আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এলাকার একমাত্র জবা ফুল গাছ সম্পর্কিত গল্প

যে মুখ নিয়ত পালায়......। ।
গলিতে একটা মাত্র জবা ফুলের গাছ ছিল। যেটাতে প্রায়ই লাল লাল জবা ফুল ফুটত। ফুল অপার সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভুত হলেও মানুষের সে সৌন্দর্য দেখার অবকাশ হয়ত ছিল না।

তাই মানুষজন ফুলের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিত শুধু। দেখত না ভালো করে। সেজন্য তারা কখনো জানতে পারে নি এই অদ্ভুত কথা। এই কথা জানতে পারলে নিশ্চয়ই তারা অভিভুত হয়ে পড়ত। নিশ্চয়ই তারা আনন্দিত হত।

কেউ কেউ গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করত। নানা প্রান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসত হয়ত। হয়ত কোন কোন গবেষক এই গাছটি নিয়ে বিরাট প্রবন্ধ রচনা করতেন আন্তর্জাতিক কোন জার্নালে। তখন এলাকার লোকজন এই ফুল গাছের জন্য নিশ্চয়ই গর্ববোধ করত। তারা আশপাশের এলাকায় গেলে এই গাছের গল্প করত।

এলাকার মেয়েরা যখন বিয়ে হয়ে অন্য এলাকায় যেত তখন বাপের বাড়ি সম্পর্কে কথা বলার সময় এই গাছের কথা নিশ্চয়ই প্রথমে থাকত এবং সদ্য বিবাহিত মেয়েরা যখন তাদের ননদ কিংবা শাশুরী অথবা পাশের বাসার মহিলার সাথে এই গাছের কথা বলত তখন তাদের চোখ হয়ত আনন্দে চকচক করে উঠত। হোসেন মিয়ার বাড়ির পাশে তার নিজস্ব ভিটায় জবা ফুলের গাছটি থাকায় হয়ত তখন তার সম্মান ও বেড়ে যেত। সে হয়ত তখন নিজেকে বিশেষ কেউ মনে করত। এমনকী গাছের সাথে ছবি তোলা, ছুঁয়ে দেখা ইত্যাদির বিনিময়ে সে হয়ত টাকাও দাবী করে বসত কারণ হোসেন মিয়া একজন পুরোদস্তুর বিবেকবর্জিত লোক। এতসব কিছু হতে পারত।

কিন্তু তার কিছুই হয় নি। কারণ কেউই সেই জবা ফুলের গাছের দিকে ভালোমত লক্ষ্য করে দেখে নি কোনদিন। এলাকার জমির সাহেবের নাতনী একবার ফুলের জন্য কান্না জুড়ে দিল। ফুল না হলে সে ভাত খাবে না। এ কীরকম কথা? বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে জমির সাহেব ঘোষনা দিলেন এলাকা খোজে একটা ফুল নিয়ে আসো।

ফুল ছাড়া আমিও কিছু খাব না। সেদিন জমির সাহেবের চাকর বাকরেরা ফুল খোজতে বের হল। জমির সাহেব লোকটি এলাকার সবচেয়ে ধনী লোকদের একজন। তার বাড়িতে চাকর বাকরের সংখ্যাও অনেক। সবাই মিলে পুরো এলাকা খোজে কোন ফুল গাছ পেল না।

জমির সাহেব প্রচন্ড রেগে গিয়ে চাকর বাকরদের জিজ্ঞেস করল, আমার জায়গায় ফুলগাছ লাগাছ নি কেন? বান্দির পুত। তখন প্রথমবারের মত জমির সাহেবের চাকর বাকরদের মনে হল বাড়িতে ফুলগাছ লাগানো উচিত ছিল। ঘরের কাজ শেষ করে তারা অনেক সময় পায়। তখন কেউ কেউ হিন্দি সিরিয়াল দেখে, কেউ কেউ গলির চায়ের দোকানে জিনিসপত্র আনার নাম করে বসে থেকে আড্ডা দেয়। তারা ফুলগাছ এই সময়ে লাগাতে পারত।

লাগায় নি বলে তাদের অনুশোচনা হতে থাকে। অনুশোচনা এমন জিনিস যা শুরু হতে থাকলে বাড়তে বাড়তে। বাড়তেই থাকে। জমির সাহেব চাকর বাকরদের সাথে রাগ করে নিজেই বেরিয়ে পড়েন। আজকে ফুলের একদিন কি তার একদিন।

তিনি রাস্তায় যখন বের হয় তখন তার সাদা পাঞ্জাবীর পকেটে কালো মানিব্যাগ দেখা যেতে থাকে। তিনি দ্রুত পায়ে চলতে থাকেন। রাস্তার পাশের কুকুর তার চলা দেখে বেশ অবাক হয়। কারণ এই কুকুর এই অঞ্চলের “লোকাল”। সে জমির সাহেবকে হেলেদুলে চলতেই দেখেছে।

কুকুরের অবাক হওয়া বাড়তেই থাকে। কুকুরেরা অবাক হলে দাঁড়িয়ে যায়। এই কুকুর ও দাঁড়িয়ে থাকে। জমির সাহেব কুকুরকে ফেলে অনেক দূরে চলে যান। গলি যেখানে বাঁক নিয়ে চিপা গলিতে ঢোকে গেছে সেখানে পৌছানোর পর তাকে আর দেখা যায় না।

তবুও কুকুর ঐদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জমির সাহেব চিপা গলির ভিতরে ডানদিকে চায়ের দোকানে বসা লোকজনের সামনে গিয়ে বলেন, কি মিয়ারা, ফুলের গাছ আছে নি? চা খাচ্ছিল কেউ কেউ। চায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল কেউ কেউ। আর কেউ কেউ এমনি বসে ছিল। তারা সবাই এলাকার ধনী এবং সম্মানী ব্যক্তি জমির সাহেবের এই প্রশ্নে অবাক হয়।

একজন উৎসাহের সাথে বলল, জে না, চাচাজি। এইদিকে ফুলের গাছ দেখি নাই। জমির সাহেব রাগে ফুসে উঠেন, কি কও? একটা এলাকা তাতে ফুলগাছ থাকব না? তোমরা ইয়াং জেনারেশন তাইলে কোন বালটা ফালাও? এরকম ক্রুদ্ধ প্রশ্নে চায়ের দোকানের লোকজন বেশ অবাক হয়। এত রাগের কারণ বুঝতে না পেরে কেউ কেউ মাথা চুলকায়। জমির সাহেব চলে যান হন হন করে।

তখন চায়ের দোকানের কেউ কেউ আস্তে করে বলে, হালার মনে রঙ লাগছে নি? তারপর চায়ের দোকানে অন্য কথা উঠে। সরওয়ার সাহেবের পালিয়ে যাওয়া মেয়ে ফেরত এসেছে। সেই ফেরত আসা মেয়েকে কেন্দ্র করেই গল্প আবির্ভুত হয়। জমির সাহেব আরেকটু দূরে এগিয়ে যান। প্রতি বাড়িতে ঢোকে তিনি ফুলগাছের খোজ চালাতে থাকেন।

একটু আগে তার চাকর বাকরেরা ফুলের খোজে এসেছিল। সুতরাং মানুষদের কৌতুহল হয় কেন জমির সাহেব ফুলগাছ খোজছেন। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে, জমির সাহেবের মত হিসেবী মানুষ, যার প্রতিটা দিন পয়সা প্রসব করে সে কেন ফুল গাছ খোজছে? তার মানে নিশ্চয়ই ফুলগাছে এর চেয়েও লাভজনক কিছু আছে। তাই এলাকার লোকেরাও জমির সাহেবের সাথে ফুলগাছের খোজে বের হল। সারা এলাকা তন্ন তন্ন করে খোজা হল।

কিন্তু কোন ফুল গাছ নেই। পাশের এলাকায় ফুলগাছ আছে, এই কথা জমির সাহেবকে একজন জানালে তিনি বললেন, লজ্জা করে না মিয়ারা? নিজেদের এলাকায় ফুলগাছ নাই, অন্য এলাকায় আছে , এইটা কইতে লজ্জা করে না? সবাই বুঝে গেল এই এলাকারই ফুলগাছ দরকার। ঠিক তখনি শিকদার সাহেবের ছোট ছেলে বলল, হোসেন মিয়ার বাড়ির পাশের জবা ফুল গাছের কথা। লোকজন তখন জিজ্ঞেস করল, আমরা যে আজ দেখে এলাম, তখন তো কোন জবা ফুল গাছ পাই নি? শিকদার সাহেবের ছোট ছেলে জানাল, গাছে উপরে কয়েকটা ভেজা বস্তা কে যেন শুকাতে দিয়েছিল। তাই দেখা যায় নি।

জমির সাহেব এই কথা শুনে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, অসভ্য ইতরের দল! ফুলগাছে বস্তা শুকায়! মুহুর্ত দেরী না করে জমির সাহেব সহ সবাই জবা ফুলের গাছের সামনে চলে গেল। হোসেন মিয়ার বাড়ি পাশেই ছিল। সেও বেশ অবাক হয়ে বের হয়। উপস্থিত জনতা দেখল বস্তার তলায় উঁকি দিচ্ছে লাল লাল ফুল। একজন দৌড়ে গিয়ে বস্তা সরিয়ে দিতে বেরিয়ে আসল বেজোড় সংখ্যক জবা ফুল।

এলাকার লোকজনের তখন মনে হল তারা এরকম সুন্দর ফুল আর কখনো দেখে নি। হোসেন মিয়া তাড়াতাড়ি লোকজনের সামনে এসে বলল, আপনেরা? এইখানে কেন? কি হইছে? কেউ কিছু বলার আগে জমির সাহেব বললেন, কিছু না। দুইটা ফুল নিব। চতুর হোসেন মিয়া এত লোকজনের উপস্থিতি এবং ফুল নিতে চাওয়া দুইটা্কে একসাথে মিলিয়ে নিয়ে বুঝতে পারে কিছু গুরুত্বপূর্ন আছে এই ফুলে। সে টেনে টেনে বলে, ফুল নিবেন বালা কথা।

কিন্তু এইগুলা তো আর যেনতেন ফুল না। অরিজিনাল। জমির সাহেব বলেন, অরিজিনাল ফুলই নিব। হোসেন মিয়া জবাব দেয়, ভাইসাহেব, অরিজিনাল ফুলের একটা কস্ট আছে। উত্তেজিত হন জমির সাহেব।

তবু লোকজনের সামনে নিজেকে সংযত রেখে বলে, কত দাম চাও? হোসেন মিয়া আবার টেনে টেনে বলে, এই ধরেন গিয়া, ফুল ত অরিজিনাল, পার ফুলে ছয়হাজার। লোকজন অবাক হয়। কেউ কেউ ধমক দেয়, এই মিয়া, এইসব কি কও? পাগল হইছ নি? হোসেন মিয়া বলে, দেখেন ভাই পুষাইলে নিবেন। না পুষাইলে নিবেন না। এই ফুল অন্যরকম।

এই এলাকায় কোন ফুলগাছ হয় না। এইটা হইছে। এই ব্যাপারটা বিশেষ কিছু না? সবাই বেশ ধাঁধায় পড়ে যায়। জমির সাহেব পড়ে যান চিন্তায়। এখন ফুল না নিয়ে গেলে এলাকার লোকজনের সামনে ইজ্জত যাবে।

তাই সে দুটা ফুল নেয়। বারো হাজার টাকায়। হোসেন মিয়া বারো হাজার টাকা নিয়ে ঐ রাতেই শহরে ঘুরতে বের হয়। পরদিন সকালে দেখা যায় যেই জায়গায় জবা ফুলগাছ ছিল সেই খানে এক বড় গর্ত। কিছু দূরে গাছটার খন্ড বিখন্ড অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

এভাবেই এলাকার একমাত্র লাল জবা ফুল গাছের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হওয়ার আগেই সে মারা গেল। গাছটি পূর্ণিমা রাতে ঠিক মানুষের মত কথা বলতে পারত। ছবিঃ Matt Paramo
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.