ঃ কাকা, আমারে ট্যাকা দিবেন না?
মুখ তুলে তাকালেন ম্যানেজার। পাগলাটে চেহারা আর নোংরা বেশভূষা দেখে বিরক্তির সুরে বললেন,
ঃ তুই আবার ট্যাকা দিয়া কী করবি?
ঃ খামু। খিদা আছে না প্যাডে?
ঃ অ। এইখানে তোর কেডা আছিলো?
মায়- বাপে।
ঃ নাম ক'।
ঃমা শুকুর আলী, বাপ রহিমা বেগম।
ঃ ওই ছ্যামড়া, টানোস নাহি? মা কেডা, বাপ কেডা জানোস না?
প্রচন্ড ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেলো কুদ্দুস। গতকাল রাতে গাজা টেনেছিলো, সকাল বেলাতেও কথা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। শুরুতেই তার চেহারা দেখে ম্যানেজার সন্দেহ করেছিলেন, এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন।
এক নিমেষে ধূর্ততা খেলে গেলো তার চোখে মুখে!
মৃত তালিকায় দুজনের নাম নিশ্চিত হয়ে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন।
মিনিট দশেক হলো কুদ্দুস বাইরে অপেক্ষা করছে। চারপাশে অসংখ্য মানুষ; প্রায় দেড় সপ্তাহ আগে এই গারমেন্টসে অগ্নিকান্ডে যারা মারা গিয়েছিলো তাদের স্বজনেরা।
রুমের ভিতরে ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়া দেয়া হচ্ছে। সেই টাকা নিয়ে বাইরে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ছে কেউ কেউ।
জীবনের ক্ষতিপূরণ হয়না;
যে চলে যায় তার ক্ষতিপূরণের দরকারও নেই।
তার ঠাই হয়ে যায় মাটির বিছানায়। কিন্তু পরিবারের আর যারা বেঁচে থাকে, তাদেরকে 'ক্ষতিপূরণ" নামক স্বান্তনাটুকু বুকে তুলে নিতে হয়- দু'বেলা খেটে খাওয়া জীবনের এটাই নিয়ম!
দেড় সপ্তাহ আগের শোক মানুষ অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে, চোখের পানিতে ধুয়ে নয়, রোদে গড়ানো ঘামে। তারা দিনমজুর; শোক করে দিন পার করলে খাবার জুটবেনা পেটে।
তবু এতোদিন বাদে এই ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে পুরনো শোকটা যেন জেগে উঠেছে আবার।
ঘটনাটা যেদিন ঘটে, কুদ্দুস কিছু বুঝতে পারেনি।
গাজার নেশা কেটে যাওয়ার অর মধ্যরাতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলেছিলো, "মা, ভাত দ্যাও। "
কিন্তু সেদিন ভাতের থালা ছুঁড়ে দেয়ার জন্যও ঘরে কেউ ছিলোনা।
ঃ ভাইজান, আপনে কাগজ পাইছেন?
কুদ্দুস ডানদিকে তাকায়। একজন লোক কখন এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে- খেয়াল করেনি সে।
ঃ দেহি কাগজডা।
কুদ্দুস কাগজ দেখায়।
ঃ আপনে না এ্যাঅলাখ পাইবেন, আপনারে তো পঞ্চাশ হাজার দিছে!
কথাটা শুনে কুদ্দুস ভিতরে যাওয়ার চেষ্টা করে।
লোকটা টেনে ধরে বলে,
ঃ খাড়ান আমি দেহি। আপনে ঝামেলায় যাইয়েন না, পুলিশে দিবার পারে।
আমারে পাঁচ হাজার দ্যান, সব ঝামেলা ফিনিশ।
কুদ্দুসের মাথা ঠগবাজী বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছে অনেক আগেই। সে সরল বিশ্বাসে বললো,
ঃ আমি ট্যাকা পামু ক'নে?
লোকটা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললো,
ঃ এ্যাহন না, ট্যাকা পাওয়ার পরে দিয়েন।
টাকা নিয়ে বস্তিতে ফিরে আসছে কুদ্দুস। ক্ষতিপূরণের একলক্ষ টাকা বন্টন হয়েছে এভাবে- কুদ্দুস ষাট হাজার হাজার ( এরমধ্য থেকে ম্যানেজারের চেলা নিয়েছে পাঁচ হাজার!) আর বাকি চল্লিশ হাজার ম্যানেজারের পকেটে!
ম্যানেজার আর তার চেলার কৌশলগত কারসাজিটা ধরতে পারেনি কুদ্দুস। পারবে কী করে! গাজার কল্যাণে তার অবিশ্বাসের বালাই দূর হয়ে গেছে সেই কবেই!
বস্তিতে ঢোকার আগেই তার দু'জন গাজা- পার্টনার দৌড়ে এলো,
ঃও কুদ্দুস বাই, আপনে তো ম্যালা ট্যাকা পাইছেন।
খাওয়াইবেন না আমাগো?
গাজার আড্ডা থেকে ফেরার পথে সন্ধ্যায় দেখা হয়ে গেলো মোতাহারের সাথে। মোতাহার হাত ধরে বহুদিনের বন্ধুর মত বললো,
ঃ ভাই, ট্যাকা পাইছেন। এই জিনিস আর মিস কইরেন না।
খাসা মাল, জীবনে আর পাইবেন না!
গাজার নেশায় ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে "ক্যাটরিনা ফেইল নাচ"ও দেখে এলো কুদ্দুস। পাঁচশ টাকা বখশিস দিয়ে দু'টো বোতলও ফ্রি পাওয়া গেলো।
যদিও সে এসব খায়না, তবু নিয়ে এলো ঘরে!
পরিশিষ্ট্যঃ
মাটির ওপর শুয়ে আছে কুদ্দুস;
আজ নেশাটা তাড়াতাড়ি কেটে গেলো-মনটাও কেমন কেমন করছে!
খা খা করছে ঘরটা। আজ সারাদিনে কোন দানাপানি পড়েনি পেটে। প্রথম প্রথম আশেপাশের মানুষজন তাকে ডেকে খাওয়াতো। এখন আর কেউ ডাকেনা।
উঠে বসলো কুদ্দুস।
এখন হাতে অনেক টাকা। সে চাইলে খাবার কিনে খেতে পারে কিন্তু এই মধ্যরাতে তার জন্য দোকান খোলা রাখবে কে!
একটা বোতল খোলে কুদ্দুস। আজ রাতটা এটা দিয়েই চালিয়ে দেয়া যাক।
ভিতরের তরলটা কেমন লাল লাল। রক্তের মতো!
মাথাটা হঠাৎ ঝিম ঝিম করে ওঠে কুদ্দুসের।
হঠাৎ মনে হলো-
"মা-বাবার রক্ত" !
ভিতর থেকে প্রচন্ড একটা ঝাকুনি খায় কুদ্দুস!
বোতল ফেলে মাথা চেপে ধরে- কী হলো তার, এমন লাগে কেন!
অনবরত তার মস্তিষ্ক বলে যাচ্ছে- সে "মা-বাবা কে খাচ্ছে"!
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা কুদ্দুস। পাগলের মতো একদৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়, শার্টের ভিতরের পকেটে বাকি টাকাগুলো।
এভাবে আর না, দূরে কোথাও চলে যাবে সে- মা-বাবার শেষ দানটুকু দিয়ে নতুন করে বাঁচতে হবে তাকে!
.............................................................(তাজরীন ফ্যাশন'স ট্রাজেডি অবলম্বনে)
উৎসর্গঃ
তাজরীন ফ্যাশন'স এর যারা জুরাইনের মাটিতে গণ-বিছানায় শুয়ে আছে....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।