বাবা ছিলেন আমাদের বাসার মেহমান, প্রবাসে থাকতেন, বছরে একবার মাস খানেকের জন্য বেড়াতে আসতেন। আর আমি যেহেতু ছোট বেলা থেকেই পরিবারের বড় ছেলে হয়ে জন্মেছি তাই বাসার বাজার সদাই করা আমার নিয়মিত দায়িত্ব ছিলো। বাজারে কখন কী পাওয়া যায়, সদাইপাতি কী করে বেছে নিতে হয়, লাল আলু ভালো না সাদা আলু খেতে ভালো, ডিমওয়ালা ইলিশ বেশি রুপালী নাকি ডিম ছাড়াটা সেসব জ্ঞান অনেক আগেই আহরণ করে ফেলেছি। বাজার থেকে ফেরা খুচরা টাকা গুলোই যেহেতু ঐ বয়েসের ছেলেদের এক মাত্র রোজগার তাই বাজার করাটাকে কখনই বিরক্তিকর কাজ মনে করিনি। বরং পকেট গরম রাখার জন্য হলেও বাজারে যেতে বেশ লাগতো।
নিয়মিত বাজারে যেতে যেতে শাক সবজির প্রতি একধরনের ভালোলাগা তৈরী হল। সে ভালোলাগা রান্না করা শাক সবজির প্রতি না; কেবল কাঁচা শাক-সবজির প্রতি। ছাদের টবে বা বাসার সামনে চিলতে জায়গায় যেখানেই রোদ পায় এমন উর্বর মাটি দেখি সেখানেই ইচ্ছে করে সবজির চারা লাগাতে। শীতকালে টবের গাছে কসমস বা গাদা ফুল দেখতে যেমন সুন্দর লাগে ঠিক তেমনি টবের ছোট টমেটো গাছে সবুজ, হলুদ বা লাল টসটসে টমেটো ধরে আছে দেখতেও আমার একই রকম ভাল লাগে। সত্যি কথা বলতে, ফুল গাছের চেয়ে ফল বা সবজির গাছই আমি বেশি ভালোবাসি।
আমার ভেতরে শিল্প রুচির কিছুটা ঘাটতি থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু চাষী সত্ত্বা যে প্রবল সেটা আমি নিশ্চিত বুঝতে পারছি।
কিন্তু সেই সময় বেশীর ভাগ কম বয়সী বালকের মত আমারও- সবজি গুলো রান্না হয়ে পাতে এলে আর ভালো লাগত না। বিরক্তিকর খাবার মনে হত। ভালো লাগত গরুর মাংসের ভুনা, খাসির রেজালা, মুরগির রোস্ট, পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, খিচুরি এসব। যেটুকু সবজী আর মাছ খেতাম তা শুধু আম্মুর চাপে পরে।
সে সময় যাদের চ্যাপার শুটকি ধনেপাতার ভর্তা বা ছোট মাছ, লাউ শাক পছন্দ তাদের কে দেখলে বিরক্ত লাগতো, আমার আঁতেল মনে হোত। ভাগ্যের অদ্ভুত পরিহাসে আজ আমি তাদেরই একজন।
আমার এই আবাউট টার্ন পরিবর্তনের শুরু পাঁচ বছর আগে যখন উচ্চতর পড়াশুনার সুযোগ পেয়ে সুইডেনে গেলাম। এবং পরবর্তীতে এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হয় আমার প্রিয়তমেষুর শৈল্পিক রান্নার গুণে। সুইডেনে থাকতাম লিনশপিং নামে এক শহরে যেটা সে দেশের রাজধানী স্টকহোম থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে।
সেখানে আমাদের দেশীয় শাকসবজি খুব একটা পাওয়া যেতো না। পুরো শহরে কাঁচামরিচ বিক্রি হত শুধু মাত্র একটি থাই দোকানে। হঠাৎ হঠাৎ ধনেপাতার দেখা পাওয়া যেত তবে সব সময় না। সে সময় সবজী বলতে মুলত আলু, টমেটো, ফুল কপি আর ব্রকুলী। এর বাইরে অপরিচিত কিছু সবজী ছিলো কিন্তু কিভাবে ক্ষেতে হয় জানা ছিলো না।
দাঁত হারিয়ে দাতের মর্যাদা বোঝার মত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে এসে সবজির গুরুত্ব বুঝতে পারি প্রথম বারের মত।
এখন আর সুইডেনে থাকি না, থাকি নরওয়ের ওসলোতে। এটা রাজধানী হওয়ায় বাংলাদেশী সজনে ডাঁটা, লাল শাক, উইস্তা, বক ফুল, পান সুপারী, এমনকি কলাপাতাও পাওয়া যায়। দোকানে দোকানে ঘুরে নানান সবজী আর নানান পদের মাছ খুজে বের করি। কুচো চিংড়ি দিয়ে উস্তা ভাজী খাবারের মেনুতে এখন সব চেয়ে হিট।
নতুন কোন দেশীয় সবজী পেলেই আগ্রহ নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখি আর ভাবি আমাদের দেশের মানুষরা কত ভাগ্যবান যে এত মজার এত বৈচিত্র্যপূর্ণ তরিতরকারি জন্মায় আমাদের ক্ষেতে। পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ তাদের প্রতিদিনের খাবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ২ থেকে ৩টা সবজী দিয়েই রান্না করে।
পশুপাখির প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে মানুষ যেমন ঘরে টিয়াপাখি থেকে শুরু করে কুকুর, বেড়াল পালে ঠিক তেমন আমি শাক সবজির প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে আমি ঘরে সবজী চাষ শুরু করলাম। নার্সারি থেকে মাটি কিনে আনলাম, দুইটা টব কিনলাম, টমেটো আর বেগুনের বীজ কিনে টবের মাটিতে পুতে দিলাম। কোনটাই চারা হয় না।
ঘরে পেঁয়াজ থাকতে থাকতে অঙ্করোদগম হলে সেটাও পুতে দিলাম। এদিকে কিছুদিন আগে মিষ্টি কুমড়া খেয়ে ছিলাম। বউ সেটার বিচি শুকিয়ে সেই টবের মাঝে পুতে দিয়েছিল। প্রতিদিনই সবুজ কোন কিছুর অস্তিত্ব খুঁজি টবে কিন্তু অনেক দিন হয়ে গেলেও চারা গজানোর কোন লক্ষন না দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু একসময় আমাদের দুজনকে খুশীর ভেলায় ভাসিয়ে একটি দুটি করে কুমড়ো চারা মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে এলো।
আমরা দুজন অফিসিয়ালি কিশান কিষাণী হয়ে গেলাম।
আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তার বেশিরভাগ জুড়েই সেই গাছ গুলো। এক সময় আরো কিছু চারা উঠলো টবের মাটিতে। সেখানে টমেটো আর বেগুন দু`রকম চারাই আছে। কিন্তু তৃতীয় পাতা গজাবার আগে এদের আলাদা করার উপায় নেই।
গাছ গুলো একটি আরেকটির সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হল। আমাদের দুজনের এই ছোট্ট ঘরে তাদের জন্য আর পর্যাপ্ত আলো বাতাস নেই। তাই তাদের বাইরে উঠানের নিয়ে গেলাম। টমেটো আর বেগুন গাছ আলাদা করে দিলাম। কাপড় শুকানোর স্ট্যান্ড টেনে লম্বা করে রশি দিয়ে বেঁধে কুমড়ো গাছের মাঁচা বানিয়ে দিলাম।
কুমড়ো গাছ লকলকিয়ে সেই মাঁচায় স্প্রিং এর মত সবুজ আংটা ধরে ধরে উপরে বেয়ে উঠতে লাগলো। বেগুন গাছের পাতা পর্যাপ্ত আলো পেয়ে এমন ভাবে বড় হতে লাগলো কেউ দেখলে সেটাকে সেগুন গাছের পাতা বলেও ভুল করতে পারে।
যেদিন কুমড়ো গাছে ফুল দেখা গেলো সেদিন আর আমাদের আনন্দ দেখে কে। যে কোন আনন্দ কারো সাথে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে। তাই বাড়িওয়ালা কে, তার বউ কে এবং শাশুড়িকে ডেকে আমাদের গাছের ফুল দেখালাম।
তাদের কে এও জানালাম কুমড়ো ধরলেই তাদের বাসায়ও একটি পাঠিয়ে দিবো। যদিও কোন ফুলটি থেকে কুমড়ো হবে বুঝতে পারছিলাম না। কারণ এই ফুলে আবার ছেলে মেয়ের ব্যাপার আছে। একই গাছে দু`রকম ফুল হয়। ছেলে ফুল বেসন ডাল দিয়ে ভেজে বড়া বানিয়ে খেয়ে ফেলতে হয়।
মেয়ে ফুল ধীরে ধীরে কুমড়ায় পরিনত হয়। ছেলে ফুলকে মেয়ে ফুল থেকে আলাদা করার বৈশিষ্ট জানা ছিলো না বলে কোন ফুলই বড়া বানাচ্ছিলাম না। কিছুদিন পরে অবশ্য এদের আলাদা করতে শিখে যাই। তারপরও অতিরিক্ত মায়ার কারণে কোন ফুল ছিঁড়ে বড়া বানিয়ে খেতে পারিনি।
একদিন টমেটো আর বেগুন গাছেও ফুল আসলো।
উঠানে মৌমাছি আর ভ্রমরের আনাগোনা লক্ষণীয়ভাবে বাড়লো। এদের মধ্যস্ততায় ফুলগুলোর মাঝে প্রণয় হল। সেই রোম্যান্টিকতায় টমেটো গাছ যে এগিয়ে ছিলো তার প্রমাণস্বরূপ সবার আগে টমেটো ফুল গুলোই সবার আগে ফলে রূপান্তরিত হল।
বাংলাদেশে শীত কালটাই শাক সবজী চাষের জন্য উপযুক্ত হলেও এদেশে গ্রীষ্মকাল ছাড়া অন্য কোন সময় ঘরের বাইরে এসব চাষ করা সম্ভব না। বীজ রোপণ করতে হয় বসন্তের শুরুতেই ঘরের ভেতর তার পর চারা গজালে সেগুলো বীজ তলায় লাগিয়ে দিতে হয়।
আমরা শুরু করেছি দেরিতে তাই যখন ফল হবার সময় হল তখন বাইরের তাপমাত্রা কমতে কমে ১০ ডিগ্রি সে: এর নিচে নেমে এলো। তাই এবার আর কুমড়ার মুখ দেখা হলো না। বেগুন একটি হয়েছিল (ছবি খুজে পাচ্ছি না তাই দেখাতে পারছি না। )। টমেটো তিনটি।
কুমড়োর স্ত্রী ফুলের গোড়ায় স্ফীত হতে দেখলেও সেটা কে কুমড়া বলে চালিয়ে দেয়া ঠিক হবে না।
আগামী বছর ঠিক সময় মত আবাদ শুরু করবো ভেবে রেখেছিলাম। শুনেছি চাষবাসে আগ্রহী হলে গ্রীষ্ম কালে এলাকার পৌরসভার কাছ থেকে রাস্তার চত্বরের আইল্যান্ড বা বা পার্কের মত ছোট কোন জমি ধার নেয়া যায়। সেরকম একটি জমি নিয়ে আগামী বছর জোড়েসড়ে হাল চাষ করবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু মাস-দেড়েকের মাঝে কাজের খাতিরে এক বছরের জন্য আমেরিকা যেতে হচ্ছে তাই নরওয়েতে কৃষি পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।