হাম্মাম থেকে আফসানা বলতে গেলে খুব তাড়াহুড়া করেই তার কামরায় ফিরল। তারপর নিজেকে সুন্দরতম পোশাকে আবৃত করল। পারস্য দেশীয় আতর আর সুরমা মেখে নিজেকে আয়নার সামনে তুলে ধরল। তার প্রিয় বাঁদিটি এসে খোঁপায় কয়েকটি গোলাপ গুঁজে দিল। প্রফুল্ল মনে আফসানা বিছানার ওপর মখমলের বালিশে হেলান দিয়ে মহা উৎসুক্য নিয়ে জিজ্ঞাসা করল- কই সেটি কোথায়।
মৃদু হেসে বাঁদিটি বলল- আমার আলিয়া! অধীর হবেন না। অনুগ্রহ করে কিছু মুখে দিয়ে নিন। সারা দিন আপনি কিছুই খাননি। আপনার মুখ বড্ড ফ্যাকাসে লাগছে! চোখ দুটি কোটরাগত, মনে হচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে আপনি সব অশ্রু ঝরিয়ে ফেলেছেন! চোখের উদাস দৃষ্টি আর সকরুণ চাহনি আমাদের ভীষণভাবে আহত করছে- মনে হচ্ছে আমরা সব কিছু হারিয়ে সাহারা মরুভূমির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি।
আফসানা অবাক দৃষ্টিতে বাঁদিটির দিকে তাকাল, তারপর হৃদয়ের শত বেদনার মধ্যেও এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করল।
মনে হলো, হ্যাঁ অন্তত একজন মানুষকে পাওয়া গেল, যে তাকে নিয়ে তার শরীর নিয়ে তার ভালোমন্দ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। আজ আট বছরেরও বেশি সময় পার হতে চলল, যে সময়ে আফসানা বালিকা থেকে কিশোরী হলো, আবার কিশোরী থেকে যুবতী। আজ তার খুব মনে পড়ছে মায়ের কথা। মনে হচ্ছে, মা যদি কাছে থাকতেন তাহলে মায়ের কোলে মাথা রেখে সে প্রাণভরে অনেকক্ষণ কেঁদে-কেটে মনের জ্বালা নিবৃত করতেন। এ কথা সে কথা এলোমেলোভাবে ভাবতে ভাবতে আফসানা বাঁদিটির মুখের দিকে তাকাল।
অসম্ভব সুন্দরী। বয়স হয়তো তার চেয়ে ২/৩ বছরের বড় হবে। চেহারা সুরতে তাকে বেশ অভিজাত বলেই মনে হচ্ছে। আফসানা জিজ্ঞাসা করল, কি নাম তোমার?
আফসানার প্রশ্ন শুনে বাঁদিটি মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল। তারপর বলল, আমার নাম জায়েদা।
গত সাত বছর ধরে আমি হেরেমে কাজ করছি। এর আগে আমি কিছুদিন মেহেরুন নিসা নামক একজনের সেবা করেছি। যিনি ছিলেন আপনারই মতো সুন্দরী এবং অভিজাত। এরপর জায়েদা- অন্য বাঁদীদের ডেকে পরিচয় করিয়ে দিল। ইতোমধ্যে কিছু ফলমূল এবং শরবত আফসানার সম্মুখে পেশ করা হলো।
আফসানা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু গ্রহণ করল এবং নিজের শরীরের হারানো শক্তি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করল। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে খাবার গ্রহণের পর সহজাত কারণেই আফসানার মন কিছুটা সতেজ হয়ে উঠল আগের তুলনায়। এবার সে মুখে কোনো কথা না বলে জায়েদার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল আর জায়েদাও বুদ্ধিমতীর মতো সেই মহাকাঙ্ক্ষিত জিনিসটি আফসানার হাতে দিল।
আফসানা জায়েদার হাত থেকে জিনিসটি নিয়ে প্রথমে বুকে চেপে রাখল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর সেটিকে তুলে ধরে চুমো দিল একবার, দুবার, বহুবার।
আবার তা বুকে চেপে ধরল। বুক থেকে উঠিয়ে চোখের সঙ্গে ছোঁয়াল। নাকের কাছে নিয়ে আচ্ছামতো ঘ্রাণ নিল। হ্যাঁ ঠিকই তো আছে, একই ঘ্রাণ ঠিক যেমনটি অনুভব করেছিল গত কয়েকদিনে, বিশেষত কাল রাতে। বস্তুটি মোড়ানো ছিল একটি রেশমি কাপড়ে।
কাপড়ের ওপর সেঁটে দেওয়া হয়েছিল শাহজাদা সেলিমের ব্যক্তিগত সিলমোহর আর নিচে লিখে দেওয়া হয়েছিল একান্ত ব্যক্তিগত। শাহজাদা সেলিম শাহী দরবারে পৌঁছে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে মহামতি সম্রাট আকবরের সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্ব সমাপ্ত করে তার নিজ মহলে পেঁৗছেন ত্বরিত গতিতে। পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আগ পর্যন্ত তিনি সে মহলেই ছিলেন। গত কয়েক মাসের ব্যবধানে তার কাছে সব কিছু যেন কেমন ফ্যাকাসে, অদ্ভুত আর অচেনা মনে হতে লাগল।
শাহজাদা তার মহলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দেখলেন পাত্র-মিত্র, পাইক-পেয়াদা এবং পরিবারের লোকজন দাঁড়িয়ে আছে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।
তার প্রধান ও প্রথমা স্ত্রী, রাজপুত, রাজদূহিতা মনভাবতীও রয়েছেন। সকরুণ নেত্রে তিনি স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাহজাদা কাছে আসতেই মনভাবতী মাথা নুইয়ে কুর্নিশ জানালেন। সঙ্গে সঙ্গে হেরেমের বাসিন্দারা শাহজাদার মাথায় পুষ্প বৃষ্টি বর্ষালেন। শাহজাদা অন্তপুর বাসিনীদের সংবর্ধনা গ্রহণ করে তার খাস কামরায় প্রবেশ করলেন এবং নির্দেশ দিলেন বিকেল পর্যন্ত কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে।
তারপর লিখতে বসলেন পত্র- প্রিয়তম আফসানার কাছে। চিঠি লেখা শেষ হলে তিনি তাতে সিলমোহর করে বিশেষ দূতের মাধ্যমে আফসানার বাসস্থান রুকাইয়া সুলতান বেগমের হেরেমে পাঠিয়ে দিলেন।
শাহজাদার দূত যখন আফসানাদের মহলে পেঁৗছল তখন আফসানা ছিল হাম্মামখানায়। ফলে সে স্বাক্ষর করে চিঠিটি গ্রহণ করতে না পারলেও তার পক্ষে জায়েদা সেটি গ্রহণ করে এবং আফসানার কাছে খবরটি পেঁৗছে দেয়। শাহজাদা এত অল্প সময়ের ব্যবধানে তাকে চিঠি লিখবেন এমন স্বপ্ন বা সাধ আফসানার কখনো ছিল না।
ফলে শাহজাদার বিরহে তার ভেতরে যে অসীম শূন্যতা এবং বেদনার হাহাকার শুরু হয়েছিল চিঠি প্রাপ্তির পর তা অনেকটা কেটে যায়। সে চিঠিটা খোলার আগে আশপাশে তাকাতে থাকে। অভিজ্ঞ দাসী-বাঁদিরা বিষয়টি টের পেয়ে মুহূর্তেই সেখান থেকে উধাও হয়ে যায়। আফসানা এবার পড়ার জন্য চিঠিটা খুলল। শাহজাদা সেলিম লিখেছেন-
আমার কলিজার টুকরা আফসানা-
আমার মনের যে অবস্থা তা বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই।
পৃথিবীর কোনো সাহিত্য বিরহী প্রেমিকের মনের আকুতি পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পেরেছে কি-না, আমার জানা নেই। আমার এও জানা নেই কোনো কাব্য, মহাকাব্য; কিংবা উপাখ্যান হৃদয়ের গভীর ক্ষত থেকে সব বেদনা টেনে বের করে কাগজের ওপর কালির ছাপ দিয়ে প্রকাশ করতে পেরেছে কিনা। কি করে বোঝাই তুমি আমার কী হও! আমার হৃদয়-মনের কোন জায়গায় তুমি বাসা বেঁধেছ; কিংবা হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি ধমনি এবং সেখানকার মাংসপিণ্ডের কম্পনের সঙ্গে তুমি যে কিভাবে মিশে আছ তা প্রকাশের ভাষা আমি এ মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছি না। কেবল বলতে ইচ্ছে করছে, চাই না কোনো রাজ্যপাট, সিংহাসন কিংবা রাজদণ্ড। চাই কেবল আফসানাকে- আমার সোনার আফসানা! আমার প্রাণের আফসানা এবং আমার কলিজার টুকরা আফসানা।
কথা দিচ্ছি প্রিয়_ যদি কখনো আসে কোনো শুভক্ষণ আমি তোমায় নিয়ে ঘর বাঁধব। কখনো প্রাসাদে আবার কখনো সুন্দর গ্রামের কোনো এক কুটিরে কিংবা বিশাল কোনো বনভূমির একদম কিনারে। আমি কল্পনা করছি, কোনো এক গাঁয়ের পশ্চিম প্রান্তে বয়ে চলা খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর তীরে, আমাদের স্বর্ণ কুটির। মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত থাকবে না সেথায়; কিন্তু স্বর্ণের মতো জ্বলজ্বলে রোদ যা আমরা উপভোগ করব সকালে এবং বিকালে। আবার কখনো-সকনো মধ্য-দুপুরে।
পাহাড়ি নদীতে জলকেলি শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমরা যখন স্বর্ণ কুটিরে ফিরব তখন হয়তো সূর্য খানিকটা হলেও পশ্চিম দিকে ঝুঁকে পড়বে। আমাদের কুটিরের দক্ষিণের জানালা দিয়ে হু হু করে নির্মল পাহাড়ি বাতাস এসে ক্লান্ত শরীরে ঘুমের পরশ ছড়াতে থাকবে। ছোট্ট একটি মাটির সানকিতে সাধারণ কিছু খাবার দু'জনে ভাগাভাগি করে খেয়ে নিজেদের সঁপে দেব নিরন্তর প্রকৃতির কোলে।
আজ আমার হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে কেবল তোমারই ছবি এবং প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি।
তোমার গায়ের সুরভিত গন্ধ, তোমার শরীরের সুকমল স্পর্শের অনুভূতি এবং তোমার গভীরে গ্রথিত হওয়ার সেসব মুহূর্ত আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে। গত রাতে তোমাতে আমাতে যা হয়েছিল তা তো আমার জন্য নস্যি বলেই মনে হতো এতদিন। নারী-পুরুষের সহজাত মিলনের মধ্যে আমি ক্ষণিকের উত্তেজনা এবং মুহূর্তের কম্পন এবং তারপর নিঃশেষ হয়ে নিস্তেজ হওয়াকেই স্বাভাবিক মনে করতাম। তার কারণও অবশ্য ছিল। জীবনে শত শত নারীর সানি্নধ্যে এসেছি এবং বুঝেছি খুব অল্প কয়েকজনই আমাকে হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবেসেছে।
আমি সব সময় ভালোবাসার সেই রুনু ঝুনু শব্দ হৃদয়ে ধারণ করে চলেছি। কিন্তু অন্য নারীরা তো আমাকে ভালোবাসেনি। তারা শুধু আমার ইচ্ছার কাছে নিজেদের শরীর বিসর্জন দিয়েছে। কেউ কেউ ভয়ে আবার কেউ কেউ লোভের কবলে পড়ে। সে সব নারীদেহ কখনো আমাকে তৃপ্তি দিতে পারেনি।
আমি মিলিত হয়েছি বটে কিন্তু প্রবল বিরক্তিতে কখনো কখনো নিজেকে প্রবিষ্ট করানোর পরও গুটিয়ে এনেছি। ওই দেহের নিঃশব্দ লোভ আর আকুতি আমার শরীরের নিঃস্বরণ ঘটাতে পারেনি। যে দিন এমনতরো ঘটনা ঘটত সেদিন কিংবা তার পরবর্তী কয়েকদিন আমি থাকতাম ভীষণ বিষণ্ন এবং ব্যথিত।
আমার জীবনের বহুগামিতা আমাকে এক ধরনের স্থিরতা দান করেছে। কোনো নারীই আমার শরীরকে উত্তেজিত করতে পারে না।
আমার নফস এখন আর অসংখ্য নারীর খোঁজে আমাকে ব্যস্ত রাখে না। আমার দৃষ্টিশক্তি এখন আর কাজকর্ম ফেলে নারীর দিকে ধাবিত হয় না। প্রচণ্ড ক্লান্তি কিংবা প্রচণ্ড সুখের সময় আমার শরীর নারীসঙ্গ লাভের জন্য উতলা হয়ে ওঠে না। অথচ পুরুষ মানুষের স্বাভাবিক চরিত্র কিন্তু এটা নয়। পুরুষ চায় নারী; শুধু নারী; অনেক অনেক নারী; সুন্দরী সুন্দরী নারী।
পুরুষের শরীর যদি নারীসঙ্গ লাভের উপযুক্ত নাও হয় তবুও সে নারীর সানি্নধ্য চায়। নারীকে সম্ভোগ করতে না পারলেও স্পর্শ করতে চায়। আবার স্পর্শ করতে না পারলেও ঘ্রাণ নিতে চায়। আর কিছুই না পারলেও দেখতে চায় দুচোখের উদাসী দৃষ্টি মেলে। পুরুষ একান্ত অবসরে নারীর কথা কল্পনা করে এবং সীমাহীন নিঃসঙ্গতার মাঝেও স্বপ্ন বাসর রচনা করে দিনে কিংবা রাতে গভীর ঘুমের মাঝে! আমি যখন টের পেলাম নারীতে আমার সাধ নেই।
তখনই মনের মধ্যে অন্য উচ্চাশা দানা বেঁধে উঠল- আমার রাজ্য চাই, সিংহাসন চাই আর অনেক অনেক ক্ষমতা চাই। আমি প্রচণ্ড এক অস্থিরতার মধ্যেই আব্বা হুজুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলাম। আজ আমার দুটো বিষয় মনে পড়ছে। এক. কোনো রাজা-বাদশাহ অন্য সাধারণ গৃহস্থের মতো তাদের ছেলেমেয়েকে মদ্যপান কিংবা একাধিক নারীর সঙ্গে রমণে বাধা দেন না! দুই) রাজপুত্ররা কেনইবা পিতার সিংহাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। আমি এসব বিষয়ে চিন্তা করতে করতে একটি অনুসিদ্ধান্তে পেঁৗছে গিয়েছিলাম।
হয়তো কবিতাও লিখে ফেলতাম কিন্তু তোমার সানি্নধ্য, আমার জীবনের সাম্প্রতিক সব হিসাবপত্র তছনছ করে দিল। এখন আমি একেবারেই নিঃস্ব যখন মনে করি তুমি নেই। আবার যখন মনে করি, তুমি আমার কেবল একান্তই আমার। তখন একটি কুটিরই আমার কাছে ফতেপুর সিক্রির শাহী প্রাসাদের চেয়েও অনেক বড় বলে মনে হয়।
পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম- নাহ আর কোনো নারী নয়; কিংবা নারীর সঙ্গ লাভের পেছনে সময় ও অর্থ কোনোটিই ব্যয় করব না।
নারীর প্রেমই আমাকে সর্বনাশ করেছে। নারীই আমাকে বিদ্রোহী হতে প্ররোচিত করেছে। করেছে আমাকে মাদকাসক্ত! আমি ভুলতে পারি না আনারকলিকে। আবার মনভাবতীর দেমাগও আমার ভালো লাগে না। রাত-বিরাতে প্রাসাদ চত্বরে বাঈজীদের নৃত্য আমাকে আনন্দ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
অন্যদিকে দেশি-বিদেশি সু্ন্দরী ললনাদের সঙ্গে সঙ্গমসুখ সবার জন্য স্বপ্ন হলেও কেন জানি আমার কাছে বড্ড পানসে এবং বিস্বাদ হয়ে উঠছিল। তাই তো বিদ্রোহের দাবানল জ্বালিয়ে দেহমনের কলঙ্কিত ক্ষতগুলো ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের পরাজয় এবং তোমার সানি্নধ্য আমার সবকিছু কেমন জানি ওলট-পালট করে দিল।
আম্মা হুজুরের প্রাসাদে আমাকে যখন নেওয়া হয়েছিল তখন আমি ছিলাম যুদ্ধাহত এবং সংজ্ঞাহীন একজন বিপন্ন মানুষ। চেতনা ফেরার পূর্বক্ষণের অনুভূতি এখনো আমার হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে।
আমি তখনো জানি না, আমি কোথায়! আমি তখনো চোখ মেলে দেখতে পারিনি যে, আমি কার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি! কিন্তু নরম একটি কোলের স্বাদ এবং সুগন্ধ আমাকে এমনভাবে আবিষ্ট করে তুলল, আমি বুঝতে পারলাম আমার পৌরুষ জেগে উঠেছে। আমি সম্বিত ফিরে পাওয়ার পরও ইচ্ছে করে চোখ মেললাম না। বরং তোমার কোলে মাথা গুঁজে আরও গভীর থেকে গভীরতর স্থানের সন্ধান লাভের আকাঙ্ক্ষায় এ পাশ ও পাশ করতে থাকলাম।
প্রবল আগ্রহ আর উদ্দীপনা নিয়ে আমি চোখ খুললাম। তোমার অপরূপ রূপ মাধুর্য দেখে আমি পাগল হয়ে পড়লাম।
গত কয়েকদিনে তোমার ছন্দময় কথার গাঁথুনি এবং জীবনালেখ্য শুনে আমার মন এই প্রথম কোনো নারীর প্রতি পরম শ্রদ্ধা, আবেগ আর ভালোবাসার সম্মিলনে প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ল। শাহজাদা সেলিম অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই তোমাকে প্রণতি দিতে চাইল। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার ভালোবাসার কোনো শক্তি ছিল না। ছিল না কোনো সামর্থ্যও। বার বার মনে হচ্ছিল, আমি একজন রাষ্ট্রদ্রোহী।
ধরা পড়লে হয়তো জেলে যেতে হবে, নয়তো মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হব। ফলে তোমার শত আকুতি আর আমাকে খুশি করার শতচেষ্টা আমাকে সঠিকভাবে উজ্জীবিত করতে পারেনি। তোমার সানি্নধ্যে বসে টের পেলাম, ভয়ের মধ্যে প্রেম-প্রণয় যেমন হয় না এবং ভয়ের সময় মানুষের সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করা যায় না। এ সময় মানুষ শুধু একজন আরেকজনের কাছে আশ্রয় খুঁজে ফিরে।
আমিও বোধহয় তোমার কাছে আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে তোমার মধ্যে নিজেকে বিলীন করে ফেলেছিলাম।
আমি যখন তোমার দিকে তাকাতাম মনে হতো, এ তো কোনো মানবী নয়! জান্নাতের কোনো হুর বা আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো পরী। তোমার হাতটি ধরে যখন আলতোভাবে চাপ দিতাম কিংবা প্রবল আবেগে বুকের কাছে টেনে নিতাম, আরও একটু শান্তির জন্য হাতটিকে আমার মুখমণ্ডলে ছোঁয়াতাম তখন প্রবল অনুরাগ আমার হৃদয়কে প্লাবিত করত। তোমার হাতের গঠন, বিশেষ করে নরম-মসৃণ ত্বক আর সরু আঙ্গুলগুলোর মাথার নখগুলো আমার কাছে ভীষণ ভালো লেগেছে। তোমার বুকে মাথা রেখে যখন নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছি তখন আমার পঞ্চ ইন্দ্রীয় একাকার হয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তোমাতে মিলিত হওয়ার সাধ জাগিয়েছে। সবশেষে আমরা যখন মিলিত হলাম তখনকার অনুভূতির সুখময় স্মৃতি হয়তো আমাকে সারাজীবনই বয়ে বেড়াতে হবে।
প্রিয়তম আমার! আমি সারা জীবন তোমার প্রেমে অধীর থাকব। কখনো ভুলব না। তুমিও আমাকে ভুলে যেও না। আল্লাহ চাইলে আমাদের হয়তো আবারও দেখা হবে কোনো একসময় যখন তুমি অত্যন্ত গৌরব আর সম্মানের সঙ্গে আমার পাশে অবস্থান করবে। শুভদিন না আসা পর্যন্ত আমি কাজ করে যাব।
আশা করি, তুমি সসম্মানে আম্মা হুজুরের সঙ্গেই থাকবে। তবুও কোনো কাজে, কিংবা অকাজে অথবা গভীর রাতের তারাভরা প্রেমময় আবেগে আমার কাছে পত্র লিখলে খুশি হব। অবশ্যই তুমি আমাকে তোমার প্রেম ভিখেরি হিসেবেই পাবে। ইতি- তোমারই সেলিম।
চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে আফসানা শাহজাদার পত্র পাঠ করল।
চিঠির প্রতিটি শব্দ এবং প্রতিটি অক্ষর যেন একেকটা জীবন্ত শাহজাদা সেলিম হয়ে আফসানার কামরা ভরে ফেলল। শাহজাদার শত শত মূর্তি আর সেসব মূর্তির সম্মিলিত ধ্বনি- আমার প্রিয় আফসানা, তোমায় ভালোবাসি, অনেক অনেক ভালোবাসি, কাছে এসো প্রিয়তম, আমায় আলিঙ্গন কর গভীর প্রণয় নিয়ে, আমাকে জড়িয়ে ধর_ এসব শব্দ আফসানার কামরার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। উদ্ভ্রান্তের মতো আফসানা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলল, সেলিম! আমার প্রাণের সেলিম! আমার সাহেবে আলম, আমি আসছি। মূর্ছা যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আফসানা চিৎকার করতে থাকল।
আফসানার প্রিয় বাঁদি জায়েদা দৌড়ে তার মালিকার কামরায় ঢুকল। দেখল আফসানার চৈতন্যহীন দেহ মেঝেতে পড়ে রয়েছে। সদ্য ঝরে যাওয়া ফুটন্ত বসরার গোলাপের মতো আফসানার নিথর দেহ সেখানে পড়ে আছে। চুলগুলো সব এলোমেলো, কাত হয়ে পড়ে আছে মর্তের মানবী হৃদয়ে জান্নাতি প্রেম ধারণ করে। হাত দুটি সামনের দিকে বাড়ানো, মনে হচ্ছে কাউকে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না।
অবচেতন দেহের কিছু অংশ তখনো সচল। দুই চোখ তখনো অঝোরে কাঁদছে। গোলাপি ঠোঁট দুটি বিড়বিড় করে কাকে যেন ডাকছে আর হাতের আঙ্গুলগুলো বার বার বাঁকা হয়ে ইশারায় কাকে যেন কাছে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। জায়েদা চিৎকার করে সবাইকে জড়ো করল। খবর পাঠানো হলো শাহী কবিরাজের কাছে।
হেরেমের মালিকা-এ আলিয়া সম্রাজ্ঞী রুকাইয়া সুলতান বেগমও খবর পেয়ে চলে এলেন। কিন্তু সবাই আসার আগেই ঘটনা শেষ হয়ে গিয়েছিল। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।