের মাত্রা বেশি। তবে বিভাগীয় পর্যায়ে নানা রকম তদন্ত প্রতিবেদন, পদস্থ কর্মকর্তার বিশেষ নোট প্রদান, সুপারিশ চালাচালি হলেও কারও বিরুদ্ধে শাস্তি দেওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ফলে চাকরিবিধি লঙ্ঘনসহ শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।
রাজধানীর আটটি অপরাধ বিভাগে সংশ্লিষ্ট উপ-পুলিশ কমিশনারদের দফতরে আরও ৭০০ অভিযোগ মাসের পর মাস ফাইলবন্দী পড়ে আছে।
সেসব ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট উপ-পুলিশ কমিশনাররা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। ডিএমপির গুলশান বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনারদের দেওয়া অর্ধ শতাধিক তদন্ত প্রতিবেদনও আর আলোর মুখ দেখছে না। সেখানে একজন সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) নিজের কোমরের বেল্ট খুলে তারই অফিসার ইনচার্জকে (ওসি) লাঞ্ছিত করেও বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন। এমনকি লাঞ্ছিত ওসিকেই আত্দসম্মান বাঁচাতে বদলি হয়ে চলে যেতে হয়েছে। এডিসির লিখিত নির্দেশ অমান্য করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ান দারোগারা।
কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশগুলো উপ-পুলিশ কমিশনারের দফতরেই বস্তাবন্দী করে ফেলে রাখা হচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের মধ্যে ক্ষোভ, আক্ষেপ আর হতাশার ছড়াছড়ি।
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনে 'বেসামাল পুলিশ' শিরোনামে শীর্ষ সংবাদ প্রকাশের পর পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপি হেডকোয়ার্টারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের টনক নড়ে। এ ব্যাপারে সাত দফা নির্দেশনা দিয়ে দেশের সব স্থাপনায় দাফতরিক চিঠিও পাঠানো হয়। চিঠিতে পিআরবি অ্যাক্ট যথাযথ অনুসরণ করা, সরকারি যে কোনো আদেশ দ্রুততার সঙ্গে প্রতিপালন করা, আদালতের আদেশ-নির্দেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া, বিশৃঙ্খলামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনার কথা উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তু এর পরও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো নজির দেখা যাচ্ছে না।
অতিসম্প্রতি গুলশান বিভাগভুক্ত ভাটারা থানার এসআই মতিউর রহমান শরীফ নিজের কোমরের বেল্ট খুলে ওই থানারই ওসিকে লাঞ্ছিত করেন। লাঞ্ছিত ওসি রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে অন্যত্র বদলি হয়ে যান। ওই এসআই ১৮-দলীয় জোটের হরতাল চলাকালে ঘুমন্ত কনস্টেবল বিজন দাসের (মুন্সী) ওপর চড়াও হন এবং তার বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি করতে উদ্যত হন। এ সময় অন্য পুলিশ সদস্যরা তাকে নিরস্ত করায় প্রাণে রক্ষা পান বিজন।
গুলশান ডিসি দফতরের একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এসআই মতিউর রহমান শরীফ এডিসি-ডিসির সরকারি আদেশও অমান্য করেন অহরহ, তবু তাকে বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ অমান্য করার ক্ষেত্রে এসআই মতিউর রহমান শরীফকেও হার মানিয়েছেন শাহজাহানপুর থানার ওসি (তদন্ত) আবু দাউদ আহমেদ, অপারেশন অফিসার দিদারুল ইসলাম, মুগদার অপারেশন অফিসার মাহবুব মোর্শেদ, এসআই মোখলেসুর রহমান, কাফরুলের ওসি (তদন্ত) আতাউর রহমান, অপারেশন অফিসার তানভীর হোসেন, কোতোয়ালি থানার অপারেশন অফিসার রফিকুল ইসলাম, মিরপুরের অপারেশন অফিসার আফজাল হোসেন, তেজগাঁও থানার এসআই মাহফুজুল হক ভূইয়া, শেরেবাংলানগর থানার অপারেশন অফিসার আবু জাফর আহমেদ, ওয়ারীর অপারেশন অফিসার আবুল হাসান ভূইয়া এবং ক্যান্টনমেন্ট ও মিরপুর থানার ওসি দুই সালাহউদ্দিনসহ অর্ধশতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা। এদের মধ্যে আদালতের কড়া আদেশকেও তোয়াক্কা না করার নজির রয়েছে। মতিঝিল থানার এসআই মাহবুবুর রহমান সিএমএম কোর্টের আদেশ অমান্য করে একজন ভিকটিমের গাড়ি নিজের দখলে রাখেন, অবশেষে আদালত ওই এসআইর নামে ওয়ারেন্ট জারি করেছেন।
কর্তব্যে অবহেলা, চরম অদক্ষতা-অযোগ্যতা দেখানোর অভিযোগে বনানী থানা থেকে সরিয়ে দেওয়া এসআই সৈয়দ আলমগীরকে আরও গুরুত্বপূর্ণ থানা গুলশানে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে।
১৫ দিন আগে বাড্ডার এসআই লিয়াকত আলী, রাকিব আলী, বনানী থানার এসআই এমদাদুল হক তৈয়ব, গুলশানের এএসআই শহিদুল ইসলামসহ অন্তত ৩০ জন এসআই-এএসআইকে বদলির সরকারি আদেশ দেওয়া হলেও তা তারা পাত্তাই দিচ্ছেন না। আদেশে বলা হয়েছে, নির্ধারিত তারিখে স্ব-স্ব বদলিকৃত স্থানে যোগদান না করলে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে ক্লোজড হয়ে যাবেন। কিন্তু কোনো আদেশেরই কার্যকারিতা নেই। শৃঙ্খলা ভঙ্গের আদেশ অমান্যের জন্য কোনো রকম শাস্তিও পেতে হয় না তাদের।
থানায় আসা সহায়তাপ্রার্থীসহ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও গালিগালাজকারী বাড্ডা থানার ওসি (তদন্ত) কামরুল ফারুকের ব্যাপারেও ছয়টি বিভাগীয় প্রতিবেদন চাপা পড়ে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ক্ষোভের সঙ্গে জানান, তার বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ গুলশান ডিসি দফতর পেরিয়ে আর ডিএমপি হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত যায় না।
তদন্ত রিপোর্ট বেমালুম গায়েব : ক্যান্টনমেন্ট থানার মাটিকাটা এলাকায় ছয়জন পুলিশ কর্মকর্তার সমন্বয়ে শত শত কোটি টাকা মূল্যের জমি জবরদখল করাসংক্রান্ত আলোচিত তদন্ত প্রতিবেদনটি বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে। গুলশান জোনের এডিসি (সদ্য বদলিকৃত) শাহনেওয়াজ খালেদ এ তদন্ত প্রতিবেদনটি দাখিল করলেও তা এখন গুলশান ডিসি দফতরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে জমি জবরদখলের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি সালাহউদ্দিন, এএসআই খন্দকার আবু নাঈম, এএসআই মিজানুর রহমানকে দায়ী করা করা হয়। এ ছাড়াও পরোক্ষভাবে আরও কয়েকজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার প্রভাব ও যোগসাজশ থাকার কথা উল্লেখ ছিল।
কিন্তু সরাসরি বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশসংবলিত প্রতিবেদনটি গায়েব হওয়ায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।