খানে খানান আবদুর রহিমের কথা শোনামাত্র শাহজাদা সেলিমের মুখমণ্ডল গম্ভীর হয়ে গেল।
তিনি সন্দেহভরা দৃষ্টি নিয়ে আফসানার দিকে তাকালেন। নিজের অজান্তে তার শরীরের সবগুলো পেশি রাগ আর ক্রোধে শক্ত হয়ে উঠল। একবার মনে হলো তলোয়ার দিয়ে এ মুহূর্তে আফসানার মস্তক তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। আফসানার অনুপম স্বর্গীয় সৌন্দর্য কামদীপ্ত মিহি কণ্ঠস্বর এবং সর্বোপরি মেধাদীপ্ত অভিব্যক্তি কোনো কিছুই যুবরাজের মেজাজ ঠাণ্ডা করতে পারছিল না।শাহজাদা আফসানার হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার পর এগিয়ে গেলেন সুরার পাত্রের দিকে। স্বর্ণপাত্রে রক্ষিত পারস্যদেশ থেকে আমদানিকৃত এবং শাহজাদার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত সুরা থেকে ঢক ঢক করে পান করলেন অনেকটা। শাহজাদার এই হাবভাব দেখে আফসানা ভয়ে শুকনো পাতারমতো থর থর করে কাঁপতে লাগল। সে বুঝে উঠতে পারল না হঠাৎ করে শাহজাদা এতটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন কেন! অনেকটা কিংকতর্ব্যবিমূঢ় আফসানা তার সব মেধা, যোগ্যতা আর প্রশিক্ষিত চিন্তাশক্তি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিলো।
মুহূর্তের মধ্যে সে হৃদয়ের সব ভয়। দ্বিধা আর সংকোচ ঝেড়ে ফেলল। হিমালয়ের পাদদেশের যে অঞ্চলে তার জন্ম সেখানকার নারী-পুরুষের ধমনিতে মনে হয় অন্যরকম রক্ত প্রবাহিত হয়। প্রচণ্ড বিরূপ আবহাওয়া, দুর্গম পাহাড়ি পরিবেশ আর শত শত ছোট ছোট পার্বত্য গোত্রের মধ্যকার নিত্যনৈমত্তিক যুদ্ধবিগ্রহ এবং দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদের কারণে এমনিতেই সেখানকার লোক অসাধারণ সাহসী। কষ্টসহিষ্ণু এবং তড়িৎ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী আফসানাও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
বসা থেকে উঠে দাঁড়াল আফসানা। তারপর শাহজাদার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃঢ় অভিব্যক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে সাহেবে আলম! শাহজাদা সারা জীবন নারীকে দুর্বল অবস্থায় দেখতেই অভ্যস্ত ছিলেন। মেয়েরা পুতু পুতু করে কথা বলবে, কিছু হলেই নাকিয়ে নাকিয়ে কাঁদবে। নাকের পানি আর চোখের পানি একাকার হয়ে যাবে এবং সবশেষে তার কাছে শর্তহীন ক্ষমা প্রার্থনা করে পায়ে লুটিয়ে পড়বে। এই চিরায়ত দৃশ্যের বাইরে গিয়ে আফসানা যখন প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে শাহজাদাকে প্রশ্ন করল, তখন ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন।
খানে খানান আবদুর রহিমের নাম শোনামাত্র তিনি যে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন এবং আফসানাকে শত্রুপক্ষের গুপ্তচর ভেবে সন্দেহ করেছেন তা তিনি কিভাবে প্রকাশ করবেন_ এমনটি যখন ভাবছিলেন তখন তাকে ততোধিক আশ্চর্য করে দিয়ে অষ্টাদশী সুন্দরী তার সুকোমল হাত দিয়ে প্রথমে শাহজাদার হাত দুইখানা চেপে ধরলেন। তারপর সাজারে তাকে আলিঙ্গন বন্ধ করে শাহজাদার লোমশ বুকে মাথা রেখে পাগলের মতো মুখ ঘষতে রাগল এবং একের পর এক চুম্বনে সিক্ত করতে করতে তাকে পুনরায় বিছানার ওপর নিয়ে বসাল।
একান্ত বাধ্যগত বালকের মতো শাহজাদা আফসানার ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেন। আফসানা এবার শাহজাদাকে শুইয়ে দিলেন। তারপর পা দুটো আপন কোলে উঠিয়ে নিলেন।
যথাসম্ভব শক্তি প্রয়োগ করে পা দুটো টিপতে কখনো পায়ের পাতার কাছে হাত রেখে চমৎকার পেশা দারিত্ব নিয়ে এমনভাবে ম্যাসাজ করতে লাগল যে, শাহজাদা মুহূর্তের মধ্যেই তার বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠে চাঙ্গা অনুভব করতে লাগলেন। তার রাগ পানি হয়ে গেল এবং নেশাও ছুটে পালাল। তিনি উঠে বসতে চাইলেন।
আফসানা এবার মৃদু আপত্তি জানিয়ে শাহজাদাকে আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার অনুরোধ জানাল। কোনো কথা না বলে শাহজাদা আফসানাকে বুকে টেনে নিলেন।
এই সুযোগে আফসানা শাহজাদার বুকে মাথা রেখে তার কোমল হাত দিয়ে আরাধ্য পুরুষের মুখমণ্ডল, ঠোঁট, ঘাড়, চিবুক প্রভৃতি স্থানে হাত বোলাতে বোলাতে বলল_ মান্যবর সাহেবের আলম! আমার বয়স ও অভিজ্ঞতা নিতান্ত কম হলেও শাহী হেরেমের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার কারণে আমি রাজনৈতিকভাবে বেশ পরিপক্বতা অর্জন করেছি। হঠাৎ করে আপনার উত্তেজিত হওয়ার কারণও আমি অনুধাবন করতে পেরেছি। আপনি হয়তো সন্দেহ করেছেন আমি বা আমার পরিবার খানে খানান আবদুর রহিমের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং হয়তো এই প্রসঙ্গে আমি গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছি!
আফসানার কথা শুনে শাহজাদা নড়েচড়ে বসলেন এবং বিব্রতভঙ্গিতে যুবতীর দিকে তাকালেন। আমতা আমতা করে বললেন, ঠিক তা নয়। তবে হ্যাঁ কিন্তু জানত, কেবল তার এবং তার পুত্রদের জন্য আমি পরাজিত হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
আমি ইতোমধ্যে তার দুই পুত্রকে আমার বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে অপহরণ করে দিলি্লর কুখ্যাত 'খুনি দরজায়' ফেলে হত্যা করেছি। আমার আব্বা হুজুরের বিখ্যাত নবরত্ন অর্থাৎ নয়জন প্রভাবশালী মন্ত্রীর অন্যতম হলেন খানে খানান আবদুর রহিম। তিনি কেবল প্রভাবশালী মন্ত্রীই নন, বিভিন্নভাবে মোগল খান্দানের সঙ্গে আত্দীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। নিজের অনুগত সৈন্য-সামন্ত ছাড়া মূল শাহী ফৌজের ওপর রয়েছে তার বিরাট প্রভাব। তার যে দুই পুত্রকে আমি হত্যা করেছি তারাও ছিল নামকরা সেনাপতি এবং আব্বা হুজুরের অতিশয় স্নেহধন্য।
পুত্র হারিয়ে খানে খানান পাগলপ্রায় হয়ে পড়েছেন এবং আমাকে হত্যার জন্য হন্যে হয়ে ফিরছেন। এ অবস্থায় তোমার মুখে তার কথা শুনে আমি বিচলিত হবো এটাই স্বাভাবিক। যা হোক তুমি যা বলছিলে তা আবার শুরু কর এবং আমাকে সব কিছু বল, যা তুমি জান; বিশেষ করে খানে খানান সম্পর্কে-
আফসানা তার শৈশবের কাহিনী পুনরায় শুরু করল, যেখান থেকে সে এর আগে শেষ করেছিল। আমার মালিক আমার সর্দার! আজকের এ সময়টাতে আমার বয়স যখন ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে এবং আপনি আপনার মহামতি পিতার সঙ্গে যদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে ১৫৯৯ সালটাকে ইতিহাসে স্থান করে দিলেন যার নিয়তিতে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হলো- এই ক্ষণটির জন্য আমার কিন্তু যাত্রা শুরু হয়েছিল ঠিক আট বছর আগে। ১৫৯১ সালে আমার বয়স যখন ১০ বছর তখনই খানে খানান আবদুর রহিম আমাদের হাভেলিতে এলেন।
তিনি আসার একমাস আগ থেকেই শুরু হলো ব্যাপক প্রস্তুতি। তার ফৌজের অগ্রবর্তী একটি দল আমাদের হাভেলি এসে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা তল্লাশি চালিয়ে গেল। লাহোর কোর্ট থেকেও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এলেন। সব বিষয়ে যখন ইতিবাচক প্রতিবেদন খানে খানানের দফতরে পেশ করা হলো তখন তার সচিব সরকারিভাবে ফরমান জারি করে সেনাপতির আগমন বার্তা পাঠিয়ে দিলেন আমাদের হাভেলিতে।
আমার বয়স তখন ১০ বছর হলেও অন্যসব সাধারণ বালিকার মতো জীবন সম্পর্কে উদাসীন ছিলাম না।
পারিবারিক শিক্ষাও পরিবেশের কারণে অনেক কিছুই জানতাম এবং অনেক কিছু বোঝার চেষ্টা করতাম। খানে খানানের আগমন সংবাদে আমাদের জমিদারিসহ আশপাশের পরগনার লাখ লাখ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করে। হিন্দুরা বিশ্বাস করত, তাদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাক্ষাৎ রক্তের ধারক হলেন খানে খানান। হিন্দুরাই আমাদের জানাল যে, খানে খানান আবদুর রহিম জন্ম নিয়েছিলেন ১৫৫৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর। মায়ের দিক থেকে তিনি কিভাবে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আত্দীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন সে কাহিনী বলতে গিয়ে তারা পুরো মোগল খান্দানের এক বিরাট ইতিহাস আমাদের শুনিয়ে ফেলল।
সম্রাট বাবরের মৃত্যুর পর শাহজাদা হুমায়ুন যখন দিলি্লর সিংহাসনে আসীন হলেন তখন রাজ্যের সব বালা-মুসিবত তাকে ঘিরে ধরল। পাঠান বীর শেরশাহ সুরী কর্তৃক পরাজিত হয়ে তিনি বহু বছর পথেঘাটে ঘুরে বেড়ালেন। তারপর লাহোর, কাবুল হয়ে পারস্যে গেলেন। আবার দিলি্ল জয় করলেন। তার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে বট বৃক্ষের মতো আশ্রয়দাতা, সহযোগী কিংবা সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন সেনাপতি বৈরাম খান।
দিলি্ল জয়ের পরও হুমায়ুন শেরশাহের কতিপয় আত্দীয়স্বজনের সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ভারতীয় রাজ্য সেওয়াতের শাসন কর্তা হাসান খান। হরিয়ানা এবং রাজস্থানের বিরাট অংশ নিয়ে গঠিত প্রাচীন এ রাজ্যটি খ্রিস্ট জন্মের ৫০০ বছর আগে থেকেই নানা কারণে প্রসিদ্ধ অর্জন করেছিল।
হাসান খান ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। দিলি্ল-গুরগাঁও, আলওয়ার-জয়পুর মহাসড়কটি মেওয়াত রাজ্যের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়ার কারণে কৌশলগতভাবে রাজ্যটি অসাধারণ গুরুত্ববহন করত।
হাসান খানের পর তার ভাই জামাল খান এ গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের কর্ণধার হলেন। হুমায়ুন নিজে জামান খানের বড় মেয়েকে বিয়ে করলেন এবং ছোট মেয়ের সঙ্গে বেরাম খানের বিয়ে দিলেন। হাসান খান এবং জামাল খানেরা মুসলমান হওয়ার আগে হিন্দু ছিলেন এবং বংশানুক্রমে রাজপুত রক্তের ধারক ছিলেন। রাজপুত খানের রাজার পুত্র এ নামের সঙ্গ মিল রেখে তারা মুসলমান হওয়ার পর নতুন উপাধি ধারণ করলেন খানজাদা অর্থাৎ খানের পুত্র। রাজপুতরা ঐতিহাসিকভাবে শ্রী কৃষ্ণের বংশধর বলে স্বীকৃত হওয়ার কারণে সেই বংশের একটি অংশ মুসলমান হয়ে খানজাদা উপাধি ধারণ করলেও ভারতবর্ষের হিন্দুরা তাদের যারপরনাই ভক্তি-শ্রদ্ধা করত।
জামাল খানের কনিষ্ঠ কন্যার পুত্র হিসেবে খানে খানান আবদুর রহিম লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বৈরাম খান আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন গুজরাটের পাথান নামক স্থানে। তখন বালক আবদুর রহিম ও তার মাকে প্রথমে নেওয়া হয় আহমেদাবাদে এবং পরে আনা হয় দিলি্লতে। সম্রাট আকবর তাকে মির্জা খান উপাধি দেন এবং পরবর্তী সময়ে মোগল সালতানাতের বিখ্যাত আমিরের ততোধিক বিখ্যাত বোন সাহবানুর সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। অন্যদিকে আবদুর রহিমের সৎমা সালিমা সুলতান বেগমকে স্বয়ং সম্রাট বিয়ে করার পর রাজ দরবারে তার প্রতিপত্ত আরও বেড়ে যায়।
খানে খানান আবদুর রহিম একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও মনে-প্রাণে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি এক ধরনের দরদ অনুভব করতেন। তার কাব্যপ্রতিভা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর অসাধারণ পাণ্ডিত্য কেবল ভারতবর্ষই নয়, সমসাময়িক দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তার রচিত পুস্তক 'খেত কাওতুকাম' এবং 'দাওয়াউইসথ ইউগাভানি' জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কেয়ামত পর্যন্ত মানুষের প্রশংসা কুড়াবে। ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি তুলসী দাস ছিলেন তার ব্যক্তিগত পরম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বারানসির গঙ্গাতীরে বসে দুই বন্ধু একসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বহু বিখ্যাত কবিতা রচনা করেছেন।
যা ভারতবর্ষের হিন্দুদের মুখে মুখে ধর্মীয় শ্লোক হিসেবে হররোজ উচ্চারিত হতে থাকে।
আমাদের হাভেলিতে এসে হিন্দু পণ্ডিতরা খানে খানান সম্পর্কে উপরোক্ত বক্তব্য প্রদান করল। এর বাইরে তার রাজসিক প্রভাব প্রতিপত্তি তো ছিলই। এমন একজন বিরাট মাপের মানুষ আমাদের ক্ষুদ্র হাভেলিতে প্রায় এক সপ্তাহ থাকবেন, তা আমার আব্বাজান কল্পনাই করতে পারছিলেন না। অতিরিক্ত উত্তেজনা আনন্দ আর খুশির ধাক্কায় আব্বাজানের খাওয়া-দাওয়া, ঘুম ও বিশ্রাম হারাম হয়ে গেল।
তিনি একদিন হঠাৎ সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললেন। কবিরাজ অনেক চেষ্টা-তদবির করার পর আব্বাজান সুস্থ হলেন বটে, কিন্তু অজানা কারণে কয়েকদিন বাকরূদ্ধ হয়ে রইলেন। আমাদের জেনানা মহলে কান্নার রোল উঠল। এই সময়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন স্থানীয় মোগল সুবেদার মির্জা খলিল। তিনি আব্বাজানকে এই মর্মে নিশ্চিত করলেন যে, খানে খানানকে অতিরিক্ত সম্মান কিংবা আদর-যত্ন করার দরকার হবে না।
কারণ তিনি খুবই বাস্তববাদী এবং মরমী সাধক প্রকৃতির মানুষ। বেশি বাড়াবাড়ি করলে তিনি হয়তো বিরক্ত হতে পারেন। সুবেদার চাচা আব্বাকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ জানিয়ে পুরো আয়োজনের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিলেন।
খানে খানানকে ফুল দিয়ে বরণ করার দায়িত্ব অর্পিত হলো আমার প্রতি এবং আমাকে সাহায্য করবে আমার সহেলী জেবুনি্নসা যার কথা ইতোপূর্বে আপনাকে বলেছি। আমার সহেলী জেবুনি্নসার বাস্তব বুদ্ধি আমার চেয়ে বেশি ছিল।
তার পিতার চাকরি উপলক্ষে গত ১০ বছরে তারা হিন্দুস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করেছে। অনেক লোক দেশ এবং মানুষের আচার-আচরণ সম্পর্কে সে আমাকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলত যেগুলো ছিল বেশ আকর্ষণীয় এবং কৌতূহলী। সে আমাকে যৌন জীবন সম্পর্কে নানা রসাত্দক কথাবার্তা বলত যার বেশির ভাগই আমি বুঝতাম না। সে বলত আমার নাকি আর কিছুদিন পরই বুকের মাংস পিণ্ডগুলো উঁচু হয়ে উঠবে এবং তার দিকে সব পুরুষ তাকিয়ে থাকবে। পুরুষরা নাকি ভারি বজ্জাত প্রবৃত্তির- তারা সুযোগ পেলে কিশোরী মেয়েদের আদর স্নেহ করার উসিলায় কাছে ডেকে নেয়।
প্রথমে মাথায় হাত বুলায়, তারপর সুযোগ পেলে বুকে হাত দেয় এবং শরীরের অন্যান্য স্থানে খোঁচা দেয়। আমাদের হাভেলী বা পার্বত্য অঞ্চলে মেয়েরা অবাধে ঘুরে বেড়ায় দিন রাতের সব সময়। কিন্তু জেবুনি্নসার বর্ণনা মতে কোনো কথা আমি জীবনে শুনিনি।
আমার সহেলীর বয়স আমার সমান হলেও তার আভিজাত্য শিক্ষাদীক্ষা এবং সততা আমাকে মুগ্ধ করত। আমি প্রতি মুহূর্তে তাকে কাছে পেতে চাইতাম।
কিন্তু তার পিতা অর্থাৎ আমাদের সুবেদার চাচার কঠোর অনুশাসনের জন্য তা সব সময় সম্ভব হতো না। খানে খানানের আগমন উপলক্ষে আমাদের দুটো পরিবার ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ পেল। আর তখনই জানলাম জেবুনি্নসা আগামী ২/১ মাসের মধ্যে মোগল হেরেমে চলে যাচ্ছে রাজকীয় কয়েদা কানুন শেখার জন্য। আমার আম্মাজান এবং আম্মাহুজুর এই কথা শোনার পর পাগল হয়ে গেলেন আমাকেও জেবুনি্নসার সঙ্গে মোগল হেরেমে পাঠানোর জন্য। প্রতিটি জায়গীয়দার স্থানীয় অভিজাত সামন্তগণ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্থাব্যক্তিরা ছাড়াও পাশর্্ববর্তী দেশের রাজকন্যাদের অভিভাবকরা তাদের সবচেয়ে সুন্দরী এবং মেধাবী কন্যাটিকে মোঘল হেরেমের রয়্যাল একাডেমিতে পাঠানোর স্বপ্ন দেখতেন।
আমার আব্বাজান যখন তার মনের গোপন স্বপ্নটির কথা সুবেদার চাচার কাছে বললেন, তখন চাচা তাকে আমার বাণী শুনালেন এই কথা বলে যে, হয়তো আল্লাহর ইচ্ছাতেই আমাদের পরিবার বিরল সেই সম্মান পেতে পারে খানে খানানের অনুকম্পায়। কারণ কেউ চাইলেই তার কন্যাকে শাহী হেমেরের রয়্যাল একাডেমিতে পাঠাতে পারত না। প্রথমত মোগল দরবারের কোনো প্রথম সারীর সাত হাজারী আমিরের সুপারিশ সহকারে দরখাস্তটি একাডেমির অধ্যক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হতো। অধ্যক্ষ মেয়েটিকে দেখতেন এবং তার মেধা, পারিবারিক গঠন, বংশ মর্যাদা এবং মোগল খান্দানের সঙ্গে মেয়েটির পরিবারের সম্পর্কের ইতিবাচক দিকগুলোর চুলচেরা বিচার করে তার মতামত দিতেন। মতামত যদি ইতিবাচক হতো সে ক্ষেত্রে দরখাস্তটিতে হেরেমের কোনো মালেকাই আলেয়া বা রাজ মহীয়সীর অনুমোদন লাগত।
এ পর্বটি হলো সবচেয়ে কঠিন। কারণ কোনো সম্রাজ্ঞীই এই দায়িত্ব নিতে চাইতেন না নিতান্ত বাধ্য না হলে। কারণ মেয়েটির খাওয়া-দাওয়া, নিরাপত্তা, শিক্ষাদীক্ষা, তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং সবশেষে মেয়েটিকে কর্মজীবনে প্রবেশ করানোর সব দায়িত্ব সম্রাজ্ঞীকেই নিতে হতো। এ ক্ষেত্রে মেয়েটি যদি সবদিক থেকে ভালো করত তবে সম্রাজ্ঞীর মানসম্মান বাড়ত আর তা না হলে বেইজ্জতীর সীমা থাকত না।
কেবল প্রধান রাজমহীয়সী সম্রাটের সঙ্গে কেন্দ্রীয় রাজপ্রাসাদে থাকতেন।
অন্যান্য রাজমহীয়সী আলাদা আলাদা প্রাসাদে থাকলেও সব প্রাসাদই একক হেরেম হিসেবে অনুমোদিত হয়ে একই ধরনের আইনের দ্বারা পরিচালিত হতো। কিছু কর্মকর্তা সম্রাজ্ঞীর ইচ্ছায় নিয়োগ হলেও বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীই ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবালয় কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের নিয়ন্ত্রণ, বেতনভাতা, পদোন্নতি সবই ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। এই অবস্থায় রাজমহীয়সীর অনুমোদন পাওয়ার জন্য দরবার এবং হেরেমের উঁচু-নীচু বহু কর্তা-কর্তার আনকুল্য এবং সহযোগিতার দরকার হতো। কখনো কখনো এ কাজে বড় রকমের ঘুষের লেনদেনও হতো।
সুবেদার চাচার কাছে এত্তো সব ফিরিস্তি শোনার পর আমার আব্বা এবং আম্মাহুজুর হতাশ হয়ে পড়লেন। কিন্তু চাচাজান যখন আশ্বাস দিলেন যে, ফতেপুর সিক্রির দরবার এবং হেরেমের যাবতীয় ঝক্কি-ঝামেলার দায়িত্ব তিনি নেবেন যদি খানে খানানের সুপারিশ জোগার করা সম্ভবপর হয়। এই কথা শোনার পর আমার আব্বাজানের শুরু হলো নতুন এক উদ্বেগ। তিনি যে কোনো মূল্যে খানে খানানকে খুশি করতে চাইলেন।
[ চলবে ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।