আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন জরিনা

তোমার আমার ঠিকানা,পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বাবু বাজারে যাব , পয়সা দাও- বলে বাইরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল জরিনা । আমার ফ্ল্যাটের সদর দরজা সব সময় খোলাই থাকে । দরজা আঁট করে সেঁটে রাখলে কেমন জানি অতি ছোট মন ছোট মন মনে হয় । আমার উল্টো ফ্ল্যাটে থাকে এক কম বয়েসি দম্পতি । কেউ বেল টিপলে দরজা দু’ ইঞ্চি ফাঁক করে সব কথা সেরে নেয় ।

চলে গেলেই ঠকাস করে প্রায় মুখের ওপর দরজা বন্ধ হয়ে যায় । সেদিন সঙ্গে নাতনিকে নিয়ে এসেছে জরিনা । চার নম্বর মেয়েটি থাকে সুন্দরবন । শ্বশুরঘর মোটামুটি খারাপ নয় । অল্প সল্প জমি আছে শ্বশুর চাষ করেন ।

ছেলে সাহায্য করে । কোনরকমে চলে আর কি । স্বামীকে নিয়ে ঢাকা চলে আসতে চাইছে । রিক্সা চালিয়ে হয়ত আরও একটু রোজগার হতে পারে । চাষের জমিতে তো সেরকম আয় নেই।

মাঝে মাঝে মধু আনতে বনে ঢোকে সে তো আরও বিপজ্জনক । জরিনারও শ্বশুরবাড়ি সুন্দরবন । কিন্তু সে ঘর তো তাকে কবেই ছাড়তে হয়েছে । পাঁচটি ছেলে মেয়ে নিয়ে এসেছিল আজ থেকে পনের বছর আগে । সে দিনটি আজও হেঁটে হেঁটে চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় ।

কাজের খোঁজে এসেছিল একটি পঁচিশ বছরের মেয়ে । সবাইকেই বলছিল ওর কথা । যা আমরা সবসময় ই শুনি, স্বামী আবার বিয়ে করেছে । সুতরাং…। ওর নিশ্চিন্ত জীবন থেকে মুক্তি।

চেষ্টা করেছিল সতীনের সঙ্গে ঘর করবার । কিন্তু ওর মুখ ও তার সঙ্গে আর পাঁচটি মুখ তখন স্বামীর কাছে বাড়তি । সে নতুন কচি বউকে নিয়ে আহ্লাদে আঁটখানা । তাই জরিনা এখন গ্রামের ভাবীর পরামর্শে ঢাকার গুলিস্তানে। প্রথম বাচ্চাগুলোকে রেখে কাজ খুঁজতে এসেছিল ।

আমাদের এপার্টমেন্ট –ওকে নিয়ে এসেছিল আর এক কাজের খালা । এখানেই তিন বাসায় ওর কাজ জুটে যায় । বড় দুটো মেয়েকে দিনরাতের কাজে দিয়ে দেয় । তিনজনকে নিয়ে চলে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত হাড় খাটুনি । কখন কখন আরও বেশি থাকতে হত একটি বাড়িতে রাতের রুটি করার জন্যে ।

এক চাকরি করা দম্পতি সারাদিনের পরিশ্রমের পর আর রুটি করার মত ধৈর্য থাকে না । বেশ ঢল ঢল চেহারা জরিনার । চোখগুলো খুব বড় বড় । এত কষ্টের মধ্যেও স্বাস্থ্যটি ওর অটুট কোন যাদুবলে কে জানে । দুপুরের ভাত খায় রশিদ সাহেবের বাড়িতে ।

সন্ধেবেলা চা-রুটি আমার বাড়ি । ছেলেটিকে স্কুলে দিয়েছে । দুই মেয়েও ঠিকে কাজের জন্যে তৈরি হচ্ছে । ছেলেটিকে নিয়ে মহা সমস্যা । তার পড়াশোনায় কোন মন নেই ।

কাছেই অবৈতনিক প্রাইমারী স্কুলে পড়ে সে । মা বেরিয়ে এলেই মহা আনন্দে খেলে বেড়ায় । মায়ের তো সময় নেই ওর পেছনে ঘুর ঘুর করার । বোনদের সে মোটে পাত্তা দেয় না । জরিনা আবার পুত্র স্নেহে অন্ধ ।

রোজ ই বোঝাই– মেয়েগুলোকে-ও স্কুলে দিয়ে দে। তোর মত জীবন হবে ওদের । দুটোকে তো বাইরে দিয়েছিস । এ’দুটো অন্ততপক্ষে ; বলে , জান কত টাকা লাগবে ? আমি বলি , কেন স্কুলগুলো তো বিনে পয়সায় পড়ায় । ঐ শুনতেই বিনে পয়সায়।

বই আছে , স্কুলের জামা আছে । আরও কতকিছু লাগে জান । তখনও সর্বশিক্ষার ঢেউ আসেনি। দুপুরে পেট পুরে খাওয়ার ধুমধাম শুরু হয়নি । তাই আর মেয়েদের কোথায় পাঠান হল! ওরাও মার রুজি বাড়াতে লেগে গেল কাজে।

মায়ের সঙ্গ ধরে আসতো ঝিমা সে চার নম্বর । দেড় , দু’ বছরের বছরের তফাতে সবগুলোর জন্ম। বড়টির বয়েস এই বার , তের ছিল তখন । । তিন নম্বর রিমা ঘরে থেকে ভাইকে সামলাত ।

ভাইকে নাওয়ানো খাওয়ানো ঘুম পাড়ানো । ভাই ও নিজের জন্যে রান্না করা । রাতে জরিনা বাজার করে চাল ডাল সবজি নিয়ে গেলে রাতে রান্না হত । ভাতে জল দিয়ে রেখে সকালে ভাই বোনে তাই খেত । এই ভাবে চার পাচ বছর কেটে গেল ।

বার বার ই বদলাচ্ছে ওদের কাজ কর্ম । মোটামুটি খাওয়াদাওয়া জুটছে । মেয়ে তিনটেকেই থাকা খাওয়ার জায়গায় দিয়ে দিয়েছে । জরিনাও যা রোজগার করছে একটু থিতু হয়েছে মনে হয় । মুখে চোখে একটু চকচকে ভাব ।

এর মধ্যে এসে , বাবু একটু দেশে যাব । দেখে আসি ওদের মন কেমন করছে । আমি বলি , কার জন্যে বরের জন্যে ? ধন্যি বাপু তোদের প্রেম । তা যাচ্ছ যাও পেটে করে কিছু নিয়ে এস না যেন । আমি সতর্ক করি ।

ওকে কি কোন ভরসা আছে ? মন ভুলে যায় পট করে । ফেরার সময় দেখি বাড়ির পান নিয়ে এসেছে । সুপুরি নিয়ে এসেছে । আমি বলি , কি রে খুব আদর যত্ন পেয়েছিস মনে হচ্ছে । এক গাল হাসি ।

কোথায় শুলি রাতে ? লজ্জায় একেবারে মাথা নুয়ে গেল । মাথাটা গেল গরম হয়ে । বললাম জানিস তোর আদর কেন বেড়েছে ? তুই বাচ্চা কাচ্চা মিলে টাকা পাচ্ছিস তো তাই । তোর একবারও কি মনে হল না , যারা তোর খবর করেনি গত পাঁচ সাত বছরে তারা আবার যোগাযোগ করছে কেন? — না গো বাবু , ওখানে তেমন আয় পত্তর নেই তাই এখানে আসতে চায় । শহরে তো রোজগারের অনেক রাস্তা আছে ।

আমি বলি , অ । তা তোর সতীন আছে না গেছে । আছে গো , শরিল একদম শুকিয়ে গেছে । শ্বশুর মারা গেইছে । সে খাটতে পারত খুব ।

জমিজমা আর বেশি নেই । কি মজাতেই না আছে এই লোকগুলো । পিত্তি জ্বলে যায়। আদিখ্যেতা ! নিজের মনে গজ গজ করতে থাকি । পরের সপ্তাহে জরিনা দু তিন দিন কামাই করল ।

চিন্তায় থাকি , কি জানি আবার অসুখ বাঁধাল কি না । আসলে জিজ্ঞেস করি , কি রে কামাই করলি যে । শরীর খারাপ হয়েছিল? কোন উত্তর দেয় না । কি রে বল ?– সে এসেছেল, মাথা নিচু করে । এই মরেছে ।

আমি বলি, কেকেকে? তোমাদের জামাই গো বাবু। বাবুর মেজাজ ওর ভালই জানা আছে । আর বাবু যে এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশ বিরক্ত তাই কাচুমাচু মুখ । নিকুচি করেছে জামাইয়ের । এখানেও এসে হাজির হয়েছে !! যাক গে আমার আর কি ! যার আম তার আঁটি , সে ই বুঝবে ।

চুপ করে থাকি । ভাবি এতদিন শহরে থেকে নিশ্চয়ই বুদ্ধি বেড়েছে । কিন্তু না , দিন পেরলো না । পরের মাসে দেখি মুখ শুকনো করে রাত ন’ টায় কাজ সেরে যাওয়ার পথে হাজির হয়েছে । বাবু , এ মাসে হই’নিক ।

কি বলিস মুখপুড়ি ! আঁতকে উঠি । এখন ? ভ্যাক করে কেঁদে পড়ল । কি করি এখন। মুখ দেখে কি যে মায়া হল । এই ভয় ই তো পাচ্ছিলাম ।

বলি, এখন কি করতে চাস? রাখবি? না …। –না গো বাবু , কোথায় রাখব ? তুমি ত সব জান … সত্যি তো আমার থেকে বেশি ওর দিনগুলো আর কে দেখেছে ! –বলি , ঠিক আছে আমায় একটু ভাবতে দে । পরদিনই ফোন করলাম আমার এক ডাক্তার বান্ধবীকে । দিনখ’ন ঠিক হল । চিরদিনের মত শঙ্কা মুক্ত করালাম ।

যাক আর ভয় নেই । নিশ্চিন্ত হয় । এবার একটু শান্তিতে থাকবে । সে ও আর যাওয়া আসা করছে না। কিন্তু জরিনা মাঝে মধ্যে যাতায়াত করতে লাগল ।

ওখানে তার আদর যত্ন হচ্ছে বুঝলাম । টাকা পয়সাও হয়ত দেয় । আমাকে বলে না । আমি বার বার বলি মেয়েদের জন্যে যে খাতা খুলে দিয়েছি ব্যাঙ্কে প্রত্যেক মাসে সেখানে টাকা রাখিস কিন্তু । চারনম্বর এখন বাড়ি থাকে ভাইকে দেখে ।

তিন নম্বর আমাদের ওখানেই একটি বাড়িতে ঠিকে ঢুকেছে । সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থাকে । রাতে মার সঙ্গে বাড়ি ফিরে যায় । যে বাড়িতে খাওয়া পরার কাজে দিয়েছিল সে বাড়ির বাবুটির বেশি আদরযত্নের ফলে ওকে কাছে এনে রাখতে হয়েছে । চোখের সামনে থাকবে ।

দেখতে ও ই সবচেয়ে ভাল । ফর্সা রঙ । স্বাস্থ্য ও ভাল । নাক চোখ কাটা কাটা । সে আর বাঁচে ? হটাত একদিন কেঁদে পড়ল জরিনা, মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছে না ।

কদিন থেকেই ওর হাব ভাব আমার কেমন কেমন ঠেকছিল । এত সাজগোজ বেড়েছে । কো’থ থেকেই বা এত পয়সা পায় । আমি ভাবি দরকার কি সব ব্যাপারে নাক গলানোর । মেয়েরা বড় হয়েছে ।

ওরাই বুঝবে । আবার দু তিন দিন খবর নেই । আসে তিন দিন পর । আমি হা করে দাঁড়িয়ে । কি জানি কি শুনব ? আবার একগাল হাসি ।

বাবু মেয়ে জামাইকে ঘরেই তুলে ফেললাম গো । ছেলেটি মন্দ নয় । নীলক্ষেতে চা বিক্রি করে । ছেলের মা ঘরে তোলেনি । যৌতুক ছাড়া বিয়ে ।

তায় আবার নিজে পছন্দই করে । আমার কাছেই আছে । কয়েকদিন পর নিজে এক কামরা দেখে বাড়ি ভাড়া নেবে । কিন্তু এক কামরা আর ভাড়া নেয়া হয় না । সাত মাসের পোয়াতি রেখে সে উধাও হয়েছে ……।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.