আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মোগল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম (২১ তম পর্ব)

শাহজাদা সেলিম কয়েক দিন ধরেই গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পরাজিত হয়ে তিনি দিল্লি-আগ্রা-জয়পুর ছেড়ে সুবে বাংলায় পালিয়ে আসতে চাইছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন এবং অনেকটা অলৌকিকভাবে তার সৎমা রুকাইয়া সুলতান বেগমের প্রাসাদে নীত হন। তার পরম শ্রদ্ধাভাজন আম্মা হুজুর কয়েকবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেছেন এবং এই মর্মে আশ্বাস দিয়ে গেছেন যে, তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন মহামতি সম্রাটের সঙ্গে সৃষ্ট বিরোধটি কূটনৈতিকভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য। আম্মা হুজুরের দক্ষতা, আন্তরিকতা আর প্রভাবের প্রতি তার আস্থা ছিল শতভাগ।

কিন্তু তারপরও অজানা শঙ্কায় মনটি দুলে উঠছে বারবার। এই ভয়ংকর অস্থিরতার মধ্যে আফসানার সানি্নধ্য তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ জন্য তিনি আফসানা এবং তাকে এমন করে শিক্ষিত করে তোলা শাহী হেরেমের শিক্ষিকা মণ্ডলীগণের কাছে কৃতজ্ঞ।

আফসানার মোহময় প্রেমের ইতিবৃত্ত তাকে গত কয়েক দিন ধরে অনবরত স্বপ্নজগতে বিচরণ করাচ্ছে। তিনি জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।

কিন্তু এখন জীবনকে তার পরম উপভোগ্য বলেই মনে হচ্ছে। মৃত্যু ভয়, গ্রেফতার আতঙ্ক কিংবা অপমানিত হওয়ার সব শঙ্কা আফসানার প্রেমের টানে বারবার ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজের অবুঝ মনের উজান ঠেলে ভয় আবার ফিরে আসছিল নানারকম সন্দেহ আর অবিশ্বাসের মায়াজালে। আফসানার সঙ্গে রঙ্গরসের লীলাখেলায় শাহজাদা যখন ভাসছিলেন ঠিক তখনই প্রাসাদের বাইরে সৈন্যবাহিনীর কোলাহল আর ঘোড়ার খুরের আওয়াজে তিনি হন্তদন্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলেন। নিজের পোশাক সংযত করে আফসানাকে জানালেন আসল ঘটনা জেনে আসার জন্য।

শাহজাদার হুকুম পেয়ে আফসানা ছুটল প্রাসাদের মূল ফটকের দিকে এবং কিছুক্ষণ পর মুখ গম্ভীর করে ফিরে এলো। উৎকণ্ঠিত শাহজাদা জিজ্ঞাসা করলেন ব্যাপার কি! কোনো দুঃসংবাদ। ওরা কি জেনে গেছে আমার অবস্থান। আফসানা মলিন মুখে উত্তর করল সাহেবে আলম! মহান আল্লাহ আপনার প্রতি রহমত বর্ষণ করুন। পরম সৌভাগ্যের ধ্রুবতারাগুলো তাদের সর্বোত্তম আলোটুকু আপনার প্রতি বর্ষণ করুক আর আপনার রাজ তিলক দিনকে দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হোক।

আপনার জন্য পরম সৌভাগ্য অপেক্ষা করছে। প্রাসাদের সামনের সৈন্যবাহিনী আপনার আম্মা হুজুরের সঙ্গে এসেছে শাহেন শাহের দরবার থেকে এবং সঙ্গে করে নিয়ে আসছে আপনার জন্য সাধারণ ক্ষমার এক শাহী ফরমান। সম্রাট আপনাকে আগামীকাল দরবারে ডেকেছেন বরণ করে নেওয়ার জন্য। কথা বলতে বলতে আফসানা অশ্রুসজল হয়ে পড়ল এবং শাহজাদার পায়ের কাছে বসে নিজের অশ্রুসিক্ত মুখমণ্ডল তার পায়ের সঙ্গে ঘষতে লাগল।

আফসানার হঠাৎ এই আচরণে শাহজাদা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন।

একদিকে মুক্তির আনন্দ আর অন্যদিকে প্রেয়সীর অদ্ভুত আবেগময় আচরণ সব মিলিয়ে তিনি বুঝতে পারছিলেন না এখন কী বলা উচিত কিংবা কী করা উচিত। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তার পর আফসানাকে দাঁড় করালেন নিজের সামনে আদর করে টেনে নিলেন বুকের মধ্যে। একহাত দিয়ে তাকে বুকে চেপে ধরে অন্য হাত দিয়ে চুলে বিলি কেটে দিলেন। তারপর মুখমণ্ডল, ঘাড়, অধর প্রভৃতি স্থানে হাত বুলিয়ে আদর করতে আরম্ভ করলেন।

এতে করে আফসানার কান্না আরও বেড়ে গেল। শাহজাদা বেশ বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কান্নার কারণ সম্পর্কে কিছু বলার জন্য।

শাহজাদার বুকে মাথা রেখে আফসানা বলল, আমার সাহেবে আলম। আজকের এ অবস্থায় আপনার মুক্তির সংবাদে আমি খুবই আনন্দিত। আবার আপনাকে হারানোর বেদনায় অস্থির হয়ে পড়েছি।

নিজেকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, আপনি আগামীকাল দরবারে উপস্থিত হলে শাহেন শাহ আপনাকে সাদরে গ্রহণ করে একটি সংক্ষিপ্ত সংবর্ধনার আয়োজন করবেন। তারপর আপনাকে নতুন পদ ও পদবি দিয়ে হয় লাহোর, কাবুল অথবা দাক্ষিণাত্যে পাঠাবেন। সে ক্ষেত্রে রাজকীয় সেনাবাহিনী প্রস্তুত করে রাখা আছে এবং আপনাকে আগামীকাল রাতের মধ্যেই হয়তো রাজধানী ত্যাগ করতে হবে। সম্রাট আপনাকে ক্ষমা করেছেন সত্য কিন্তু এই মুহূর্তে রাজধানীতে আপনার অবস্থান তিনি কোনো অবস্থাতেই নিরাপদ মনে করবেন না।

আমার অনুমান যদি সত্য হয়, সে ক্ষেত্রে আজকের রাতটিই আমাদের জীবনের শেষ সময়- হয়তো শেষ সাক্ষাৎ এবং শেষ মিলন। এ কথা ভাবতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না। আশা ছিল আপনার সঙ্গে আরও কিছুদিন থাকার সুযোগ পাব। আফসানার কথা শুনে শাজজাদারও মন ভারী হয়ে উঠল। তিনি একটি সুদীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস নিলেন এবং নিজের হতাশাকে আড়াল করার জন্য আফসানাকে আরও জোরে বুকে চেপে ধরলেন।

মানুষের মন আর দেহের সুতীব্র মাদকময় রসায়নে তারা উভয়েই সিক্ত হলেন। নারী-পুরুষের মিলনের আরাধ্য স্থানের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য শাহজাদা কিছুক্ষণের মধ্যেই ইতিউতি করতে থাকলেন। আফসানা সব বুঝল কিন্তু সাড়া দিল না। অস্ফুট স্বরে বলল হজুরে আলা, এ সময়টি আপনার জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ প্রাসাদকর্ত্রী মালেকা এ আলায়া আপনার মুক্তির পয়গাম যে কোন সময় এই কামরায় নিয়ে আসতে পারেন অথবা আপনার ডাক পড়তে পারে তার খাস কামরায় যাওয়ার জন্য।

এবার আপনিই সিদ্ধান্ত নিন আমাদের এখন কি করা উচিত।

আফসানার কথায় সম্বিত ফিরে পেলেন শাহজাদা। আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে খাটের ওপর বসলেন এবং আফসানাকেও পাশে বসার জন্য বললেন। তারপর আবার কি যেন মনে করে উঠে দাঁড়ালেন। এক পা দুই পা করে হেঁটে জানালার দিকে এগুলেন।

আবার ফিরে এলেন। তারপর বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আফসানার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবেন ঠিক তখনই কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা নকীব উচ্চস্বরে ঘোষণা করল হুশিয়ার। সাবধান মালেকা এ আলায়া, সালতানাতে মুঘলের নুর ই জজম সম্রাজ্ঞী রুকাইয়া সুলতান বেগম আসছেন। শাহজাদা এবং আফসানা উভয়েই উঠে দাঁড়ালেন। রাজ মহীয়সী কামরায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তারা মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলেন।

আজ সম্রাজ্ঞীকে যেমন উৎফুল্ল দেখাচ্ছে তেমনি তার অভিব্যক্তিত্বে চমৎকার এক রাজসিকতা ফুটে উঠেছে। তিনি কামরায় ঢুকেই আফসানাকে আদর করে বললেন কিগো আমার মেয়ে। আমার পুত্র কি তোমার সেবায় সন্তুষ্ট হতে পেরেছে। আফসানা কোনো উত্তর না দিয়ে পুনরায় মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করে একটু সরে দাঁড়ালো। তারপর বিনীত ভঙ্গিতে বললো মালেকা এ আলেয়া।

আমি কি এখান থেকে চলে যাব? আমার মনে হচ্ছে সাহেবে আলমের সঙ্গে আপনার কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

আফসানার কথার উত্তরে মুচকি হেসে সম্রাজ্ঞী বললেন না থাক! তোমাকে যেতে হবে না। যদিও আমার কথা অত্যন্ত গোপনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তুমি এখান থেকে চলে গেলে সেই কথার গুরুত্ব এবং গোপনীয়তার ভার নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া তোমরা যারা হেরেমের বাসিন্দা তাদের কাছে সালতানাতের কোনো কিছুই গোপন রাখার দরকার নেই।

তোমাদের এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে বাকি জীবন যেখানেই থাক না কেন এই হেরেমের প্রতিটি ইট-পাথর, চুন আর সুরকি তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে যাবে তোমরা এই সালতানাতেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তা ছাড়া আমি বৃদ্ধ হয়ে গেলেও তোমাকে বুঝতে হবে কোনো এক সময় আমারও যৌবন ছিল। আমি বুঝতে পারছি আমার জেরুন পুত্রের মন এবং মানসিকতা এই মুহূর্তে কেবল তোমাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। কাজেই তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে বললে আমার পুত্র কষ্ট পাবেন এবং তখন আমার কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথাই তার কাছে আর গুরুত্ব পাবে না।

সম্রাজ্ঞী এবার হাসিমুখে শাহজাদার সামনে গেলেন।

শাহজাদা পরম শ্রদ্ধায় প্রাণপ্রিয় আম্মা হুজুরকে পুনরায় কুর্নিশ করলেন এবং সম্মানিতা জননীর ডান হাতটিকে টেনে নিয়ে চুমু খেলেন তারপর তাকে খাটের ওপর বসিয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলেন সম্মানিতার বক্তব্য শোনার জন্য। সম্রাজ্ঞী বললেন- শোন সেলিম! আল্লার অশেষ রহমত আর কৃপার কল্যাণে শাহেন শাহ তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং সেই কথা তুমি ইতিমধ্যেই শুনেছ। আমি যতটুকু জানি তোমাকে আগামীকাল দশহাজারী মনসবদার হিসেবে রাজকীয় বাহিনীর চৌকস একটি দলের কমান্ড হস্তান্তর করা হবে এবং কাল রাতেই সৈন্য বাহিনীসহ তোমাকে লাহোরের দিকে রওনা হতে হবে।

তোমার মা হিসেবে আমি তোমার এই নতুন নিয়োগে যারপরনাই খুশি। আমি আরও খুশি এ কারণে যে, সম্রাট অচিরেই রাজকীয় ফরমান জারি করে তোমাকে সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে সম্মত হয়েছেন।

ফলে তোমার স্ত্রী, শ্বশুরকুল এবং রাজপুত মামারা তোমার বিরুদ্ধে এতকাল যে চক্রান্ত করে আসছিল তোমারই শিশু সন্তানকে তোমার পরিবর্তে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বানানোর- তা আজ বানচাল হয়ে গেল। আমার প্রায়প্রিয় সন্তানকে আজ আর কোনো উপদশে দিব না কেবল মুঘল সালতানাতের ভবিষ্যৎ সম্রাট হিসেবে প্রথম আনুগত্য দেখিয়ে আমি একটি কুর্ণিশ করে এখন বিদায় নেব। এ কথা বলেই সম্রাজ্ঞী উঠে দাঁড়ালেন এবং সন্তানকে কুর্নিশ করার পর জড়িয়ে ধরলেন। শাহজাদা তার মায়ের পা ছুঁয়ে কদমবুচি করলেন। সম্রাজ্ঞী কামরা থেকে বের হওয়ার পূর্বে মুচকি হেসে বলে গেলেন প্রিয় সেলিম, আগামীকাল দরবারে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দ আর আশার আলো জ্বালিয়ে কাটাতে চেষ্টা করো।

যেন আগামীকাল দরবারে তোমাকে উজ্জীবিত এবং প্রাণোচ্ছ্বল রাজকুমার হিসেবেই লোকজন দেখতে পায়। মনে রাখবে তোমার চোখে-মুখে যদি কোনো হতাশার ছাপ ফুটে উঠে তোমার প্রতিপক্ষরা তৃপ্তি লাভ করবে এবং আপনজনরা ভেঙে পড়বে। শাহজাদা মাথা নুইয়ে পুনরায় সম্রাজ্ঞীকে কুর্নিশ জানালেন এবং কামরাটির দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়ে আফসানার কাছে ফিরে এলেন।

হঠাৎ করেই শাহজাদার মন ভালো হয়ে গেল। আফসানাকে প্রাণবন্ত মনে হলো।

তিনি আফসানাকে পুনরায় আলিঙ্গন করে পাগলের মতো আদর করতে লাগলেন। সেই আদরে মাধুর্য ছিল কিন্তু কোন বন্যতা ছিল না। আফসানাও নিজেকে রাজপুরুষের বাহুবন্ধনে সমর্পণ করে চোখ বুঝে ভালোবাসার স্বাদ আস্বাদন করতে লাগল। এরপর শাহজাদা তার অষ্টাদশী প্রণয়িনীকে কোলে তুলে নিলেন এবং সারা কামরা বর্গাকারে ঘুরতে লাগলেন। একবার কোল থেকে বিছানায় রাখেন আবার ঘাড়ে তুলে নেন এবং কিছুক্ষণ পর পিঠের ওপর তুলে নিয়ে কামরার মধ্যে পায়চারি করতে করতে ওমর খৈয়ামের কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন।

প্রেমের আবেগে শাহজাদা আর আফসানা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান ঊধর্্বালোকে। কখনো মনে হতে থাকে তিনি প্রেয়সীকে নিয়ে জাদুর কার্পেটে করে আকাশে উঠছেন, কিংবা সিন্দাবাদের মতো কোনো শান্তস্নিগ্ধ নীল সাগর পাড়ি দিচ্ছেন মোহময় স্বপি্নল চাঁদনী রাতে অথবা ধূসর মরুভূমিতে আরবি সাহিত্যের কিংবদন্তি কবি ইমরুল কায়েসের মতো খোলা আকাশের নিচে তারার মেলায় প্রেয়সীকে নিয়ে বাসরশয্যা রচনা করেছেন।

শাহজাদা এতক্ষণ তার প্রণয়িনীর সঙ্গে প্রেমলীলা করতে করতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। তিনি এবার আফসানাকে লম্বা করে বিছানার ওপর শুইয়ে দিলেন। নিজ হাতে প্রেয়সীর পরিধেয় বস্ত্র সংযত করে দিলেন।

মাথার চুলগুলো ঠিক করে বুকের ওপরের ওড়নাটি পরিপাটি করে গুছিয়ে দিলেন। তারপর দুই গ্লাস ঠাণ্ডা পানি পান করলেন। প্রাণভরে দেখতে লাগলেন মর্তের হুরকে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তৃপ্তি যেন আর মিটতেই চায় না। একবার মনে হয় পা সুন্দর।

আবার মনে হয় হাঁটু, গ্রীবা ও ঊরু সন্দুর। নাহ! কোমরই বেশি সুন্দর। কিন্তু তলপেট, নাভী, পেট কিংবা বুক পার হয়ে যখন গণ্ডিদেশের দিকে নজর যায় তখন শাহজাদা দ্বিধায় পড়ে যান- কোনটার চেয়ে কোনটা বেশি সুন্দর। এরপর নজর দেন মুখমণ্ডলে। ঠোঁট, চোখ, ভ্রূ, গাল, ললাট- উফ! শাহজাদা আফসানার ওপর শুয়ে অনেকক্ষণ চোখ বুঝে রোমন্থন করতে থাকেন তার অপরূপ দেহসৌষ্ঠব এবং অসাধারণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর মোহনীয় ও কোমনীয় সৌন্দর্যের সুধারসের ভাবাবেগকে।

আফসানার ওপর থেকে নেমে এবার তার পাশে কাত হয়ে মুখোমুখি শুয়ে পড়লেন শাহজাদা। বললেন প্রিয় আফসানা আমাদের সময় খুবই কম। দিনের অবশিষ্ট বেলাটুকু এবং রাতের কিয়দাংশ যতক্ষণ আমরা জেগে থাকতে পারব ততক্ষণই হয়তো আমরা সুযোগ পাব এক অপরকে ভালোবাসার এবং একে অপরের কথা শোনার। কাজেই প্রতিটি মুহূর্ত আমি সুচারুরূপে কাজে লাগাতে চাচ্ছি। আমি প্রথমে তোমার জীবনের অসমাপ্ত কাহিনী যা তুমি শুরু করেছিলে তা শুনতে চাচ্ছি এবং বিদেয় বেলায় তোমার দুটো ইচ্ছা পূরণের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছি।

এখন তুমি তোমার কাহিনী পুনরায় শুরু করতে পার যদি না কোনো অসুবিধা বা আপত্তি না থাকে-

আফসানা শাহজাদার মুখমণ্ডলে তার কোমল হাতের স্পর্শ দিয়ে বারবার আদর করতে থাকল এবং বলল আমার আশা, আমার মালিক- এই বাদীর জন্য এর চেয়ে আর কিইবা পরম সৌভাগ্যের বিষয় হতে পারে না যে হিন্দুস্তানের মহান সাহেবে আলম আমার মতো অখ্যাত নারীর জীবন কথা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন! কাজেই আমি বলব যা আমি জানি এবং তাও বলব যা আমি শিখেছি এবং সবশেষে তাও বলব যেসব বিষয়ে আমি দক্ষতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছে। আর আপনি যে আমার দুটি ইচ্ছা পূরণের কথা বলেছেন তাও বলব যথাসময়ে।

আমি বলছিলাম আমার বাল্যজীবনের কথা- কিভাবে আমি আমার জন্মভূমি থেকে আগ্রা মহানগরীতে এসে পৌঁছলাম। তারপর আমার শিক্ষয়িত্রী খানজালা আমাকে শিক্ষা দিতে লাগলেন আগ্রার ইতিহাস, ঐতিহ্য আর আকাশ-বাতাস সম্পর্কে। নগরের শাসনকর্তা ইমতিয়াজ খানের প্রাসাদে নির্দিষ্ট সময়ে থাকার পর আমাকে আনা হলো সম্রাজ্ঞী রুকাইয়া সুলতান বেগমের প্রাসাদে, যেখানে আমি আজ অবধি আছি।

মোগল হেরেমে গত ৮টি বছর ধরে যা শিখছি তা বাইরের মানুষের কাছে যেমনি অজানা তেমনি কৌতূহলী এবং ক্ষেত্র বিশেষে ভয়ঙ্কর বলে মনে হতে পারে।

শাহেন শাহ এ আলা জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর যখন ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভ করে দিলি্ল এলেন, তখন তিনি সুলতানী আমলের শানশওকত দেখে তাজ্জব বনে গেলেন। দিলি্ল, আগ্রা, লাহোর প্রভৃতি নামকরা রাজদরবার, হেরেম এবং পার্শ্ববর্তী সেনাছাউনি বা ক্যান্টনমেন্টসমূহের বিধিবদ্ধ আইন-কানুন, আভিজাত্য এবং ঐতিহ্য তাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করল। গজনীর সুলতান শিহাবউদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী ১১৯২ সালে দ্বিতীয় তারাইনের যুদ্ধে জয়লাভ করে ভারতবর্ষের মুসলিম শাসনের ভিত্তিস্থাপন করেন। এরপর একের পর এক যুদ্ধ জয় করে ১২০৬ সালের মধ্যে উত্তর ভারতের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেন।

১২০৬ সালে কুতুবউদ্দিন আইবেককে ভারতবর্ষের সুলতান নিয়োগ করে তিনি গজনীতে ফিরে যান। সেই থেকে আজ অবধি প্রায় সোয়া ৩০০ বছর হতে চলল, এর মধ্যে কত রাজা এলেন, কত রাজা গেলেন কিন্তু রাজনীতি পরিবর্তন হয়নি বরং দিনকে দিন উন্নত থেকে উন্নতর হয়েছে।

মহামতি বাবর ভারত বর্ষের শাসন ক্ষমতা লাভ করার পর চমৎকার একটি বেসামরিক প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং পুলিশ বিভাগ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে গেলেন। আর পেলেন অসাধারণ সুন্দর কতগুলো হেরেম যা কিনা রাজ পুরুষগণের সব কর্মের প্রেরণা হিসেবে কাজ করছিল। সম্রাটের ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নাম ছিল বাবুরী।

তিনি বাল্যকাল থেকে সম্রাটের সঙ্গে ছিলেন এবং জীবনের সব দুঃসাহসী অভিযানে তার পাশে ছায়ার মতো লেগে ছিলেন। তিনি ছিলেন অতিশয় জ্ঞানী, আত্দমর্যাদাসম্পন্ন বীর এবং সামরিক বিশেষজ্ঞ। একটি যুদ্ধের ময়দানে সম্রাটের সঙ্গে তার মতনৈক্য হলে তিনি কৌশলে সম্রাটকে ছেড়ে চলে যান। এরপর থেকেই সম্রাটের জীবনে একের পর এক ভাগ্য বিপর্যয় ঘটতে থাকে। তিনি দিনকে দিন নিঃস্ব হতে হতে কেবল পথের ফকির হতে বাকি ছিলেন।

অন্যদিকে বাবুরী কাবুল কান্দাহার পাড়ি দিয়ে আনাতোলিয়ায় চলে যান এবং উসমানিয়া সুলতান বা অটোম্যান সম্রাটের অধীন সৈনিক হিসেবে চাকরি দেন।

বাবুরী তার সামরিক দক্ষতা ও মেধার জন্য অটোমান বাহিনীতে খুব দ্রুত পদোন্নতি লাভ করেন এবং সমরাস্ত্র বা আর্টিলারিতে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেন। ইউরোপে তখন সবে আগ্নেয়াস্ত্র যুদ্ধ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছিল। কামান, বন্দুক এবং গোলাবারুদের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে ইউরোপের যুদ্ধ কৌশল ভিন্নরূপ ধারণ করে। বাবুরী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এসব অস্ত্র নির্মাণ এবং ব্যবহারের কৌশল করায়ত্ত করেন।

এরপর আরো শ'খানেক দক্ষ অটোম্যান সৈনিককে ভাগিয়ে নিয়ে মহামতি বাবরের কাছে চলে আসেন। সম্রাট বাবর তখন কাবুল কান্দাহার সমরকন্দ সব জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়ে ২০০-৩০০ বিশ্বস্ত সহচর আর পরিবার-পরিজন নিয়ে মধ্য এশিয়ার দুর্গম পাহাড় আর বনাঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এমনই এক অসহায় অবস্থায় সম্রাটের ছোট কাফেলা ভয়ানক এক ডাকাত দলের কবলে পড়ে। সবাই যখন নির্ঘাত মৃত্যু এবং মহিলারা অপমানজনক বন্দিত্বের গ্লানি বহন করার জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে ঠিক তখনই অলৌকিকভাবে বাবুরী তার দলবল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। মাত্র ১০-১২টা গুলি করে বিরাট একটি ডাকাত দলকে পরাজিত ও বন্দী করে সম্রাটকে তাদের কবল থেকে উদ্ধার করেন।

বহুদিন পর দুই বন্ধুর মিলন হয় এবং শুরু হয় ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের।

সম্রাট বাবর তার বন্ধুর কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদের ব্যবহার এবং এর কার্যকারিতা শোনার পর নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকেন হারানো রাজ্য উদ্ধার এবং নতুন নতুন রাজ্য জয় করার। ভারত তো দূরের কথা তখন এশিয়াতেও এসবের ব্যবহার শুরু হয়নি। ফলে এই মারণাস্ত্র তাদের একের পর এক সফলতা দিতে থাকল এবং শেষমেশ ভারতবর্ষের রাজটীকা তাদের করায়ত্তে এলো। ভারতের সব কিছু সম্রাটের পছন্দ হলো কেবল এই অঞ্চলের আবহাওয়া আর তরমুজ তার একদম ভালো লাগত না।

কিন্তু যে জিনিসটি সম্রাটকে ভারতবর্ষে রেখে দিল সেটি হলো ভারতীয় নারী। [ চলবে ]

 

 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.