শাহজাদা সেলিমকে বিদায় জানিয়ে আফসানা মহলে ফিরল। এতকাল তাকে থাকতে হতো ভিন্ন একটি কামরায়- হেরেমের অন্যান্য সহেলীদের সঙ্গে। কিন্তু যুবরাজের সঙ্গে মিলনের পর মোগল হেরেমে তার মর্যাদা বহুগুণ বেড়ে গেছে। এখন থেকে সে থাকবে সেই কামরাটিতে যেখানে শাহজাদার সঙ্গে তার বাসর হয়েছিল। রাজকোষ থেকে নিয়মিত ভাতা ছাড়াও সার্বক্ষণিক চারজন প্রহরী, তিনজন আয়া, বড় পালকি, দুটি ঘোড়ার সমন্বয়ে চালিত সওয়ার, অস্ত্র বহন করার অধিকারসহ মুকুট পরতে পারবে রাজকীয় অনুষ্ঠানগুলোতে।
তার নতুন উপাধি হলো বেহতরী তাবাসসুম। সম্রাজ্ঞী রুকাইয়া বেগম সুলতান নিজমুখে আফসানার বর্তমান রাজকীয় উপাধি এবং সুযোগ-সুবিধার কথা বর্ণনা করলেন। আফসানার সহেলীরা সব হিংসায় মরে গেল। তারা একে অন্যকে চিমটি কেটে টিপ্পনি দিয়ে বলল দেখ লো ধ্যাঙ্গা মাগীর ঢং দেখ। এতদিন মনে হতো ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না; অথচ এক রাতেই রাক্ষুসীটা সাহেবে আলমের মাথাটা একদম গিলে খেয়ে ফেলল! অন্য একজন বলল, আরে না-না, মাথা গিলে খায়নি গো অন্য কিছু খেয়েছে।
একদম চেটেপুটে খেয়ে সাবাড় করে দিয়েছে, বলেই সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
আফসানার সহেলীরা দূর থেকে যে কথাবার্তা বা ঠাট্টা-মশকরা করছিল, তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না তার। ব্যবহার্য জিনিসপত্র আনার জন্য সে পুরনো মহলে ঢুকল। গত আটটি বছর সে এখানেই ছিল।
পরিপাটি ছিমছাম কামরা। প্রাসাদের দোতলার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত হওয়ার কারণে কামরার বাসিন্দারা সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্তের পাশাপাশি সারা রাত চাঁদের আলোতে অবগাহন করার সুযোগ পেত। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে কামরাটির সামনের খোলা ছাদে সহেলীদের নিয়ে শুরু হতো আড্ডা। গান-বাজনা, কৌতুক বলা এবং হাসি-তামাশার ছলে একে অপরের স্পর্শকাতর জায়গায় খোঁচা দিয়ে বিব্রত করার ঘটনা ছিল নিত্য-নৈমত্তিক।
প্রাসাদের শিক্ষিকা যদি শাসন করতে এগিয়ে না আসতেন তাহলে মেয়েরা বহুৎ দুষ্টুমি করত।
এমন সব দুষ্ট দুষ্ট কথা বলা হতো যা শুনে শয়তানও লজ্জায় পালিয়ে যেত। হেরেমের মধ্যে কোনো পুরুষের প্রবেশ ছিল একবারেই নিষিদ্ধ কেবল সম্রাট ও যুবরাজ ব্যতিরেকে। হেরেমের সব বাসিন্দা হয় নারী নয়তো খোঁজা। ফলে পুরুষ শরীরের একটু ঘ্রাণ, একটু ছোঁয়া পাওয়ার জন্য সবাই ছিল পাগল। কোনো নারী যদি জীবনে একবার ভাগ্যক্রমে কোনো রাজপুরুষের সানি্নধ্য পেয়ে যেত তবে তাকে নিয়ে বছরের পর বছর চলত হইহল্লা।
কিশোরী, যুবতী, বুড়ি- সব নারী গোল হয়ে বসে সেই সোহাগিনীর সৌভাগ্যের কথা শুনত। কিভাবে সাক্ষাৎ হলো- কিভাবে একে অন্যের কাছে গেল। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের পূর্বক্ষণে কেমন লেগেছিল, পরেই-বা কেমন লেগেছিল ওটা দেখতে কেমন, সেটার রং কি, কোনটা কত বড়, কোনটা কত ছোট ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করে সবাই। আর সোহাগিনী সত্য-মিথ্যা বানিয়ে রং-ঢং সাজিয়ে কত কথা যে বলত, তা কেবল আকাশের তারারাই জানত।
হেরেমের মধ্যে সব কিছু ছিল, কেবল ছিল না নারীর নারীত্ব এবং যৌনসুখ প্রাণভরে উপভোগ করার।
নারীরা এখানে কেবল বোবা কান্না কাঁদত। অন্য কোনো নারীকে জড়িয়ে ধরে কিংবা নিদেনপক্ষে খোঁজা প্রহরী বা কর্মচারীর সঙ্গে আলতো করে শারীরিক স্পর্শ লাগিয়ে সারা জীবন নিজেকে তৃপ্ত মনে করে আসছে হাজার হাজার রমণী। কেউ কেউ অবশ্য সমকামিতায় জড়িয়ে যেত। কিন্তু এদের সংখ্যা একবারেই হাতে গোনা। কারণ ঘটনা যদি ফাঁস হয়ে যেত তবে আর রক্ষা ছিল না।
বেত্রাঘাত, মাথা মুণ্ডন এবং ক্ষেত্র বিশেষে জীবন্ত কবর পর্যন্ত দেওয়া হতো। এর বাইরে নিজেদের হতাশা ঢাকতে কেউ কেউ আফিমের নেশা করত কেউবা তাস-পাশা খেলত। হেরেমের অধিকর্তী অবশ্য সব কিছু জানতেন। তাই প্রায়ই তিনি গান-বাজনা, নৃত্যকলা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ঘোড়-দৌড় ইত্যাদির আয়োজন করে হেরেমবাসীনীদের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
আফসানা হেরেমে আসার পর থেকেই তার স্বভাব অনুযায়ী এখানকার সব ভালো ভালো জিনিস আয়ত্ত করেছে।
অন্যদিকে মন্দ জিনিসের কাছেও যায়নি। ফলে হেরেমের সবাই তাকে অত্যধিক স্নেহ করত। তার মেধা, কর্মদক্ষতা এবং পরিশ্রম তাকে হেরেমে শিক্ষাগ্রহণকারীনীদের মধ্যে সর্বোত্তম হওয়ার কারণেই তাকে শাহজাদা সেলিমের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল প্রায় তিন বছর আগে। গত তিনটি বছর সে স্বপ্ন দেখছিল হৃদয়ের সহস্র আকুতি মিশ্রিত করে। সে ভাবত শাহজাদার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে থাকার জন্য।
তার স্বপ্ন ছিল শাহজাদা সারা দিনের কর্মব্যস্ত শরীর নিয়ে দিনান্তে তার কাছে আসবেন আর সে সমস্ত দেহমন উজাড় করে দিয়ে শাহজাদার সেবা করবে। কিন্তু আজ সকালে তার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তার বিশ্বাস- এই ইহ জীবনে শাহজাদার সঙ্গে তার আর দেখা হবে না।
গত রাতের মধুময় স্মৃতি এবং আজ সকালের বিদায় পর্বের মর্মান্তিক দৃশ্য স্মরণ করতে করতে আফসানা তার পূর্বতম কামরায় ঢুকে জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল। সদ্য নিয়োগ পাওয়া তার চাকর-আয়ারা তাকে সাহায্য করছিল।
অন্যদিকে পুরনো সহেলীরা টিপ্পনি কাটছিল। আফসানা নিরুত্তর রইল। সহেলীরা এগিয়ে এসে আরও দুষ্টুমি করার আয়োজন করতেই হঠাৎ লক্ষ করল সম্রাজ্ঞী রুকাইয়া সুলতান বেগম এগিয়ে আসছেন। সবাই যার যার স্থানে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সম্রাজ্ঞী এগিয়ে এলেন এবং আফসানার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন_
আমার প্রিয় আফসানা! মহান আল্লাহর অশেষ করুণা বর্ষিত হোক তোমার প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি।
আসমানের সব রহমত তোমার ওপর বর্ষিত হোক_ আর তোমার কল্যাণে এই শাহী হেরেম বরকতময় হয়ে উঠুক! তোমার জন্য সুখের সংবাদ হলো_ এই মাত্র খবর পেলাম, শাহেনশাহ এবং শাহজাদার মধ্যে মধুর মিলন হয়েছে। শাহজাদা আমাকে এবং তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে তোমার জন্য ১০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা প্রদানের আদেশ দিয়েছেন। এই অর্থ হয়তো ২/১ দিনের মধ্যেই তোমার মাকামে পেঁৗছে দেওয়া হবে। অর্থগুলো তুমি নিজের কাছে রাখতে পার অথবা তোমার পিতার হাভেলিতে পাঠিয়ে দিতে পার।
সম্রাজ্ঞী কথাগুলো বলে আফসানার আরও কাছে চলে এলেন। তারপর রাজ মহীয়সী আফসানার কপালে এঁকে দিলেন পরম স্নেহের চুম্বন। তিনি ফিরে যাওয়ার আগে একবার ভালো করে আশপাশের দিকে তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পারলেন পারিপাশ্বর্িক অবস্থা। তিনি খুব স্বাভাবিক গলায় আফসানার সহেলীদের উদ্দেশে বললেন_ শোন মেয়েরা! তোমাদের গর্ব করা উচিত, তোমাদেরই ঘনিষ্ঠ সহেলী হিন্দুস্তানের ভাবি শাহেনশাহ এবং যুবরাজ সেলিমের প্রেয়সী হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
শুধু তাই নয়, যুবরাজ আফসানাকে স্থায়ীভাবে হেরেমে থাকার অনুমোদন দিয়ে তার জন্য পদ ও উপাধি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কাজেই তাকে যদি তোমরা নির্বোধের মতো কেবল তোমাদের সহেলী বলে মনে কর, তবে মস্ত ভুল করবে। তোমাদের তো বটেই তোমাদের পিতা-মাতার সৌভাগ্যের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। আমি চাই, তোমরা তাকে কুর্নিশ করবে এবং তাকে সম্মানিতা তাবাসসুম বলে সম্বোধন করবে। কথাগুলো বলে সম্রাজ্ঞী মুহূর্ত দেরি করলেন না, হনহন করে চলে গেলেন গন্তব্যের দিকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আফসানা হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। তার সহেলীরা ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগল। তারা সম্রাজ্ঞীর হুকুমমতো আফসানার সামনে এসে মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল এবং সম্মানিতা তাবাসসুম বলে সম্বোধন করল। তারা সবিনয়ে তার কাছে অনুমতি চাইল, জিনিসপত্র গোছানোর কাজে সাহায্য করার অনুমতি প্রদানের জন্য। আফসানা হাসিমুখে সম্মতি দিলে সবাই কাজ শুরু করল।
অতি অল্প সময়ের মধ্যে সব জিনিসপত্র গোছানো হয়ে গেলে আফসানা তার নতুন কামরার দিকে রওনা হলো।
সবাই মিলে কামরা গোছাতে গোছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আফসানা তার জন্য নির্ধারিত হাম্মাম খানায় ঢুকে অবাক হয়ে গেল সেটির সাজসজ্জা এবং জাঁকজমক দেখে। এর আগে সে অন্যান্য সহেলীর সঙ্গে সাধারণ চৌবাচ্চায় গোসল সারত। আগ্রায় থাকাকালীন একবার যমুনায় নেমে গোসল করতে গিয়ে কিই-না লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গিয়েছিল, সে কথা স্মরণে এলে আজো ভয়ে শরীর জড়সড়ো হয়ে যায়।
মনের অজান্তে ছেলেটির জন্য বড্ড মায়া হয়। কয়েকবার ছেলেটিকে স্বপ্নেও দেখেছে। মনে হয় সে বেহেশতে চলে গেছে, নইলে ওমন হাসাহাসি মুখ আর সফেদ সাদা পোশাক পরে কিভাবে স্বপ্নের মধ্যে আফসানার কাছে ও আসতে পারল। নদীর কথা মনে হলে, কিংবা চৌবাচ্চাতে গোসল করতে গেলেই আফজাল নামক ছেলেটির কথা মনে পড়ে। আগে ভীষণ কান্না পেত; কিন্তু ইদানীং যদিও কান্না পায় না তথাপি কিছু সময়ের জন্য হলেও মনটা যেন কেমন কেমন করে ওঠে।
আজ থেকে আট বছর আগে আফসানা তাদের হাভেলি থেকে আগ্রায় পেঁৗছে সুবেদার ইমতিয়াজ খানের মেহমান হয়েছিলেন। শাহী হেরেমের শিক্ষিকা খানজালার তত্ত্বাবধানে সে সাতদিন আগ্রা নগরীতে ছিল। শহরের অলিগলি প্রাসাদসমূহ, সরকারি দফতরসমূহ এবং সামরিক চৌকিগুলো দেখার পর সে যখন যমুনার তীরে গিয়েছিল, তখন তার বালিকা হৃদয় বিস্ময়ে-বিমূর্ত হয়ে পড়েছিল স্রোতময় যমুনার অপার সৌন্দর্য দেখে। বিশাল নদী কুল কুল শব্দে অনবরত বয়ে চলেছে। স্বচ্ছ নীল জল- আকাশের নীল রংয়ের সঙ্গে মাখামাখি ভাব করে আরও গাঢ় নীল রং ধারণ করেছে।
সে দিনের সেই বিকাল বেলায় কোথা থেকে যেন একখণ্ড কালো মেঘ আকাশে ভর করল আফসানা দেখল নদীর পানির রং সম্পূর্ণ কালো হয়ে গেছে মেঘের রঙের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। দক্ষিণ দিক থেকে সজোরে ঠাণ্ডা বাতাস দূর-দূরান্তের ফুল ফলের মিষ্টি গন্ধ বয়ে নিয়ে আসছিল। আফসানার মনে হচ্ছিল- আহা একটু যদি যমুনায় নামতে পারতাম! কিংবা মজা করে একটু সাঁতার কাটতে পারতাম। কিন্তু সে দিন আর তা করা সম্ভব হলো না। খানজালা তাড়া দিলেন_ চটজলদি ইমতিয়াজ খানের প্রাসাদে ফেরার জন্য।
রাতে আফসানা খাবার খেতে খেতে ইমতিয়াজ খানের কন্যাদের কাছে ঘটনাটি বলল। সুবেদারের কোনো পুত্রসন্তান ছিল না_ চারটিই মেয়ে। ভীষণ আদুরে আর অসম্ভব সুন্দরী। একটি মেয়ের বয়স ছিল আফসানার সমান। অর্থাৎ ১০ বছর, নাম মেহজাবিন।
মূলত মেহজাবিনই তার আব্বাকে রাজি করাল আগামীকাল বিকালে আফসানাসহ পরিবারের মেয়েদের যমুনায় গোসল করার অনুমতি দেওয়ার জন্য। সুবেদার তার কন্যাদের জলকেলীকে সর্বোচ্চ আনন্দদায়ক করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই করলেন।
ইমতিয়াজ খানের প্রধান সহিস অর্থাৎ ঘোড়ারক্ষকের একটি ছেলে ছিল। নাম আফজাল। বয়স ১২/১৩ বছর।
অসম্ভব সুন্দর, মায়াবী আর নিষ্পাপ চেহারার আফজালের ছিল ততোধিক সুন্দর ধবধবে সাদা রঙের একটি তুর্কি গাধা। আফসানা লক্ষ্য করল, আফজাল তার গাধাটির পিঠে চড়ে সর্বক্ষণ তার সঙ্গে সারা শহর ঘুরেছে। আফসানার জুড়ি গাড়ি কোথাও দাঁড়িয়ে গেলে আফজালও তার গাধাটি সমেত দাঁড়িয়ে যেত। যদিও আফজাল গাধার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কিন্তু তার ভাবখানা ছিল এমন যেন সে তেজী টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে আফসানাকে তদারক করছে। আফসানা লক্ষ্য করল, শহরের সবাই আফজালকে ভালোবাসে।
এমনকি খানজালার মতো রাশভারি শিক্ষিকাও আফজালের প্রতি যথেষ্ট স্নেহপ্রবণ।
আফজাল তার চলার পথে শহরের সবচেয়ে ভালো কিছু মিঠাই-মণ্ডা কিনে আফসানা এবং খানজালাকে দিল। একটি মাটির পুতুলও উপহার দিল। যমুনার তীরে পেঁৗছে কোত্থেকে যেন একগাদা সুগন্ধী বুনোফুল এনে আফসানার হাতে দিল। ছেলেটির আন্তরিকতা, সরলতা এবং চমৎকার আতিথেয়তা তাকে যারপরনাই মুগ্ধ করল।
সে আফজালের সঙ্গে ভাইয়ের মতো খোলামেলা ব্যবহার করতে শুরু করল। প্রাসাদে ফিরে লক্ষ্য করল ইমতিয়াজ খানের পুরো পরিবারই আফজালকে ভীষণ রকম ভালোবাসে।
পরের দিন যমুনায় গোসল করার কথা শুনে আফজালও সঙ্গে যেতে চাইল। সে তখন ও বালক হওয়ার কারণে বড়রা কেউ আপত্তি করল না। অন্যদিকে ইমতিয়াজ খানের কন্যারা ভারি খুশি হলো।
মেহজাবিন আফসানাকে জানাল আফজাল অসম্ভব সুন্দর করে সাঁতার কাটতে পারে। তার গাধাটিও খুব ভালো সাঁতার জানে। আফজাল যমুনার তীরের খাড়া অংশ থেকে স্রোতস্বিনী নদীতে গাধা সমেত যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নদী পাড়ি দেয় তখন দেখতে ভীষণ রকম ভালো লাগে। মাঝনদীতে গিয়ে সে চিৎকার করে যখন আমাদের ডাকে তখন আমরা উচ্চৈঃস্বরে তার সঙ্গে গলা মেলাই। নদীর পাড়ের প্রাসাদের দেয়ালে সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে, যা শুনতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে।
সুবেদার পরিবারের গোসলের জন্য যমুনা তীরের নির্দিষ্ট অংশ সাজানো হলো। পাথর ফেলে তৈরি করা হলো অস্থায়ী স্নানঘাট। তারপর নিরাপত্তা চৌকি বসানো হলো, যাতে সাধারণ মানুষ ওই স্থানে যেতে না পারে। আফসানাসহ পরিবারের প্রায় ২০-২৫ জন বালিকা, যুবতী ও বৃদ্ধা সেইদিন বিকালে উপস্থিত হলো যমুনার তীরে। এই দলে একমাত্র পুরুষ হলো বালক আফজাল।
সে তার প্রিয় গাধাটিসহ কাফেলার সঙ্গে যোগ দিল। আফসানা নিজে খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারত, তারপরও সবাই তাকে সাবধান করল যমুনার ভয়াবহতার কথা বর্ণনা করে। বিশেষ করে নদীটির প্রচণ্ড স্রোত, কালাপানি এবং জায়গায় জায়গায় ঘূর্ণায়মান স্রোতকে অনেকেই ভয় করে।
নদীতীরে এসে সবাই হই-হুল্লোড় করে নেমে পড়ল পানিতে। বালিকা থেকে বুড়ি সবার বয়স যেন একরকম হয়ে গেল যমুনার পানির স্পর্শে।
সাঁতার কাটতে কাটতে সবাই লক্ষ্য করল, আফজাল তার গাধাটিসহ মুখ গোমরা করে বসে আছে। সে নামছে না। কেমন যেন একটা উদাসী মন নিয়ে বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। মেহজাবিন ও আফসানা সমস্বরে আফজালকে ডাকল পানিতে নেমে আসার জন্য। আফজাল বলল, তার শরীরটা ভালো লাগছে না।
মেহজাবিনের বড় বোনেরা তীরে উঠে আফজালের হাত ধরে টানাটানি শুরু করল। আফজাল বলল আমার ভয় করছে। রাতে স্বপ্নে দেখেছি আমি এবং গাধাটি পানিতে ডুবে মারা গেছি। নদীর মধ্যে এক ডাইনি বুড়ি আছে। সে শিকল দিয়ে আমাকে এবং গাধাটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, শত চেষ্টা করেও আমরা বাঁচতে পারিনি।
আফজালের কথা শুনে সবাই হই হই করে হেসে উঠল। অন্যরাও পানি থেকে উঠে এসে সেই হাসির সঙ্গে যোগ দিল। তারপর সবাই মিলে অনেক তোয়াজ-তদবির করে আফজাল এবং তার গাধাটিকে পানিতে নামাল। পানিতে নামার পর আফজাল কিছুক্ষণ ম্রিয়মাণ হয়ে থাকল। তারপর সেও অন্যদের মতো মহাসমারোহে হই-হুল্লোড় শুরু করল।
সবার মধ্যে এক অসাধারণ প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এলো। হঠাৎ মেহজাবিন লক্ষ্য করল মাঝনদীতে একটি ছোট্ট খেলনা নৌকা ভাসছে। নৌকাটি ছিল সবুজ রংয়ের এবং ফুল দিয়ে সাজানো। মেহজাবিনের দেখাদেখি আফসানা এবং অন্যরাও অবাক হয়ে নৌকাটির দিকে তাকিয়ে রইল। আফজাল বলল, আমি যাচ্ছি নৌকাটি নিয়ে আসতে।
বলেই সে কারও প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে গাধার পিঠে শুয়ে অতি দ্রুত সাঁতরাতে সাঁতরাতে মাঝনদীতে ভাসমান খেলনা নৌকাটির পানে ছুটল।
উপস্থিত মেয়েরা সব হাততালি দিয়ে আফজালকে উৎসাহ যোগাতে লাগল। নদীতে সেদিন স্রোত তুলনামূলক অনেক কম ছিল। আকাশও ছিল মেঘমুক্ত। আফজাল এগিয়ে যাচ্ছে আর মেয়েরা দুই হাত দিয়ে পানির উপর থাপ্পড় দিয়ে ঝপাঝপ শব্দ করছে।
আফজাল প্রায় নৌকাটির কাছে পেঁৗছে গেল, আর একটু হলেই নৌকাটি ধরে ফেলবে সে। হঠাৎ করেই একটি শুশুক এসে হুস করে লাফ দিয়ে খেলনা নৌকাটি ডুবিয়ে দিল। আফজাল ডুব দিল নৌকার খোঁজে। গাধাটি হঠাৎ বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠল।
এক মিনিট যায়, দুই মিনিট যায়, আফজাল আর উঠে না।
হঠাৎ গাধাটিও প্রচণ্ড ঘূর্ণি স্রোতের মধ্যে পড়ে বেশ কয়েকবার ঘুরপাক খেল এবং প্রচণ্ড জোরে আর্তচিৎকার শুরু করল। তারপর সেটিও ডুবে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত মহিলারা হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীরা ছুটে এলো। ছয় দাঁড়ি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে গেল উদ্ধারকারী দল।
কিন্তু ফলাফল শূন্য। আফজাল বা তার গাধাটির কোনোই সন্ধান মিলল না।
শাহী হাম্মামখানার পাশে দাঁড়িয়ে আফসানার মনে হলো ১০ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই হৃদয়বিদারক উপাখ্যানটি। সে আজও ভেবে পায় না আফজাল কেন পানিতে ডুবে মরল? তার গাধাটিই বা কেন ডুবল? আফজাল যে ডুবে মরবে তা তো সে আগেই বলেছিল। আগের রাতে সে স্বপ্নে দেখেছিল যমুনায় ডুবে মরার ঘটনাটি।
তাহলে কেন সে আফজালকে পীড়াপীড়ি করেছিল নদীতে নামার জন্য। আজও তার আফসোস হয়, আহা রে সেদিন যদি সবাই মিলে আফজালকে পানিতে নামার জন্য জোর না করত! আফসানা যখন এসব কথা ভাবছিল ঠিক তখনই তার সদ্য নিয়োগ পাওয়া বাঁদীটি এগিয়ে এসে তার কানে কানে ফিসফিসিয়ে কি যেন বলল, আর অমনিই খুশিতে টগবগিয়ে উঠল তার সারা শরীর।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।