অনেক দিন যাবৎ সম্রাট উচ্চমাত্রার অ্যালকোহল সমৃদ্ধ শুরা পান করে দিব্যি সুস্থ ও সবল রয়েছেন। শাহী হেকিমের শত অনুরোধ ও সতর্কবাণী তাকে শুরা পান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। দিন ও রাতের বেশির ভাগ সময় তিনি মাতাল অবস্থায় থাকতেন। অথচ কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নিতে এবং জটিল মামলার রায় প্রদান করতে একবারও ভুল হয়নি। মাতাল অবস্থায় সিংহাসনে বসেও তিনি সুস্থ মানুষের তুলনায় ধীর-স্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন।
সম্মানিত মানুষের মর্যাদার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন এবং দরবারের পরিবেশ মোহময় এবং আকর্ষণীয় করে তুলতেন বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক রং ও রসের মাধ্যমে। শুধু কী তাই! মাতাল অবস্থায় তিনি যুদ্ধের ময়দানে নেতৃত্ব দিতেন। তিনিই একমাত্র মোগল সম্রাট, যিনি কোনো সামরিক যুদ্ধে পরাজিত হননি। বরং তার ভুবনবিখ্যাত পিতা যেসব অঞ্চল সুবেবাংলা, রাজপুতনা, দক্ষিণাত্য, কান্দাহার, কাবুল জয় করতে পারেননি সেসব এলাকায়ও তিনি সফলতার সঙ্গে অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে দখলিভূত করেছিলেন। তার অসামান্য ও অনবদ্য মেধা যুদ্ধক্ষেত্র কিংবা রাজ দরবার বা মোগল হেরেমের শত শত সুন্দরী রমণীর মাঝেই কেবল বিকশিত হতো না, সারা হিন্দুস্তানের শিল্প-সাহিত্য, চিত্রকলা, নৃত্যকলা এবং নয়নাভিরাম সব স্থাপত্যকলার মধ্যে অমরত্ব লাভ করেছে।
ফলে তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা সব সময় হা-হুতাশ করে বেড়ান_ আহা! এমন একজন মেধাবী মানুষ যদি একটু কম শুরাসক্ত হতেন, তাহলে সালতানাতে মোগল আলেকজান্ডারের মতো বিশ্বজয়ে বের হতে পারত।
সম্রাটের দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা ছিল শুরাপান তার দেহ-মন-মেধার কোনো ক্ষতিই করতে পারেনি। কিন্তু তার এ ভুলটি প্রথম ধরা পড়ে যেদিন তিনি প্রথম সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের সঙ্গে দৈহিক মিলনে রত হয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে সেদিন কোন জানি তিনি শুরা পান করেননি। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় সম্রাজ্ঞীর মহলে ঢোকার পর তিনি সব কিছু নতুনভাবে দেখতে এবং অনুভব করতে আরম্ভ করলেন।
কামরার মোমবাতির আলো সে রাতে কোন জানি বেশি স্পষ্ট হয়ে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছিল। তার মানবিক অনুভূতিগুলো প্রতি মুহূর্তে তার শরীর ও মনকে ভীষণভবে আলোড়িত করছিল। এক অসাধারণ ভালোবাসার অনুভূতি তাকে প্রশান্তময় এক ভুবনে নিয়ে গেল। কামরাটিতে রাখা শত শত ফুলের বাহারি রং আর হরেক রকম সুগন্ধ তিনি আলাদা আলাদা অনুভব করতে পারছিলেন। প্রিয়তমা স্ত্রীকে আলিঙ্গন করার পর তার পোশাক, তার চুল ও শরীরের সুগন্ধের ভিন্নতা অনুভব করার পর তিনি সুখের আবেশে বিহ্বল হয়ে পড়লেন।
সম্রাজ্ঞীর মুখমণ্ডলে দুহাত রেখে চাঁদ মুখখানাকে একটু উপরে তুলে ধরলেন। তারপর সম্রাজ্ঞীর রক্তিম ঠোঁটের কাছে নিজেকে আরও অন্তরঙ্গ করার মুহূর্তে অনুভব করলেন এক মেশক/অম্বরের মতো সুগন্ধ। কোনো নারীর ঠোঁটে যে এরূপ অতি আশ্চর্য সুগন্ধ থাকতে পারে, তা তার জানা ছিল না। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, তার ঘ্রাণেন্দ্রিয়টি যে দীর্ঘছিল অকজো ছিল, তা তিনি জানতেনই না। আজই প্রথম টের পেলেন।
ফলে সেই রাত থেকে সম্রাট প্রতিজ্ঞা করেছেন, নূরজাহানের মহলে তিনি কোনো দিন মধ্যপ অবস্থায় আসবেন না। কারণ যে ফুল অপরূপ সৌরভ ও সুগন্ধি ছড়ায়, সে ফুলে কোনো দুর্গন্ধযুক্ত কীট শোভা পায় না। তাই ফুলের পরাগায়ণের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ প্রজাপতি সৃষ্টি করেছেন।
পানি পান করে সম্রাট তার বিছানায় কিছুটা সময়ের জন্য শুয়ে পড়লেন। চারদিকে সুনসান নীরবতা।
অন্যান্য দিন এ সময় নানা কারণে তাকে ব্যস্ততম কোলাহলের মধ্যে কাটাতে হয়। বিশেষ করে গত সাত দিন তিনি ছিলেন অতিশয় ব্যস্ত। রাজধানীর বাইরে নিকটতম দুর্গগুলো তিনি সরেজমিন তদারক করার জন্য গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রকর্ম ও রাষ্ট্রাচারের শত নিয়ম-কানুন এবং সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে দেহ-মন বিষিয়ে উঠত। দুর্গগুলোতে যদিও রোজ রাতে সম্রাটের সম্মানে নাচ-গানের আয়োজন হতো; কিন্তু অতীতের মতো তিনি এগুলোতে উপস্থিত হয়ে আনন্দ লাভ করতে পারেননি।
প্রতিবারই তার মনে হয়েছে, সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের কথা। ফলে মহলে ফেরার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়েছিলেন। আজ রাজধানীতে ফেরার পর তিনি বার বার সূর্যের দিকে তাকাচ্ছিলেন, সেটি কখন অস্ত যায়। অবশেষে খাস কামরায় বিছানায় শুয়ে সন্ধ্যার সেই নির্জন পরিবেশে ভাবতে থাকলেন প্রিয়তমার কথা, তার ইতিহাস এবং নিয়তির অপূর্ব মিলনের সন্ধিক্ষণগুলোর ইতিবৃত্ত। সম্রাটের ভাবনায় ছেদ পড়ল প্রহরীর হুঁশিয়ার শব্দ শুনে।
কেউ হয়তো জরুরি কোনো বার্তা নিয়ে তার কামরায় প্রবেশ করতে চাইছে। সম্রাট উঠে বসলেন এবং তার ব্যক্তিগত ঘণ্টায় টুংটাং শব্দ তুলে আগন্তুককে কামরায় প্রবেশের অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে প্রহরী সম্রাটের কামরায় ঢুকল। মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করার পর সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের মহল থেকে আগত একটি চিঠি হস্তান্তর করল। একান্ত ব্যক্তিগত পাঠের জন্য বিশেষভাবে সিলমোহরকৃত।
সম্রাট চিঠি খুলে বুঝতে পারলেন প্রিয়তমার প্রেমের চিঠি। সারা চিঠিতে অসংখ্য রং-বেরঙের আলপনা অাঁকার পাশাপাশি ইরানি গোলাপের সুগন্ধি মাখানো হয়েছে সুনিপুণভাবে। ফলে পড়ার জন্য চিঠিটি খোলার সঙ্গে দেহ-মন জুড়িয়ে গেল ফুলের সৌরভে। চিঠির ওপর অঙ্কিত আলপনাগুলো যেন জীবন্ত প্রজাপতি হয়ে চারদিকে উঠতে লাগল। সম্রাট এই প্রথম তার কোনো বিবাহিত মহীয়সীর কাছ থেকে প্রেমের সুগন্ধি মাখানো পত্র পেলেন।
সম্রাজ্ঞী লিখেছেন_ 'হিন্দুস্তানের মহান অধিপতি সম্রাট নুরউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের কাছে তার দাসী নূরজাহানের পত্র। বিষয়বস্তু : একান্তই ব্যক্তিগত; মনের আকুতি প্রকাশ। আমার মান্যবর আকা, আমার মাওলা_ গত সাতটি দিন অধীর আগ্রহ নিয়ে আপনার আগমন প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছিলাম। প্রাসাদের শত কোলাহল কিংবা ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতি মুহূর্তে আপনার অনুপস্থিতি আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দিচ্ছিল। মোগল হেরেমের প্রধান মহীয়সী হিসেবে গত কয়েক দিনে আমার একান্ত অনুভূতি হচ্ছে- প্রতিটি রাজপদের অধিকারী যদি নিজেকে দায়িত্ববান এবং কর্তব্যপরায়ণ বলে ভাবতে শিখে তবে তার ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকে না।
প্রতিটি মুহূর্ত কেবল জনগণের কথাই মনে হতে থাকে। এভাবেই মন-মানসিকতা কেবলমাত্র আপনার সাম্রাজ্যের প্রজাদের কল্যাণের দিকে ধাবিত করে দিন গুজারের এই সময় আপনার আগমনের এত্তেলা পেয়ে অধীর হয়ে পড়েছি। একেকটি ক্ষণ যেন মস্তবড় একেকটি যুগের মতো দীর্ঘতর মনে হচ্ছে। আপনার দাসীর মহলটি- মালিকের শুভাগমন উপলক্ষে অপরূপ রূপে সজ্জিত হয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। আরজ গুজারে- আপনারই নূরজাহান।
'
সম্রাজ্ঞীর পত্র পাওয়ার পর শাহেনশাহের আর তর সইছিল না। তিনি অনতিবিলম্বে অন্দর মহলের দিকে রওনা দিলেন। সম্রাটের গমনপথে সঙ্গে সঙ্গে নহবত ও সানাইয়ের সুর বেজে উঠল। মাত্র কিছু সময় পূর্বে সূর্যাস্ত গেছে। সময়টাকে ভরা সন্ধ্যা বলা যেতে পারে।
এ সময়ে সাধারণত সম্রাটরা তাদের খাসকামরা বা সান্ধ্যকালীন দরবারে অবস্থান করেন। সচরাচর হেরেমে প্রবেশ করেন না। কিন্তু আজকের সন্ধ্যায় সম্রাটের আগমনে তাই মোগল হেরেমে হই-হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। খোজা প্রহরী, দাসী-বাঁদিসহ রাজ অন্তপুরের বাসিন্দাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সম্রাজ্ঞীর খাস কর্মচারীরা ছিল যারপরনাই উৎফুল্ল।
কারণ, সম্রাটকে ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণকারীর জন্য তারা সারাটা দিন পুরো মহল ঝাড়পোঁছ করে পয়-পরিষ্কার করেছে। সম্রাটের পছন্দের সব ফুল, সুগন্ধি আর আলোকোজ্জ্বল ঝাড়বাতির সাহায্যে সম্রাজ্ঞীর মহল সাজিয়েছে। অন্যদিকে সম্রাজ্ঞী নিজে সেজেছেন অপরূপ সাজে। সারাটা দিন তিনি নিজের শরীর ও মনের সমন্বিত প্রণতি সমন্বিতভাবে প্রেমিককে উপহার দেওয়ার জন্য শত আয়োজন নিষ্পন্ন করেছেন।
মাথা নুইয়ে কুর্নিশ জানানোর পর সম্রাজ্ঞী স্মিতহাস্যে শাহেনশাহের দিকে তাকালেন।
আশপাশের আলোকসজ্জা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, হরেক রকম ফুলের সুবাস এবং সর্বোপরি সম্রাজ্ঞীর অসাধারণ বেশভূষা দেখে শাহেনশাহের হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠল। তিনি হাত বাড়িয়ে সম্রাজ্ঞীর হাত স্পর্শ করলেন এবং হালকা টানে তাকে আরও কাছে টেনে নিলেন। সম্রাজ্ঞীও নিবিড় মমতায় নিজেকে সমর্পণ করলেন রাজপুরুষের বাহুবন্ধনে। এরপর মৃদু সুরে বললেন, আলমপনার জন্য আজকের সন্ধ্যাটি মোহময় করতে আমি সুদূর কাশ্মীর থেকে একদল নৃত্য ও সংগীতশিল্পীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। এবার আপনি অনুমতি দিলে আমরা অনুষ্ঠান শুরু করতে পারি।
শাহেনশাহ প্রিয়তমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, রাষ্ট্রীয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে এবং আমার মনে হচ্ছে এগুলো নিয়ে তোমার সঙ্গে জরুরি পরামর্শ দরকার। সুন্দর একটি সন্ধ্যা অতিবাহিত করার জন্য আগামীকাল আমি তোমার আতিথ্য গ্রহণ করতে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসব। আজ আমার হৃদয় কেন জানি অশান্ত হয়ে পড়ছে বারবার।
সম্রাজ্ঞী তার প্রিয়তম স্বামীর কথা শোনার পর নিজেকে আরও নিবিড়ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। শাহেনশাহে বুকে মাথা রেখে দুই হাতে তাকে জাপটে ধরে রাখলেন বেশ কিছুক্ষণ।
বুকে কান পেতে তার হৃদস্পন্দন বোঝার চেষ্টা করতে থাকলেন।
মনে হলো আসলেই তিনি অস্থির। বুকের টিপ টিপ শব্দ কখনো দ্রুত হচ্ছিল আবার কখনো ধীরলয়ে নেমে যাচ্ছিল। সম্রাজ্ঞী তার সোহাগী হাত দুটো দিয়ে শাহেনশাহের পিঠ-হাত, কাঁধ প্রভৃতি স্থানে স্পর্শ করে বুঝলেন শরীরের কিছু কিছু মাংসপেশি মাঝেমধ্যে ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠছে। সাধারণত অতিরিক্ত পরিশ্রম করার পর মানুষ বিশ্রাম না নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে সময় কাটালে শরীরের এ রকম আচরণ করে।
নিজেকে সম্রাটের বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে তিনি স্বামীর হাত ধরে তাকে পরমযত্নে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। এরপর শিয়রে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, কী এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা কিনা আমার মালিককে মারাত্দক পেরেশানিতে ফেলেছে! সম্রাট বললেন, তোমার মহলের উদ্দেশে রওনা করার মুহূর্তে আগামীকালের দরবারের কার্যতালিকায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। সেখানে দেখলাম উগ্র শিয়া ধর্মীয় নেতারা দরবারে আমার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে উপস্থিত হবে। খবর পেলাম সুনি্ন নেতারাও কোমর বেঁধে বসে আছে। দরবারের বহুমুখী চক্রান্তকারীরা এই সুযোগে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য উঠেপড়ে লাগবে- এটাই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে ইসলামের সুনি্ন ও শিয়া মতবাদ সম্পর্কে আমার ধারণাও স্পষ্ট নয়। তাই এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাচ্ছি।
শাহেনশাহের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সম্রাজ্ঞী বেশ আত্দবিশ্বাসের সুরেই বললেন, জাহাপনা, আপনি অনুগ্রহ করে এ ব্যাপারে পেরেশানি বোধ করবেন না। মনে হচ্ছে আপনার সাহায্যকারিণী হওয়ার জন্যই মহান আল্লাহপাক আমাকে শিয়া ও সুনি্ন মতবাদের ভিন্নতা, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিয়েছেন। আপনি অনুমতি দিলে আমার জানা বিষয়গুলো আপনাকে শোনাতে পারি।
এতে করে আপনার জ্ঞানের সঙ্গে আমার দেওয়া তথ্যগুলো যোগ হয়ে আপনাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করবে। যেসব ধর্মীয় নেতারা আপনার দরবারে আসবেন তাদের উদ্দেশ্য ও বিধেয় সম্পর্কে যদি আপনার সুস্পষ্ট ধারণা থাকে তবে চক্রান্তকারীরা তাদের অভিলাষ পূর্ণ করার কোনো সুযোগই পাবে না। অবাক দৃষ্টিতে শাহেনশাহ সম্রাজ্ঞীর মুখের দিকে তাকালেন এবং জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনুমতি দিলেন তার কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
সম্রাজ্ঞী শুরু করলেন_ জাহাপনা নিশ্চয়ই জানেন যে, ইসলামের নবীর জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে এবং ৪০ বছর বয়সে অর্থাৎ ৬১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি নবুয়তপ্রাপ্ত হন। তখন আরব উপদ্বীপ ভাগাভাগি করে শাসন করত রোমান এবং পারসিকরা।
আরব সাগর ও লোহিত সাগরের তীরের এই ভূমি অর্থাৎ আরব উপদ্বীপকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম স্থলভূমি। কেউ কেউ এটাকে পৃথিবীর প্রথম স্থলভাগ বলে বর্ণনা করে থাকেন। মুসলমান পণ্ডিতদের মতে, সমগ্র পৃথিবী এক সময় ছিল পানিতে পরিপূর্ণ। এ পানির ওপর প্রথম সে ভূখণ্ডটি জেগে ওঠে সেটি হলো সেই স্থানটি যেখানে বর্তমানে পবিত্র খানায়ে কাবা অবস্থিত। অর্থাৎ মক্কার বায়তুল্লাহ শরিফের ভূমিই পৃথিবীর আদি ভূমি।
আরবিতে অনাদিকাল থেকে এই স্থানটিকে বলা হতো বাক্কা। বাক্কা শব্দের অর্থ উঁচুভূমি। সমুদ্রের বুকে ফেনা জমতে জমতে প্রথমে ভূমির সৃষ্টি হয়ে যখন উঁচু হতে হতে ভূখণ্ডে রূপান্তরিত হলো এবং সেই ভূমিতে মানুষের বসবাস শুরু হলো- তখন থেকেই লোকজন একে বাক্কা নামে ডেকে আসছে।
বাক্কা বা মক্কাতে প্রথম জনবসতির পত্তন ঘটান মুসলমান জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)। খ্রিস্টের জন্মেরও প্রায় ৩ হাজার বছর আগে তার দ্বিতীয় স্ত্রী এবং শিশুসন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-কে দিয়ে তিনি সর্বপ্রথম এই ভূমিতে বসতি স্থাপন করেন।
সমগ্র আরব উপদ্বীপে তখন জনবসতি ছিল ইয়ামান, জেরুজালেম, ব্যাবিলন এবং সিরিয়া অঞ্চলে। মানুষজনের প্রধান ধর্ম ছিল পৌত্তলিকতা। হজরত ইব্রাহিম (আ.) জেরুজালেম এলাকায় এবং তার ভাগিনা লুত (আ.) এডেন বন্দর তথা ডেড সি-সংলগ্ন এলাকায় বহুকষ্টে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার করে আসছিলেন। কিন্তু বিশাল পৌত্তলিক সম্প্রদায়গুলোর কাছে তারা ছিলেন একেবারেই নগণ্য এবং নিদারুণ সংখ্যালঘু। মহান আল্লাহপাকের ঐশী সাহায্য, নিজেদের শক্তিশালী ইমান এবং দৃঢ় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সহকারে তারা ক্রমাগত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন।
পবিত্র কোরআনে সম্মান করে হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে মুসলিম জাতির পিতা বলা হলেও তিনি কেবল বিখ্যাত হয়ে আছেন আল্লাহপাকের মহা সম্মানিত একজন নবী হিসেবে_ কোনো ঐশী কিতাব কিংবা স্বতন্ত্র জাতিসত্তার পরিচয় বহন করেন না যেভাবে হজরত মূসা (আ.), হজরত ঈশা (আ.) এবং হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর নাম একেকটি ধর্ম, সম্প্রদায় এবং কিতাবের সঙ্গে একীভূত হয়ে আছে।
ইতিহাসে ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সভ্যতা কখনো একে অপরের পরিপূরক হয়ে উন্নতির স্বর্ণ শিখরে যেমন পেঁৗছে গেছে, তেমনি আবার একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পরস্পরের জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
আরব উপদ্বীপে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে খ্রিস্টান, ইহুদি, অগি্ন উপাসক, পৌত্তলিক ছাড়াও কিছু নাস্তিক লোক বসবাস করত। ঠিক ইসলাম ধর্মের মতো মহান আল্লাহর একত্ববাদীর অনুসারী কিছু লোকও শত শত বছর ধরে তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলে আসছিল। হজরত ইব্রাহিম (আ.) থেকে হজরত মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল ধরে তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য হলেও বিভিন্ন রাজ্যে প্রচণ্ড সামাজিক নিপীড়নের মধ্যে এবং নির্যাতনের ভার বহন করতে করতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল।
পবিত্র কোরআনের ১৮ নম্বর সূরা কাহাফ-এ এই শ্রেণীর কিছু লোক সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহপাক বিস্তারিত বলেছেন। সমাজের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য কিছু লোক তাদের কুকুরটিসহ শহর থেকে পালিয়ে গিয়ে দূরবর্তী অঞ্চলের একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এই ঘুমন্ত অবস্থায় তারা প্রায় ৩০০ বছর ছিল। তাদের ঘুম ভাঙলে একজনকে কিছু খাদ্যদ্রব্য কেনার জন্য বাজারে পাঠায়। লোকটি দোকানিকে মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে যখন ৩০০ বছর আগেকার মুদ্রা দেয় তখনই ঘটনাটি ধরা পড়ে এবং পুরো আরব উপদ্বীপে হৈচৈ পড়ে যায়।
আল্লাহর রাসূল (স.)-এর দরবারে হজরত সালমান ফারসি (রা.) নামের একজন সাহাবি ছিলেন যিনি প্রায় ৩৫০ বছরের মতো দীর্ঘায়ু পেয়েছিলেন। হজরত সালমান ফারসি (রা.) বলেন, আমি তখন খুব ছোট ছিলাম এবং তখনই আসহাবে কাহাফ অর্থাৎ গুহাবাসীদের ৩০০ বছর পর জেগে ওঠার ঘটনাটি ঘটেছিল।
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বের ধর্মমতের অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল একদম যাচ্ছেতাই বা বাজে প্রকৃতির। আহলে কিতাব বা ঐশী কিতাবের অনুসারী ইহুদি ও খ্রিস্টানরাও ছিল পরস্পরের শত্রু। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ শত্রুতা ত্রিমুখী রূপ নেয়।
মুসলমানরা ইহুদিদের বনি ইসরাইল এবং খ্রিস্টানদেরকে নাসারা বলে সম্বোধন করে। তাদের আবার অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট বলেও সম্বোধন করা হয়। সূরা ফাতিহার ৭ নম্বর আয়াতের মধ্যে এদের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই দোয়া করা হয়েছে বলে অনেক তাফসিরকারক মনে করে থাকেন।
আরব উপদ্বীপের বহু ধর্মমত। জাতিগোষ্ঠী, সম্প্রদায় এবং গোত্রসমূহ হাজারো বিষয় নিয়ে একে অপরের সঙ্গে কলহ বিবাদ, দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ এবং যুদ্ধবিগ্রহ করে বেড়াত।
নিজেদের পক্ষ ভারী করার জন্য তাদের দরকার ছিল রাজনৈতিক সমর্থন এবং নিয়ন্ত্রণ। তৎকালীন পৃথিবীর দুটি পরাশক্তি অর্থাৎ রোমান সাম্রাজ্য এবং পারস্য সাম্রাজ্য এই এলাকা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে শাসন করে আসছিল। সিরিয়া, জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরের গাজা এলাকা ছিল রোম সম্রাটের অধীন। অন্যদিকে ইয়ামেন, নজদ, নুফুদ এবং ব্যাবিলন ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন। ব্যাবিলন অবশ্য কিছুদিন স্বাধীন ছিল কয়েকজন সম্রাটের অধীন।
[পরবর্তী পর্ব পড়ুন আগামী শনিবার]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।