মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে...
বাঙালীর শখের তোলা আশি টাকা।
আশি টাকার উপরে শখের তোলাকে কোনভাবেই উঠতে দেয়া যাবে না। জীবনে নানান যন্ত্রণা, নানান হ্যাপা। এর মধ্যে ‘শখ’এর মতো ‘আকাইম্যা’ বিষয়কে তাই ‘লাই দিয়ে মাথায় তোলার’ কিছু নেই। তারচেয়ে বরং শখের আশি টাকা খরচ করে বর্ষা মৌসুমের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ঘরে নতুন ছনের চালা লাগানো যেতে পারে, গরুর জন্য মশারি কেনা যেতে পারে, বন্যা-বাদলার কোন ঠিকঠিকানা নাই, নতুন মাটি কেটে বাড়ির ঢিবিটাকে খানিকটা উঁচু করা যেতে পারে।
বাঙালীর এই মানসিকতাকে নাক সিটকে ছ্যাঃ ছ্যাঃ করে দেখার সুযোগ নেই। বাস্তবতা আসলেই এমন, ছয় টাকা খরচ করে শখের কবিতা লেখার জন্য একখানা শক্ত মলাটের রুলটানা খাতা কেনার চেয়ে ছয় টাকার কেরোসিন কেনা ঢের কাজের। রাত বিরাতের অন্ধকারে, বিপদে আপদে ছয় টাকার রুল টানা খাতা কোন কাজে আসবে না, কাজে আসবে কুপি ভর্তি কেরোসিন।
শখ এবং বাস্তবতার এই টানাপড়েনই বোধকরি প্রবল সম্ভাবনাময় বাঙালীর অমিত সৃজনশীলতাকে সবগুলো পাখা মেলে উড়তে দেয় নি। একজন রবীন্দ্রনাথের জায়গায় না হলে হয়তো আমরা আরও দশজন রবীন্দ্রনাথ কিংবা সত্যজিৎ পেতাম।
আরও জনা দশেক জগদীশচন্দ্রবসু কিংবা কুদরত ই খুদা পেতাম। শখ, সাধ, সাধ্য এবং বাস্তবতার এই নানামুখি দুর্বিপাকের কারণেই হয়তো বাঙালী সৃজনশীল যে ক’জন চেনা মুখ আমরা দেখি, তাদের প্রত্যেকের জীবনই প্রবল ষ্ট্রাগলিঙের কাহিনীতে ভরপুর, কিংবা শেষ জীবনে এসে ভয়াবহ আর্থিক টানাপড়েনের অবিশ্বাস্য করুণ গল্প। যার ভয়ঙ্কর বাস্তব উদহারন কিংবদন্তী কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবনের শেষ অধ্যায়।
এই লেখায় আমার নিজের তেমন কোন জায়গা নেই, একটা মাত্র জায়গা ছাড়া, সেটি হোল ওই ‘শখ’।
বছর আটেক বয়স থেকেই মাথার ভেতর নানান চিন্তা গিজগিজ করা শুরু করেছে, যার বেশিরভাগই আমার মা-বাবার কাছে ‘আকাইম্যা’ চিন্তা আর পয়সা নষ্ট করার ধান্দা ছাড়া কিছুই না।
আমি ছবি আঁকবো, আমার মায়ের মাথায় হাত! কি দরকার খাতার পাতা নষ্ট করার! তারচেয়ে অইখানে অংক কর! তাও আবার সেই খাতায় একবার পেন্সিল দিয়ে লেখ, পেন্সিলের আবছা অক্ষরের উপর সেকেন্ড টাইম লেখার একটা সুযোগ থাকে কলম দিয়ে। বাঃ বাঃ! কেমন ভেল্কি! এক ঢিলে পাকাপাকি দুই পাখি শিকার...
উপরের এমন অভিজ্ঞতার কারণে, সৃজনশীলতার সকল প্রকার ‘আকাম’ কে সচেতনভাবে দূরে সরিয়ে রাখার টনটনে জ্ঞান তখন থেকেই আত্মস্থ করেছিলাম। লেখালেখি, ছবি আঁকা, ক্রিকেটার হওয়া কিংবা ছবি তোলার মতো ‘শখের তোলা’ গুলোকে আলগোছে শিকেয় তুলে রেখেছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষের দিকে এসে হঠাৎ করে ডিজিটাল ক্যামেরার আত্মপ্রকাশে কেমন কেমন করে যেন শৈশবে শিকেয় তুলে রাখা সেই অনেক অনেক শখের ঝুড়ি থেকে ‘ফটোগ্রাফির’ ভূত চুপচাপ নেমে এসে মাথায় গেড়ে বসলো। জীবন যুদ্ধের কঠিন সংগ্রামে বিধ্বস্ত সেই আমি এই ভূতকে মাথা থেকে নামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, বছরখানেকের মধ্যে যখন সেই ভূত প্রায় ‘নামছি-নামছি’ করছে, গোল টা বাঁধলো তখনই।
নীল ক্ষেতের পুরনো এক বইয়ের দোকানে খুঁজে পেলাম ফটোগ্রাফির এক বই, সেই বইয়ের নাম ‘A Ballad of Bangladesh’।
সেই বই কেনার মতো টাকা আমার পকেটে নেই। আমি রাস্তার পাশে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে সেই বইয়ের ছবিগুলো দেখি, আর আমার শরীরের ভেতর একধরনের শিরশিরে অনুভূতি হতে থাকে, মনে হতে থাকে, প্রতিটি ছবি একেকটি জীবন, আর সেই প্রতিটি জীবনের অজস্র গল্প কেমন কেমন করে যেন চিত্রিত হয়েছে ওই একেকটি ছবিতে। ছবি এতো জীবন্ত হতে পারে! আসলেইতো, A picture is worth a thousand words’.
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতন সেই ছবির বইয়ের আলোকচিত্রীর নাম দেখলাম,- আনোয়ার হোসেন। শুরু হয় আমার আনোয়ার হোসেন অনুসন্ধানের অভিযান।
আমি সম্মোহিতের মতন আনোয়ার হোসেনের ছবি দেখি, তার জীবনের গল্প খুঁজি। সেই গল্প খুঁজতে খুঁজতে আমি আবারো খুঁজে পাই সেই বাঙালী কিংবদন্তীদের জীবনের গল্প।
পুরান ঢাকার আগা নওয়াব দেউড়ির এক বস্তি ঘর থেকে ১২ ভাইবোনের এক টানাপড়েনের সংসারের সেই ‘শখের তোলা আশি টাকা’র বাস্তবতাকে কে থোরাই কেয়ার করে, জীবনের নানামুখি বাস্তবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কিভাবে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন আনোয়ার হোসেন। কিভাবে পাল্টে দেন বাংলা চলচ্চিত্রের সিনেমাটোগ্রাফির খোলনচল।
কিভাবে আনোয়ার হোসেনের কল্পনার সব রঙ মেশানো অনবদ্য সৃষ্টিশীল কল্পনাশক্তি থেকে একেরপর এক ফ্রেমবন্দি হতে থাকে অবিস্মরণীয় সব সিনেমা, সূর্যদীঘল বাড়ি, নদীর নাম মধুমতি, চিত্রা নদীর পাড়ে, লালসালু, চাকা, শ্যামলছায়াসহ অনবদ্য সব সিনেমা।
সিনেমাটোগ্রাফির জন্য যিনি জিতে নেন ১২ টি জাতীয় পুরস্কার। কমনওয়েলথ গোল্ড মেডেলসহ প্রায় ৭০ টি আন্তর্জাতিক গোল্ড মেডেল জিতে বিশ্ব আলোকচিত্র মঞ্চে আনোয়ার হোসেন তুলে ধরেন অন্য এক বাংলাদেশকে। সেখানে বাংলাদেশ কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দরীদ্র, দুর্নীতিপরায়ণ দেশ নয়, বাংলাদেশ সৃজনশীল চিন্তা এবং সৃষ্টিশীলতার এক অনন্য নান্দনিক ভূমি হিসেবে উঠে আসে বিশ্ব শীল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অভিজাত আর নান্দনিকতা চর্চার সুবিশাল মঞ্চে। এ এক নতুন বাংলাদেশ...
আমার কিছু স্বপ্ন পূরণ হবার গল্প অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর ঠেকে আমার নিজের কাছেই। একদিন স্বপ্ন পূরণের এমন আরেক অদ্ভুত গল্পেই সেই আনোয়ার হোসেনের সাথে সত্যি সত্যি আমার একদিন পরিচয় হয়ে যায়, সেটি অন্য এক গল্প।
তবে আনোয়ার হোসেনের সাথে আমার কথা হতে থাকে দিনের পর দিন, গল্প হতে থাকে, আমার আনকোরা হাতের এলেবেলে ছবি দেখেও তিনি কেন জানি প্রবল মমতায় আমার পিঠ চাপড়ে দেন, ভুল ধরিয়ে দেন, ছবির ফ্রেম ঠিক করে দেন, কখনো সখনো ফিসফিস করে বলেন, ‘তুমি একদিন অনেক বড় হবে’।
আসলে তিনি যা করেছেন তা হোল, আমার বুকের ভেতর বুনে দেন স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের কোন শেষ নেই, সেই স্বপ্ন সীমাহীন। একজন আলোকচিত্রি হিসেবে যে স্বপ্নের বীজ আমার বুকের ভেতরে ক্রমশই অঙ্কুরোদগম হয়েছে, তার পুরোটা জুড়েই এই খেয়ালি আপাদমস্তক শিল্পী সত্তার কিংবদন্তী মানুষটির অন্তহীন অনুপ্রেরণা।
আজ আনোয়ার হোসেনের জন্মদিন।
১৯৬৭ সাল থেকে শখের তোলা আশি টাকার বদলে ৩০ টাকার একটা সেকেন্ড হ্যান্ড বক্স ক্যামেরা কিনে ছবি তোলা শুরু করেছেন, ১৯৪৮ সালে জন্ম আনোয়ার হোসেনের এই ৬৫ বছরের জীবনে ক্যামেরা ছাড়া আর কোন কিছুই আঁকড়ে ধরে রাখেন নি অবিরামভাবে এতোটা সময় ধরে। যার ক্যামেরার পিক্সেলে পিক্সেলে রচিত হয়েছে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের নাম, বাংলাদেশের ইতিহাস, বাংলাদেশের প্রাণ। মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্যিক সব বিজয়গাঁথা আর গল্প রচিত হয়েছে এই ‘ইমেজবাউলে’র পিক্সেলের প্রতিটি ফোঁটায়।
সমস্যা হচ্ছে, এই পর্যন্ত লিখতে এসে এখন আমার মনে হচ্ছে, আসলে বাঙালীর শীল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে সব সম্ভাবনা নিয়ে উদ্ভাসিত হতে না পারার দায় শুধুমাত্র ‘শখের তোলা আশি টাকা’ অতিক্রম করতে না পারার কারণে নয়, বরং অন্যখানে। সেখানে রাষ্ট্র কিংবা মেকানিজমের দায় আরও অনেক বেশি... রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ভুমিকা কিংবা দায় অনেক বেশী... অনেক...
আমরা কথায় কথায় নীতি কথা আওড়াই, বলি, আমাদের আসলে ভাবতে হবে, ‘দেশ আমাদের অনেক দিয়েছে, আমরা দেশকে কি দিয়েছি?’ কিন্তু যারা দেশকে অনেক দিয়েছেন, তাদের আমরা কি দিয়েছি?
হয়তো আনোয়ার হোসেনদের মত মানুষদের কিছু দেয়ার সামর্থ্য অন্যদের নেই।
তারা শুধু দু’হাত ভরে দেশ, জাতি, বিশ্ব আর প্রজন্মকে দিতে পারেন অকৃপণ। তাদের দেয়ার সামর্থ্য কারো নেই। রাষ্ট্রের কিংবা নীতি নির্ধারকদেরতো আরও নেই। তেনারা পাকা জহুরী(!)।
আনোয়ার হোসেনদের মতন ‘কাঁচকে হিরে ভেবে’ তেনারা ভুল করবেন ই বা কেন!!
আসলে, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভুল বলেন নি, ‘যে দেশে গুণীর সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না’।
প্রিয় আনোয়ার হোসেন, আমাদেরও তেমন কিছুই দেয়ার নিয়ে আপনাকে। কিন্তু আপনি দিয়েছেন, আপনারা দিয়েছেন, দিয়ে যাবেন অনন্তকাল। প্রজন্মের পর প্রজন্মে, স্বপ্নবাজ অজস্র কিশোর, তরুনের ছোট ছোট চোখের ভেতর স্বপ্নের লাল নীল ঘুড়ি, আপনি কিংবা আপনারাই উড়িয়ে যাবেন। ওড়াতেই থাকবেন। সেইসব ঘুড়ির নাটাই নেই, সুতো নেই।
সেইসব স্বপ্নের ঘুড়িরা বাঁধনহীন উড়ে যাবে আকাশে আকাশে, সীমাহীন অসীমে।
শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, শুভেচ্ছা...
শুভ জন্মদিন... প্রিয় আনোয়ার হোসেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।