সম্রাট পদাধিকার বলে প্রতিটি হেরেমের মালিক ছিলেন এবং হেরেমের সর্বত্র বিচরণ করতে পারতেন অবাধে। সম্রাট ভারতবর্ষের রাজকীয় হেরেমগুলোর নিয়ম-কানুন এবং হেরেমের বাসিন্দাদের গুণাবলী দেখে আশ্চর্য হন। তিনি অটোমান সম্রাটদের আদলে ভারতবর্ষেও জেনিসারী বাহিনীর প্রচলন করতে আগ্রহী হন। হেরেমের শিক্ষালয়গুলোতে আধুনিক সামরিক শিক্ষার সঙ্গে পররাষ্ট্র বিষয়ও তিনি অন্তর্ভুক্ত করেন। এ তো গেল তত্ত্বগত বিষয়।
এবার আমি বর্ণনা করব আমার অনুভূতি এবং শিক্ষাজীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতিগুলো। যা কিনা আপনাকে বিমোহিত করলেও করতে পারে।
একদিন পড়ন্ত বিকালে আমি রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে এলাম রাজকীয় বাহিনীর গার্ড অব অনারের মাধ্যমে। আমি যখন শহরের সিংহদারে পেঁৗছলাম তখন কামান দাগিয়ে আমাকে সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানানো হলো। চারদিকে শত শত অশ্বারোহী সৈন্য ছোটাছুটি করছে।
তাদের কোমরে লম্বা তলোয়ার, তার পাশে ছোট একটি ড্যাগার, পিঠে বন্দুক এবং এক হাতে বর্শা আর অন্য হাতে ঘোড়ার লাগাম। সৈন্যরা মার্চ করে ছুটে চলছে। প্রতি সারিতে চারটি ঘোড়া বর্গাকারে মোট সারি সাকুল্যে ১৬টি ঘোড়া নিয়ে হেলেদুলে টগবগিয়ে ঘোড়াগুলো তাদের মালিকের হুকুমে ছুটে চলছে। কেউ আর পিছু হটছে না। সবাই যার যার সারির সাম্যতা বজায় রেখে এগিয়ে যাচ্ছে_ তারা এত ছন্দময় তালে হাঁটছে যে, ঘোড়ার ঘুরে আওয়াজগুলোও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ধ্বনিত হচ্ছিল।
আমার বালিকা মন এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে কিছুতেই অবাক না হয়ে পারল না।
শহর থেকে ১৬ সদস্যের একটি সৈন্যদল আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গেল সম্রাটের মূল দুর্গের সিংহদারের কাছে। সেখানের রক্ষীরা আমার সম্মানে আবারও কামান দাগাল। আমার মনে হলো, এবারের শব্দটা আগেরটার তুলনায় অনেক বেশি এবং বেশ কিছুক্ষণ সেই শব্দ নিকটস্থ গাছপালা ইমারত এবং উঁচু ভূমির সঙ্গে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। আমি সেখানে শাহী দুর্গে ঢুকলাম এবং আমার জুড়ি ঘোড়ার গাড়ি চলতে চলতে সম্রাজ্ঞী রুবাইয়া গুলশান বেগমের প্রাসাদে গিয়ে থামল।
প্রাসাদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন একজন খোজা ব্যক্তি। যার পূর্ব-পুরুষ ছিল পারস্যের ইসলামী বংশের লোক। নাম তার খিজির হায়াত। প্রাসাদের প্রবেশপথে খিজির হায়াত এবং শিক্ষক মানজালা আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হলো এবং পারস্য দেশীয় অভ্যর্থনা সংগীতসহকারে সানাইয়ের সুর তুলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সম্রাজ্ঞীর খাস কামরায়।
আমার বয়স তখন সবে ১০ বছর। আমার পিতৃপুরুষের হাভেলির বাইরে আমি কোনো দিন যাইনি। দুনিয়া সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা তেমন ছিল না। রাজ্য, রাজা, রাজধানী নিয়ে অলীক স্বপ্ন দেখতাম মাঝেমধ্যে ঠিক সেভাবে, যেভাবে আমার মা-ফুফু, খালা-দাদিরা আমাদের গল্প শোনাতেন। মোগল খান্দানের আভিজাত্য, সাম্রাজ্যের বিশালত্ব এবং শাহী হেরেমের জাঁকজমক সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।
ফলে আগ্রা নগরীতে পা ফেলার পর থেকে প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল আমার জন্য বিস্ময়কর। সেই বিস্ময়ের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ হলো যখন আমি মালিকা-ই আলিয়ার সম্মুখে নীত হলাম। তিনি একটি স্বর্ণখচিত দোলনায় দোল খাচ্ছিলেন। তার সেবিকা সবাই দাঁড়িয়ে ছিল অবনত মস্তকে। কামরার বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন সাক্ষাৎপ্রার্থী আরও জনা পঞ্চাশেক অভিজাত রমণী।
যারা বিভিন্ন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তা কিংবা মন্ত্রীর স্ত্রী ছিলেন। এতসব ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে কোনো রকম বাধা ছাড়াই সরাসরি সম্রাজ্ঞীর সামনে নেওয়া হলো। আমি সম্ভ্রমে মাথা নিচু করে তাকে কুর্নিশ করলাম। তারপর আড়চোখে তাকে দেখার চেষ্টা করলাম। অসম্ভব সুন্দরী, অভিজাত এবং মমতাময়ী বলে মনে হলো।
সম্রাজ্ঞী দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমার সামনে এসে আমাকে খুব ভালোভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলেন। একপর্যায়ে আমার মাথায় তিনি হাত রাখলেন এবং বললেন, সৌভাগ্যবতী আফসানা_ তোমাকে স্বাগতম। তোমার বিষয়ে আমাকে বিস্তারিত সব কিছুই বলেছেন খানে খানান আবদুর রহিম। তুমি এখানে থাক এবং শাহী খান্দানের সম্মানিত মেহমান হিসেবে শিক্ষা গ্রহণ কর।
আশা করি, তোমাকে নিয়ে তুমি নিজেই এক সময় গৌরান্বিত বোধ করবে আর তখন তোমার পুরো খান্দানের আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকবে না। এখানে তোমার জন্য রয়েছে সব ধরনের আনন্দ, আয়েশ আর শিক্ষার নানা রকম পদ্ধতি। আশা করি, তুমি ধৈর্য সহকারে সব কিছু গ্রহণ করবে পরম আগ্রহ নিয়। এরপর তার চোখের ইঙ্গিতে আমাকে সেই কামরা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হলো। হেরেমের যে কামরায় আমার থাকার ব্যবস্থা হলো সেখানে মেহেরজান নামক এক কিশোরী আরও একবছর থেকে বসবাস করছিল।
মেহেরজান এসেছিল আহমেদাবাদ থেকে। সেখানকার এক নবাবের কন্যা সে এবং আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। আমাদের মধ্যে দ্রুত ভাব হয়ে গেল এবং তার কাছ থেকেই অতি দ্রুত জেনে ফেললাম অনেক কিছু। হেরেমের খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, শিক্ষা-দীক্ষা এবং আচার-ব্যবহার সম্পর্কে মেহেরজান আমাকে বিস্তারিত বলল। আমাদের মতো আরও ১০টি মেয়ে আগ থেকেই ছিল।
আমি আসাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়াল এগারতে। সবাইকে খুব সকালে প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র নেওয়া হয়। দুপুরের খাবার এবং বিকালের নাশতাসহ সারা দিন সেখানেই থাকতে হয়, হাতে-কলমে সবকিছু শেখার জন্য। সন্ধ্যার ঠিক পূর্বক্ষণে সবাইকে ফেরত পাঠানো হয় যার যার কামরায়।
হেরেমের কঠোর অনুশাসন অথচ মধুময় পরিবেশে গত আটটি বছর কাটিয়ে দিলাম।
মাঝে কয়েকবার আম্মা হুজুর এবং আব্বা হুজুর এসে দেখা করে গেছেন। এর বাইরে আমার পরিবার-পরিজন কেউ আসেনি। আমার দিক থেকেও কাউকে দেখার প্রবল ইচ্ছা জাগেনি। আমার প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে কঠিন ব্যস্ততার মধ্যে অথবা পরিশ্রমের মধ্যে। এরপর ব্যস্ত থেকেছি অনাবিল আনন্দের মধ্যে।
বাকি সময় বিশ্রাম। জীবনের এই ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে থেকে আমার চিন্তা-চেতনা এমনটি স্বপ্ন দেখার মাত্রাও পরিমিত হয়ে গেছে। আমরা মনেপ্রাণে সর্বদা শাহী খান্দানের মঙ্গল কামনা করতে শিখেছি এবং এই কান্দানের জন্য সন্তুষ্টচিত্তে করতে পারব সবকিছু।
অটোমান সাম্রাজ্যের জেনিসারী বাহিনীর আদলে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। মহামতি সম্রাট আকবর চাইছিলেন জিনিসারী বাহিনীর মতো একটি চৌকস সেনা দল হিন্দুস্তানে গড়ে তোলার জন্য।
এ জন্য তিনি আরমান খান ও সৈয়দ বাহলুল নামের দুজন সামরিক বিশেষজ্ঞকে রাজপ্রতিনিধি হিসেবে আনাতোলিয়ায় (তুরস্ক) পাঠালেন। তারা সেখানে প্রায় এক বছর থাকলেন এবং ফিরে এসে সম্রাটের কাছে লিখিত প্রতিবেদন জমা দিলেন। আমরা আমাদের পাঠ্য তালিকায় সে প্রতিবেদনটি পেয়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে, কৌশলগত সামরিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবেদনটি একটি যুগান্তকারী দলিল হিসেবে শত শত বছর হিন্দুস্তানের সামরিক বাহিনীকে আলোর পথ দেখিয়ে যাবে। আমি প্রতিবেদনটি প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছি এবং আমি জানি, আপনিও সেটা পড়েছেন।
আমার মুখস্থ ঠিক আছে কিনা তা আপনার সামনে পেশ করে পুনরায় ঝালাই করে নিতে চাই।
আরমান খাঁ এবং সৈয়দ বাহলুল লিখলেন_ দুনিয়াতে মহান আল্লাহর আশীর্বাদের ছায়া, জিল্লে ইলাহি। হিন্দুস্তানের মহান সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর সমীপে পেশ করার জন্য_
'আমরা যখন আনাতোলিয়ার উসমানিয়া সুলতানের রাজধানীতে পেঁৗছলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গিয়েছিল। এটা ছিল ১৫৭৬ সালের জুলাই মাস। আমরা রাজপ্রাসাদের
ফটকে গিয়ে হিন্দুস্তানের সম্রাটের পত্র এবং আমাদের পরিচয়পত্র পেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নহবত ও সানাইয়ের সুর তুলে অভ্যর্থনা জানানো হলো এবং অতি দ্রুত রাজকীয় মেহমান খানায় নিয়ে ততধিক দ্রুততার সঙ্গে আমাদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করা হলো।
আমাদের ইচ্ছানুযায়ী সেদিন সন্ধ্যার পর রাজদরবারে সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাতের আয়োজন করা হলো।
উসমানিয়া সাম্রাজ্য তখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বাদশাহী। এশিয়া-ইউরোপ এবং আফ্রিকাজুড়ে তাদের সুবিশাল সাম্রাজ্যের নাম-যশ ছিল খ্যাতির তুঙ্গে। সেই সাম্রাজ্যের রাজধানী আর রাজপ্রাসাদ এবং সর্বশেষে দরবারে উপস্থিত হয়ে আমরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমরা সম্রাট তৃতীয় মুরাদের সামনে নীত হয়ে কুর্নিশ করলাম যখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩০ বছর।
মাত্র দুই বছর আগে তার পিতা দ্বিতীয় সেলিম মারা যান আট বছর রাজত্বের পর। আর তখন থেকেই তিনি সুলতান। পৃথিবীর সম্রাটেদের সম্রাট মহমতি সুলায়মান ছিলেন তার দাদা। তার মৃত্যুর সময় সুলতানের বয়স মাত্র ২০ বছর। তিনি ১৫ বছর বয়স থেকেই দাদা-বাবার অধীনে যুদ্ধ করেছেন বিভিন্ন রণাঙ্গনে।
আর নিজে সুলতান হওয়ার পর ইউরোপ ও এশিয়ার বলকান অঞ্চলে ঝড় তোলেন। আমরা সবাই তার দিকে নজর করলাম। রাজকীয় নকিব উচ্চৈঃস্বরে মোগল সম্রাটের চিঠি পাঠ করল। আমরা হিন্দুস্তান সম্রাটের মূল্যবান উপহারসমূহ হস্তান্তর করলাম। তিনি এসব দেখে ভারী আশ্চর্য এবং অতিশয় খুশি হলেন।
তরুণ সম্রাটের প্রবল মেধা আর রাজসিক গাম্ভীর্যতা দেখে আমরা মুগ্ধ হলাম। তিনি শুধু একটি কথাই বললেন, তার দাদা মহামতি সুলায়মান হিন্দুস্তানের মহান সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবরকে আমৃত্যু বন্ধু মনে করতেন। আর তার পিতা দ্বিতীয় সেলিম মোগল-এ আজমকে পিতৃবন্ধু হিসেবে অতিশয় শ্রদ্ধা করতেন। এরপর তিনি তার রাজ মুকুটের শীর্ষে স্থাপিত মহামূল্যবান হীরক খণ্ডটিকে স্পর্শ করে বললেন_ আপনাদের সম্রাট এই হীরক খণ্ডেরই মতো আমার মাথার ওপর অবস্থান করছেন। সুলতানের কথা শুনে আমরা ভীষণ আহ্লাদিত হয়ে পড়লাম এবং বারবার মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করতে থাকলাম।
সুলতান ধৈর্য সহকারে আমাদের বক্তব্য শুনলেন এবং তার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিলেন, আমাদের সব প্রয়োজন মিটিয়ে দেওয়ার জন্য।
আমরা উসমানিয়া সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনী বিশেষত জেনিসারী বাহিনীর গঠন, প্রয়োজন এবং কার্যকারিতা নিয়ে কাজ করেছিলাম। এ জন্য আমাদের রাজকীয় লাইব্রেরিতে কয়েকদিন সময় কাটাতে হলো_ রাজবংশের ইতিহাস এবং সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার জন্য। শত শত নয়, হাজার হাজার উপজাতির বহুমুখী জীবনধারা এবং আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্থান-কাল-পাত্রভেদে সাম্রাজ্যের নীতিমালা যে ভিন্ন প্রকৃতির হতে পারে, তা আমরা জানলাম। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা গাজী উসমান পূর্ব থেকেই সেলজুফ সুলতানদের অধীনে ছোট একটি ভূখণ্ডের শাসনকর্তা ছিলেন।
পুরো মধ্য এশিয়ার বলকান অঞ্চল এবং পারস্য সেলজুফ সুলতানরা শাসন করতেন বলতে গেলে স্বাধীনভাবেই যদিও কাগজ-কলমে তারা বায়জানটাইন সম্রাটের অধীন ছিলেন।
গাজী উসমান ছিলেন আনাতোলিয়ার শাসক এবং কাইহান গোত্রের প্রধান। ১২৯৯ সালে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং একের পর এক জনপদ দখল করতে থাকেন। তখন বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়েছিল আর সেই সুযোগে উসমান তার নতুন সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে থাকলেন। ১৩২৮ সালে তিনি মারা যাওয়ার সময় তার পুত্র ওরহানের জন্য রেখে গিয়েছিলেন এক বিরাট ভূখণ্ড।
রাজকোষে কাড়ি কাড়ি অর্থ এবং একটি সুসংগঠিত সেনাবাহিনী। আর রেখে গিয়েছিলেন একটি অছিয়তনামা। উসমান লিখেছিলেন_
"প্রিয় পুত্র! তোমার জীবনের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর সর্বদা ধর্মীয় বিষয়গুলোকে অধিকতর মর্যাদা প্রদান করিও। মনে রাখবে ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার সাহায্যেই তুমি কেবল একটি শক্তিশালী নৈতিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলতে পারবে। ধর্মীয় বিষয়াদি তদারকির দায়িত্ব কখনো গুণাগার পাপী, দায়িত্বজ্ঞানহীন, অনভিজ্ঞ ভিন্নমতের মানুষ কিংবা অলস ব্যক্তিদের ওপর অর্পণ করবে না।
এ ধরনের লোকজনকে ভুলেও রাষ্ট্রক্ষমতার কোনো পদে বসাবে না। কারণ যে মানষ তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভয় করে না, সে মানুষ কখনো আল্লাহর বান্দাকে সম্মান করতে জানে না। একজন পাপী যদি অনবরত পাপ করতে থাকে, সে ক্ষেত্রে সে কখনো কারও অনুগত হতে পারে না। পণ্ডিত ব্যক্তিরা ধার্মিক মানুষজন। শিল্পী এবং সাহিত্যিকরা হলেন রাষ্ট্রের ভিত্তি।
তাদের প্রতি সব সময় সম্মান, শ্রদ্ধা এবং দয়া প্রদর্শন করবে। সব সময় খুঁজে খুঁজে গুণী ব্যক্তিদের বের করে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং তাদের অর্থবিত্ত দিয়ে নিজেকে সম্মানিত করার চেষ্টা করবে। এসব লোকের মাধ্যমে তোমার রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নীতিমালাসমূহ বাস্তবায়ন করবে। হে পুত্র! তুমি আমার জীবন থেকে শিক্ষা নাও_ এই জনপদে আমার নেতৃত্ব ছিল অতিশয় দুর্বল। মহান আল্লাহর অনুগ্রহ নিয়ে আমি তোমাকে বর্তমানের গৌরবময় স্থানে রেখে গেলাম_ অথচ এই স্থানে পেঁৗছানোর কোনো যোগ্যতাই আমার ছিল না।
তুমি আমার জীবনযাত্রা এবং কর্মপন্থা অবলম্বন কর, দ্বীনে মোহাম্মদীকে রক্ষা কর এবং বিশ্বাসী মানুষ ও ফুলকে সুরক্ষা কর এবং ভালোবাস। মহান আল্লাহ অধিকারের দিকে ভুলেও নজর দেবে না এবং আল্লাহর অধিকারের প্রতি সম্মান রাখবে এবং তার বান্দাদের সম্মান করবে। আমি যেভাবে তোমাকে আদেশ ও উপদেশ দিয়ে গেলাম তদ্রূপ তোমার পরবর্তী উত্তরাধিকারীকেও তুমি এই অছিয়তগুলো পেঁৗছে দেবে। প্রতিটি কর্মসম্পাদনে তুমি সর্বোচ্চ যত্নশীলতার সঙ্গে পরিশ্রম করবে। কখনো নিষ্ঠুর হবে না, প্রতিটি কর্মে স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে এবং সবশেষে ফলাফলের জন্য মহান আল্লাহর ওপর নির্ভর করবে।
শত্রুর আক্রমণ, প্রতিহিংসা, নিষ্ঠুরতা আর চক্রান্ত থেকে তোমার জনগণকে রক্ষা করবে। কখনো কারও সঙ্গে অসৌজন্যমূলক অসদাচরণ করবে না। জনগণকে সম্মান করবে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে। "
সুলতান ওরহান পিতার অছিয়ত অনুযায়ী ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৩৮ বছর রাজত্ব করেন। তিনি প্রথম নিয়মিত বেতন, নিয়মতান্ত্রিক নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করে জেনিসারী বাহিনী গঠন করেন।
এটিই পৃথিবীর প্রথম আধুনিক নিয়মতান্ত্রিক সামরিক বাহিনী। জেনিসারীর অনুকরণে ফ্রান্সের সম্রাট সপ্তম চার্লস একটি সেনাবাহিনী গঠন করতে পেরেছিলেন সুলতান ওরহানের ১০০ বছর পর। আর এখানেই সুলতানের ধীশক্তি এবং উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় ফুটে ওঠে। এই শক্তিশালী বাহিনীর সাহায্যে তিনি এশিয়া, আফ্রিকা আর ইউরোপের বিশাল অংশ দখল করেছিলেন এবং ওইসব অঞ্চলের অন্যসব রাজা, বাদশাহ এবং সম্রাটদের হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়েছিলেন।
আমরা খুঁজতে থাকলাম_ কেন সুলতান এ রকম একটি ব্যয়বহুল সেনাবাহিনী গঠন করতে উদ্যোগী হলেন? তারপর কীভাবে শুরু করলেন এবং কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন; সর্বশেষে কীভাবে সফলতা পেলেন।
এ লক্ষ্যে আমরা প্রথমেই সাম্রাজ্যের সীমানার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করলাম। ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার মানচিত্রের এত বিশাল এলাকা এর আগে কোনো সম্রাট একত্রে শাসন করতে পারেননি। শত শত উপজাতি, শত শত ধর্মমতের মানুষ আর হাজার রকমের ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠীর মনে রাজশক্তির প্রতি সম্ভ্রম সৃষ্টি করার জন্য একীভূত সামরিক শক্তির কোনো বিকল্প যে নেই, তা সুলতান ওরহান উপলব্ধি করলেন এবং গড়ে তুলতে চাইলেন জেনিসারী নামের এক আধুনিক সেনাবাহিনী।
রাজ্যের দুর্গম এলাকা থেকে ১০-১২ বছর বয়সী সুদর্শন, চটপটে, মেধাবী আর নিখুঁত শারীরিক গঠনের কিশোরদের সংগ্রহ করা হলো। রাজকর্মচারীরা কোনো গ্রামে যেতেন এবং সব কিশোর বালকদের লাইন দিয়ে দাঁড় করাতেন এবং পছন্দের বালকদের বাছাই করার পর জোর করে রাজধানীতে নিয়ে আসতেন।
এভাবে তারা এক হাজার বালককে নির্বাচিত করে গড়ে তাদের সর্ব বিষয়ে ১০ বছর ধরে শিক্ষা দিতে থাকে। প্রথমত তাদের ভাষা, ধর্ম, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস একই রকম করে ফেলা হয়। সবাইকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে তুর্কি ভাষায় কথা বলা শেখানো হয়। তাদের বয়স ২১ বছর পূর্ণ হওয়ার পর তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়মিত কমিশন দিয়ে উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ বাহিনী মূলত প্রাসাদ রক্ষা, সুলতানের নিরাপত্তা বিধান এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনা ছাউনিতে কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রশিক্ষণকালীন তাদের পুরোপুরি পরিবার-পরিজন, আত্দীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো। এ ছেলেগুলো কি আদৌ বেঁচে আছে, না মরে গেছে- এ ধরনের কোনো সংবাদ তাদের পরিবারের কাছে থাকত না। তারা যখন কিশোর সন্তানটিকে ভুলতে বসত তখন হঠাৎ দেখত ২১-২২ বছরের এক জেনারেল এসে উপস্থিত। পুরো জনপদে খুশির বন্যা বয়ে যেত।
প্রথমদিকে এ ধরনের রিক্রুটমেন্ট নিয়ে লোকজনের মধ্যে প্রচণ্ড হতাশা এবং ক্ষোভ ছিল।
কিন্তু ১০ বছর পর প্রথম ব্যাচের এক হাজার কর্মকর্তা উচ্চপদ নিয়োগ লাভের পর সাম্রাজ্যের সব অভিজাত পরিবার তাদের সন্তানকে স্বেচ্ছায় জেনিসারী বাহিনীতে ভর্তি করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ত। ফলে এ বাহিনীর নিয়োগ, নির্বাচন পদ্ধতি এবং প্রশিক্ষণের বিষয়ে সুলতান প্রথম মুরাদ কার্যকর আইন প্রণয়ন করেন। ১৩৮৩ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্যে এ বাহিনী আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।
প্রথমদিকে এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১০০০ জনে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরে তা ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পায়। আমরা যখন রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে ছিলাম, তখন এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার।
[চলবে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।