আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুরুষ দোকানদার এর বড়ই অভাব! সব সম্ভবের দেশ- চীন: পর্ব ৭ [বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে]

ভুল করেছি,প্রায়শ্চিত্য করবো না, তা তো হয় না একটা অ্যারাবিয়ান গান আছে : নারী....নারী, নারী....নারী, নারী মিনগ্যা মানু; এই গানে নারী বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা জানি না তবে বাংলা ভাষার সাথে মিল রেখে এটুকু বলা যায় চীনে বিজনেস মানেই নারী, রাস্তার হকারী থেকে শুরু করে বড় বড় সব প্রতিষ্ঠানের দোকানদারই নারী। আপনি সবজি কিনতে যাবেন দোকানদার নারী, ফলের দোকান, মুদি বা মনোহারী, কাপড়-চোপড়, মাছের দোকান, মদ-বিয়ারের দোকান সব জায়গায় নারী....নারী.... মাংসের দোকানের কসাই থেকে শুরু করে, জুতার মুচি, সাইকেলের মেকার, ওষুধের দোকান, খাবার দোকানের ওয়েটার থেকে ক্যাশিয়ার সব পদেই নারী....নারী.... নারী....নারী....আল বি-ই-গ্যা রানু চীনা প্রবাদে আছে "তুমি যদি হাসতে না জানো তাহলে ব্যবসা করো না" চাইনিজ ছেলেরা কাস্টমারের সাথে মেয়েদের মতো হাস্যরসের সহিত কথা বলে কনভিন্স করতে পারে না বলেই এই সেক্টরটা পুরোপুরি মেয়েদের দখলে। বেইজিং এ সিল্ক মার্কেটে সব মিলিয়ে ১০ জনের মতো পুরুষ দোকানদার দেখেছি, তাও মূলত ছেলেদের কাপড় তৈরী করে এমন টেইলার্সে। এতবড় বিশাল এক মার্কেট পুরুষ দোকনদার খুঁজে পাওয়া যায় না। মেয়েরা যে শুধু চাইনিজ কাস্টমারদের কনভিন্স করতে পারে তা কিন্তু নয় ফরেনারদের সাথে ডিল করার ক্ষেত্রেও এরা সফল।

মেয়েরা ইংরেজীতে কথা বলার ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে একধাপ আগানো থাকায় এক্সট্রা এডভান্টেস পায়। বাংলাদেশী ব্যবসায়ী যাদের চীনের সাথে ব্যবসা আছে তারা বিজনেসে মেয়েদের একচেটিয়া আধিপত্যের ব্যাপারে অনেক ভাল জানেন। আচ্ছা চিন্তা করুন নীলক্ষেতে কোন একটা হালিমের দোকানে যদি যুবতী মহিলা ওয়েটার হয় তাহলে কি অবস্হা হবে! ভিড়ের চোটে জায়গা দিতে পারবে না ! দোকানদার মহিলা বলে যে ওখানে পুরুষরা ভিড় জমাবে, দুই একটা রসকসের কথা কবে উহু চাইনিজ ছেলেদের এরকম করতে দেখা যায় না। আমদের দেশে সখিনার মায়ের চায়ের দোকানে সমাজের ধনী মাতব্বর লোকটিও গিয়ে ভিড় জমায়। ইটিস পিটিস করতে চায়।

শহীদ মিনারের পশ্চিম পাশে বুয়েটে ঢোকার রাস্তার মোড়ের ফুটপাতে কয়েকজনকে ভাত বিক্রি করতে দেখতাম, সেখানে রিকশাওয়ালারা মহিলা ভাত বিক্রেতার ওখানেই বেশি ভিড় জমাতো। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি এই ক্যাম্পাসের সেলুনের মালিকসহ ৬ জন নাপিতের মধ্যে ৪ জনই মেয়ে। এদের সেলুনের সিস্টেম চুল কাঁটার আগে মহিলা নাপিতরা তাদের নরম হাতের কোমল ছোঁয়ায় মাথায় শ্যাম্পু মেখে সুন্দর করে ধুঁয়ে নেয় তারপর হেয়ার ড্রাইয়ার দিয়ে শুকিয়ে চুল কাঁটা শুরু করে। প্রথম যেদিন চুল কাটাইতে গেছি সেদিন এমন এক আজব ঘটনা ঘটছে যা কোনদিন ভুলবো না। চুল কাটার শুরুতেই আমার মাথার সাথে ইয়াং সুনয়না যুবতী নাপিতের সুনামির চেয়েও দ্রুতগতিতে হৃদয়মাঝে ঝড় তুলতে সক্ষম, একে-৪৭ এর চেয়েও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হিয়ার মাঝে ভূজঙ্গতীর বিঁধাতে সক্ষম বক্ষদ্বয়ের সাথে স্পর্শ লাগছে, আমি ভাবলাম সে ভুল করে আমার মাথার সাথে তার জিনিসখানা লাগাই দিছে তাই স্পর্শ লাগার সাথে সাথে মাথাটা সামনের দিকে আগাইয়া নিলাম কিন্তু এরপর যা ঘটলো সেটা আমাদের দেশে পিচ্চি পোলাপানরে চেয়ারের উপর একটা তক্তার উপর বসিয়ে এক হাত দিয়ে মাথার সামনের দিক ধরে আর মাথার পেছন দিকটা নাপিতের বুকের সাথে লাগিয়ে রাখে যেন নড়াচড়া করতে না পারে।

এ সেরকমই আমার মাথার পেছন দিকটা তার জিনিস দুইটার মাঝখানে বসাইয়া সামনের দিকের চুল কাটা শুরু করল। আচ্ছা একটা জিনিস চিন্তা করুন সেলুনে কোন ক্ষুর নাই, এটা কি সম্ভব! হাঁ এখানে যে কয়টা দোকানে গেছি কোথাও ক্ষুর দেখি নাই। তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে এরা চুল না হয় ইলেকট্রিক কাটার দিয়ে কাটলো কিন্তু শেভ করবে কিভাবে? চাইনিজদের অল্প একটু দাড়ি হয়, ওটুকু ইলেকট্রিক কাটার দিয়েই করে; ক্ষুর দিয়ে কারো ক্লিন শেভ করে না । আমাদের দেশে অফিসের রিসেপশনিস্ট মেয়েরা যেমন সবসময় মেকআপ করে থাকে চৈনিক দোকানদার মেয়েরাও ঠিক তেমনি অলটাইম মেকআপের উপরেই থাকে। শুধু বড় বড় দোকানের মেয়েরা নয় মাছ বিক্রেতা, ফল বিক্রেতা সব মেয়েই।

একদিন এক চকলেটের দোকানে দেখি এক মেয়ে সে বোধ হয় নতুন, মেকআপে দক্ষ নয় সে চোখে আগলা পাপড়ি লাগাইছে সাদা স্কচটেপ দিয়ে, লাইটের আলোতে চোখের পাতার উপর স্কচটেপ চিকচিক করতেছে, এক কানি একটু উঠেও গেছে। শুধু ধর্মে অবিশ্বাসী চাইনিজ মহিলারাই যে বিজনেস করে তা নয় বরং মুসলিম মহিলারাও বিজনেসে সমানভাবে এগিয়ে, অনেক মুসলিম মহিলা দোকানদার মাথায় স্কার্ফ পড়েন। এখানকার মসজিদগুলো যেন এক একটা কমপ্লেক্স নিচতলায় গরুর মাংস সহ হালাল খাদ্যদ্রব্যের বেশ কয়েকটা দোকান থাকে। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি এই ক্যাম্পাসের পাশেই একটা মসজিদ আছে, ওখানকার মাংসের দোকানের কসাই একজন মুসলিম মহিলা। এছাড়া মুসলিম রেস্টুরেন্টগুলোতেও ওয়েটার মহিলা।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিংয়ে মুসলিম ছাত্রদের জন্য আলাদা একটু জায়গা থাকে, ওখানে মহিলা ওয়েটাররা মাথায় টুপি পড়ে যদিও প্যান্ট, গেঞ্জি পড়েন। মহিলারা কাস্টমার পটাতে উস্তাদ, এক বাংলাদেশী বড় ভাইয়ের কাছে শুনেছি উনি কাপড় কিনতে ঢুকছেন এসময় এক পিচ্চি এসে বিক্রেতা মহিলাকে মা মা বলে ডাকতেছে আর ঐ মেকআপ করে যুবতী সাজা মহিলা বাচ্চাকে চুপ করাতে চেষ্টা করছে। দামে পরতা না পড়ায় বড় ভাই দোকান থেকে বের হয়ে চলে আসার সময় শুনছে ঐ মহিলা তার বাচ্চাকে শাসাতে শাসাতে বলছে তুই আমারে মা কইয়া ডাকলি দেইখা কাস্টমার চলে গেল ! এক চাইনিজ ফ্রেন্ডকে বিজনেস সেক্টরে মেয়েদের একচেটিয়া আধিপত্যের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে সে বললো মেয়েরা যোগ্য, দক্ষ তাই আমরা ছেলেরা এটা মেনে নিয়েছি। কথা সত্য চীনের সবচেয়ে ধনী যে ব্যক্তিটি সে একজন মহিলা, সে রাজনীতিবিদ কিংবা চাকরিজীবি নন; একজন ব্যবসায়ী। ঐ চাইনিজ ফ্রেন্ডকে আরও জিজ্ঞেস করেছিলাম বিজনেস সেক্টরে মেয়েদের এত জয়জয়কার তাহলে রাজনীতিতে মেয়েদের সংখ্যা এত কম কেন? কিছুদিন আগে চীনা কমিউনিস্ট দলের নেতা সিলেকশন কনভেনসনে সারা দেশ থেকে যাওয়া কয়েক হাজার প্রতিনিধির মধ্যে হাতে গোনা অল্প কয়েকজন নারী কেন? ও যেটা উত্তর দিল মেয়েরা বিজনেসের ক্ষেত্রে দরদামে সফল হলেও নেতা হিসেবে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের ক্ষেত্রে হতে হবে কঠিন হৃদয়ের, কোনো দোষী অপরাধীর মায়াকান্না দেখে গলা যাবে না, সামনে কচকচা টাকা দেখেও লোভ সামলাতে হবে।

এসব বিবেচনায় শুধুমাত্র যেসব মহিলা দক্ষ শুধু তারাই চীনা কমিউনিস্ট দলের নেতা হতে পারে। আমি চিন্তা করে দেখলাম কথা সত্য, কটা মেয়েই আর মার্গারেট থেচারের মত লৌহ মানবী হতে পারে কিংবা হিলারী ক্লিনটনের মত লিবিয়ায় রাষ্ট্রদূত হত্যার দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করে মহানুভবতা দেখাতে পারে ! মেয়েদের সামনে টাকা ঘুরঘুর করলে আলিশান জীবন-যাপনের প্রতিই বেশি ঝুঁকে যায়, ঘরের ডেকোরেশন করে দামি দামি জিনিস দিয়ে, দামি গহনা, দামি শাড়ি-কাপড় তথা বিলাসবহুল জীবন পছন্দ করে। মেয়েরা যেভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে জিনিস কেনে অধিকাংশ ছেলেরা সেটা পারে না। কাঁচাবাজার করতে গেলে একটা মরিচও পঁচা হবে না, দরদামের দিক থেকেও মেয়েরা এগিয়ে। দেশ-বিদেশে ব্র্যাকের আড়ংয়ের আজকের সফলতার পেছনে মেয়েরাই নেতৃত্ব দিয়েছে।

বিজনেসে মেয়েদের বিশ্বব্যাপী দাপট চোখে পড়ার মত কিন্তু রাজনীতিতে উন্নত বিশ্বেও সরকারপ্রধান হিসেবে মেয়েদের সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। যোগ্যতা না থাকলে শুধু চেহারা দেইখ্যা তারা কাউরে ভোট দেয় না ! চীনা প্রবাদে আছে "উ চি পি ফান" অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল না। আমাদের দেশে চাকরি, রাজনীতিতে মেয়েদেরকে যোগ্যতা বিচার না করেই যেভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে তা কখনও সমাজের জন্য সুখকর হবে না। যে মেয়েটি শুধুমাত্র নারী হিসেবে চাকরি বা রাজনীতিতে নিয়োগ পেয়েছে সে এবং তার পরিবার লাভবান হলেও দেশ তথা জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৯৮ সনে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে আমার এক আত্নীয় সম্পর্কে ফুফুর চাকরি হয়।

ঐসময় মেট্রিক পাস মেয়েদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেসময় ফুফুকে বলেছিলাম আপনার নিজের ইংরেজি উচ্চারণই তো ভুল, জাতি গঠনের কারিগর হিসেবে বাচ্চাদের কি শেখাবেন ! উল্লেখ্য সেসময় অনেক বিএ, এমএ পাস ছেলে লিখিত, ভাইবায় অনেক বেশি নম্বর পেয়েও চাকরি পায় নি অথচ মেয়েদের জাস্ট লিখিত পরীক্ষায় পাশ নম্বর পেলেই ভাইবাতে এমনিই পাশ আর চাকরী। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.