মেয়াদের শেষ বছরে এসে আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীন মহাজোট যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, তখন তাদের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার বিষয়টি নানাভাবেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। বিশেষ করে, শাহবাগের গণজাগরণ ও হেফাজতের পাল্টা প্রতিক্রিয়ার ধাক্কা শেষ হওয়ার পরপর বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল দেখে। অথচ তখন পর্যন্ত সরকারি দল ভেবে আসছিল, ক্ষমতায় থেকে তারা বেশ উন্নয়নকাজ করেছে এবং সে কারণেই জনগণ তাদের আবার ভোট দেবে। বড় এক ধাক্কা খেয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ভাবতে শুরু করল, সরকার যে এত উন্নয়ন করেছে, তা সম্ভবত জনগণ জানে না এবং এটা জানানো দরকার। এর প্রতিক্রিয়াই ছিল বিলবোর্ড দখল।
সেখানে সরকারের নানা উন্নয়নকাজের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। অন্যের বিলবোর্ড দখল করে এ ধরনের প্রচারের ফল যা হওয়ার কথা তা-ই হয়েছে। সেখান থেকে সরে আসতে হয়েছে দলটিকে। এখন সরকারের উন্নয়নকাজ তুলে ধরার মাধ্যম হচ্ছে বিভিন্ন দলীয় জনসভা ও সেখানে দেওয়া বক্তব্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে অনেকটা আনুষ্ঠানিকভাবেই বিভিন্ন সভা-জনসভায় নৌকার জন্য ভোট চাইতে শুরু করেছেন।
সাম্প্রতিক এই সময়ে আশুলিয়া, উখিয়া, ঢাকার আজিমপুর, সিলেট ও কুষ্টিয়া বা প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানে তাঁর সরকারের উন্নয়ন-প্রসঙ্গই বেশি জায়গা পেয়েছে। তিনি সরকারের উন্নয়নের বর্ণনা দিয়ে কেন তাঁর সরকারকে আবার ভোট দেওয়া উচিত, তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এবং ভোট চেয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ‘উন্নয়নকে’ আগামী নির্বাচনের প্রচারকৌশল ধরে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? আর সরকার যে ‘উন্নয়নের’ দাবি করছে, সেটা কি জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে? জনগণ কি শুধু উন্নয়নকে বিবেচনায় নিয়েই ভোট দেয়? ভোট একটি পুরোপুরি রাজনৈতিক বিষয়, ভোট দেওয়ার সময় জনগণ কোনটি বিবেচনায় নেবে, শুধুই ‘উন্নয়ন’ প্রসঙ্গ, নাকি রাজনীতিই হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় বিবেচনা। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে না যাওয়ার ব্যাপারে এখনো অনড় রয়েছে এবং এ ধরনের নির্বাচন প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ফলে নির্বাচনী প্রচারণার মাঠ থেকে অনেক দূরেই আছে দলটি।
রাজনীতিতে নানা অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার পরও বাংলাদেশ উন্নয়নের পথেই হাঁটছে।
এ বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত আইএমএফের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের মধ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের জন্য যে আটটি ক্ষেত্র রয়েছে, তার সব কটিতেই বাংলাদেশ সঠিক পথে রয়েছে। এর কৃতিত্ব বর্তমান সরকার নিতেই পারে। কিন্তু উন্নয়নের পথে বাংলাদেশের এই যে যাত্রা, গতির হেরফের হলেও ধারাবাহিকভাবেই এগিয়েছে দেশটি। নব্বই-পরবর্তী সময়কে এক নতুন যাত্রা হিসেবে বিবেচনায় নিলে আমরা দেখব যে ১৯৯২ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখানে ২০১০ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে। এই সময়কালে বিএনপিও দেশ পরিচালনায় ছিল।
ফলে উন্নয়নের এই কৃতিত্ব যদি সরকারগুলোকে দিতে হয়, তবে তা থেকে বিএনপিকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই।
নব্বইয়ের পর যেকোনো সরকারই দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে পারেনি, এর কারণ ‘উন্নয়ন’ সমস্যা নয়। দেশ পরিচালনায় রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণেই জনগণ ক্ষমতাসীনদের প্রত্যাখ্যান করেছে। ক্ষমতায় থেকে দলগুলো যে রাজনৈতিক অপকর্ম করে, তার শিক্ষা দিতেই ভোটাররা বিরোধীদের বেছে নেন। ক্ষমতাসীন সরকারের দলীয়করণ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, স্বেচ্ছাচারী আচরণ এই রাজনৈতিক অপকর্মের মধ্যে পড়ে।
এবারের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ‘রাজনৈতিক অপকর্মগুলো’ কী? মোটা দাগে এগুলো হচ্ছে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু, গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূসের প্রতি সরকারের আচরণ, ছাত্রলীগের সন্ত্রাস। গতবার বিএনপির শাসনে ক্ষুব্ধ হয়ে যাঁরা আওয়ামী লীগকে বেছে নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই এসব কারণে এবার আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারেন। এর বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থানও রাজনৈতিকভাবে অনেক আওয়ামী ভোটারের কাছে যথেষ্ট অপছন্দের বিষয় হয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবেই পেয়েছে ৪৮ দশমিক ০৫ শতাংশ ভোট। এর সঙ্গে ছিল জাতীয় পার্টির ৭ দশমিক ০৭ শতাংশ ও অন্যান্য বাম দলগুলোর ১ শতাংশের নিচের ভোট।
সে সময় বিএনপি পেয়েছিল ৩২ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভোট ও জামায়াতে ইসলামী ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। নব্বইয়ে এরশাদের পতনের পর এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলকে বিবেচনায় নিলে সাধারণভাবে এটা ধরে নেওয়া যায় যে দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র এবং বিএনপি ও তাদের মিত্রদের ভোটার বা সমর্থনের হার কম-বেশি ৪০ শতাংশের কাছাকছি। বাকিরা অবস্থান পরিবর্তন করে কখনো আওয়ামী লীগ বা কখনো বিএনপির পক্ষে অবস্থান নেন। এখন এবারের নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ জিততে চায়, তবে প্রথমত এই ৪০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করতে হবে এবং বাকি যে ২০ শতাংশ ভোট, যাকে সুইপিং ভোট হিসেবে উল্লেখ করা যায়, সেই ভোটারদের একটি অংশকেও টানতে হবে। আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের জন্য এই কাজ আদৌ কতটা সহজ?
বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক অপকর্মগুলোর কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো কি এখন পাল্টে ফেলা সম্ভব? সরকার কি এখন শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির নায়কদের গ্রেপ্তার করবে? আবুল হোসেনকে দেওয়া ‘দেশপ্রেমিকের’ সার্টিফিকেট তুলে নেবে? নাকি গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূসকে নিয়ে যা করেছে, তা উল্টে দেবে? ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাস আর টেন্ডারবাজির শিকার হয়েছেন যাঁরা, তাঁদেরই বা কী বুঝ দেওয়া যাবে! যে ৪০ শতাংশ ভোট আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের ছিল, এসব কারণে তো এখন সেখানেই টান পড়ার কথা।
সুইপিং ভোটারদের তারা টানবে কিসের ভিত্তিতে!
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ফেব্রুয়ারিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ ও পরবর্তী সময়ে হেফাজতে ইসলামের উত্থান দেশের রাজনীতির হিসাব-নিকাশের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট হবে। ফলে ‘উন্নয়ন’ ইস্যু নয়, ‘রাজনীতিই’ বড় বিবেচনা হবে এবারের নির্বাচনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্রদের পছন্দের রাজনৈতিক পরিচিতি হচ্ছে ‘স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি’। গত ফেব্রুয়ারিতে আমরা শাহবাগে যে গণজাগরণ দেখেছি, তাকে সেই বিবেচনায় এই ‘স্বাধীনতার সপক্ষ’ শক্তির সহায়ক হিসেবেই ধরতে হবে।
আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা এই গণজাগরণের প্রতি তাদের সমর্থন, সহায়তা বা পেছনে থেকে তাকে পরিচালিত করার কাজটিও করেছে। বিরোধী পক্ষ থেমে থাকেনি, তাদের ‘আস্তিক-নাস্তিক’ প্রচারণার কৌশল যে ভালোভাবেই কাজ করেছে, তার প্রমাণ হেফাজতের উত্থান। ফলে কৌশলগত কারণে শাহবাগ থেকে অনেকটাই সরে আসে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপির অবস্থাও তা-ই। হেফাজতের সমাবেশের সঙ্গে মিলিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার যে চেষ্টা দলটি করেছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বিএনপি হেফাজতপন্থী হিসেবে নিজেদের যে অবস্থান তুলে ধরেছে, তা রাজনৈতিকভাবে দলটির জন্য ইতিবাচক হয়েছে কি না তার ফয়সালা হবে এই নির্বাচনে।
গণজাগরণ ও হেফাজত—আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য একদিকে যেমন তারা সহায়ক শক্তি, আবার দল দুটির জন্য তারা বোঝাও। এই জটিল হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় রেখেই আওয়ামী লীগকে তার রাজনৈতিক ব্র্যান্ডিং ‘স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি’ পরিচয়টি যেমন তুলে ধরতে হবে, তেমনি ইসলামের দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। একইভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি’ ব্র্যান্ডিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে ধারণ করা যায়, সেই জটিল কাজটি করতে হবে বিএনপিকে।
আওয়ামী লীগ এখন ভোট চাইতে শুরু করেছে।
ক্ষমতায় থাকার অনিবার্য কুফল ও ‘রাজনৈতিক অপকর্মের’ কারণে ইতিমধ্যে শতকরা হিসাবে অনেক ভোট দলটি হারিয়েছে। এখন ‘উন্নয়নের’ দোহাই দিয়ে সেই ভোট মিলবে না। আর শুধু আওয়ামী লীগের বাঁধা ভোটারদের দিয়েও নির্বাচনে জেতা যাবে না। আওয়ামী লীগের বাইরেও ‘স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তি’ রয়েছে এবং সেই ভোটগুলো দলের পক্ষে আনতে পারলেই ফল পাওয়া যেতে পারে। হেফাজত ও জামায়াতের মিত্র হিসেবে রাজনৈতিক কারণে যাঁরা বিএনপিকে ভয় পান, সেই ভোটাররাই এখন আওয়ামী লীগের ভরসা।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।