আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সহিংস হরতাল নিষিদ্ধে উচ্চ আদালতের দিকে সব

দাদির সঙ্গে ঢাকা দেখতে এসেছিল সুমি। সেই সুদূর নেত্রকোণা থেকে। জীবনে প্রথমবার সাধের ঢাকায় এসে ৩ নভেম্বর গাজিপুরে হরতাল সমর্থকদের দেওয়া আগুনে দগ্ধ হয়েছে আট বছরের এই শিশু। হাসপাতালে কাতরাচ্ছে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার দাদি-নাতনি দুজনেই। আর সর্বশেষ সমাপ্ত দুটি ৬০ ঘন্টার হরতালে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩৪ জন। এদিকে হরতাল ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সৃষ্ট সহিংসতায় দেশে গত ২২ বছরে আড়াই হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে একটি খবরে। আর বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, দেশে এক দিনের হরতালে ক্ষতি হয় অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা।

হরতাল ও রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষয়-ক্ষতি এবং রক্তপাতের এই পরিসংখ্যানে আতঙ্কিত মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ধরণের কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। এ অবস্থায় অসহায় নাগরিকরা এখন সহিংস হরতাল নিষিদ্ধের আদেশ দেখতে তাকিয়ে আছে উচ্চ আদালতের দিকে। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো যখন হরতালের সহিংসতায় নৃশংস ও জঘন্যভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, তখন সেই অসহায় নাগরিকদের উদ্ধার করতে মানুষের মৌলিক অধিকারের রক্ষক উচ্চ আদালত এগিয়ে আসবে নিশ্চয়।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সহিংস হরতালে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার একাধিক গবেষণা অনুযায়ী, এক দিনের হরতালেই ক্ষতি হয় অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা। আর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে পোশাকশিল্প, ক্ষুদ্র উদ্যোগ এবং পরিবহন। হরতাল যতই সহিংস হয়ে উঠছে ততই বিনষ্ট হচ্ছে ব্যক্তিগত ও জাতীয় সম্পদ। খালি হচ্ছে মায়ের বুক। ক্ষুদ্র আয়ের মানুষের জীবনে অভিশাপ হয়ে উঠেছে হরতাল। সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় হু হু করে বাড়ছে চাল, ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুজি ভেঙ্গে খাচ্ছেন। সীমিত আয়ের মানুষেরা নতুন করে অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়েছেন। কমে যাচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগ। ভাটা পড়ছে রপ্তানি। হরতাল অস্থির করে তুলেছে দেশের অর্থনীতিকে। অন্যদিকে বোমাবাজি, সম্পদ ভাংচুর ও অগি্নসংযোগের সহিংস ঘটনায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচেছ মানুষ । আতঙ্কিত দেশবাসী সহিংস হরতালের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি চায়। উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত ও আতঙ্কিত নাগরিকরা আর সর্বনাশা সহিংস হরতালের বলি হতে চায় না। হরতালের নামে জানমালের এই ক্ষয়ক্ষতি থেকে জনগণকে উদ্ধারে একমাত্র ত্রাতা ভূমিকায় অবর্তীণ হতে পারেন উচ্চ আদালত।

এ ব্যাপারে দ্যা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম সংবাদ মাধ্যমে বলেন, 'এই ধারায় চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে বাংলাদেশের বিচার বিভাগেরও। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যখন জনগণকে উদ্ধারে আসছেন না, তখন বিচার বিভাগ কেন এগিয়ে আসবেন না? ২৩ বছর ধরে আমরা গণতান্ত্রিকভাবে সরকার নির্বাচিত করে চলছি, প্রতিটি সংসদ সম্পূর্ণভাবে নির্বাচিত। অথচ প্রতিটি সংসদের মেয়াদকালে বিরোধী দলগুলো সংসদে বৈধ ও অধিকারসম্মত স্থান গ্রহণ না করে ইচ্ছাকৃতভাবে সংসদ বর্জন করে যাচ্ছে, একের পর এক হরতাল চাপিয়ে দিয়ে নাগরিকদের অধিকার খর্ব করছে, ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে জাতীয় অর্থনীতিরও।' তিনি বলেন, 'আইনের শাসন দ্বারা পরিচালিত একটি দেশে, যার সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় সুনির্দিষ্টভাবে নাগরিকদের অধিকার ও দায়দায়িত্বের কথা বলা আছে, সেখানে আমাদের কেন এই ধরনের সহিংসতার (হরতালে) শিকার হতে হবে?' তিনি বলেন, 'এসব বিষয় এবং প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন আদালতের দেওয়া রায়গুলোর আলোকে উচ্চ আদালতে আমাদের আবেদন হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল আহ্বানের 'সাংবিধানিক অধিকার' ভোগের ক্ষেত্রে তাদের অধিকার ও বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হোক। আর হরতালের আগের দিন যেহেতু ঘোষিত হরতালের নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পড়ে না, সেহেতু হরতাল-পূর্ববর্তী সময়ে হরতাল আহ্বানকারী রাজনৈতিক দলের 'সাংবিধানিক অধিকার' ভোগের কোনো প্রশ্ন নেই। বিবেচনায় নেওয়া হোক এ সময়কার নাগরিক অধিকারগুলো।' বিশিষ্ট এই সাংবাদিকের প্রশ্ন, 'আমাদের অধিকারগুলো যখন নৃশংস ও জঘন্যভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, তখনো কি আমাদের উদ্ধার করতে সংবিধান ও আমাদের সব মানবিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের রক্ষক উচ্চ আদালত এগিয় আসবেন না?

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের এক রায়ে জবরদস্তিমূলক বন্ধ (হরতাল) অবৈধ বলে ঘোষণা করেন ভারতের কেরালার হাইকোর্ট। পরবর্তীতে হাইকোর্টের এ রায় বহাল রাখেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। এ ছাড়া জবরদস্তিমূলকভাবে জনসাধারণের কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়াকে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি বলে ঘোষণা করেন ২০০২ সালে। ২০০৩ সালে মুম্বাই শহরে বন্ধ ডাকার দায়ে ২০০৪ সালের জুলাইয়ে শিবসেনা ও বিজেপিকে ২০ লাখ রুপি করে অর্থদণ্ড প্রদান করেন অঙ্গরাজ্যটির হাইকোর্ট। একই বছরের নভেম্বরে তৃণমূল কংগ্রেসের ডাকা বাংলা বন্ধকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করে, বন্ধ প্রত্যাহারে দলটির ঘোষণা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করার নির্দেশ দেন কলকাতা হাইকোর্ট। কোনো রাজনৈতিক দল বন্ধ ডাকলে তার নিবন্ধন বাতিল করতে নির্বাচন কমিশনকে কেরালা হাইকোর্ট নির্দেশ দেন ২০০৬ সালে। জানা যায়, কেরালার হাইকোর্ট যে মামলায় বন্ধের ব্যাপারে মাইলফলক রায়টি দিয়েছিলেন, সেই মামলার আবেদনকারী ছিলেন দুজন সাধারণ নাগরিক ও রাজ্যের বিভিন্ন চেম্বার্স অব কমার্সের সদস্যরা। আবেদনের পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়, বন্ধ ডাকার ফলে যেহেতু ভারতীয় সংবিধানের ১৯ ও ২০ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হয়, তাই তা ঘোষিত হওয়া উচিত 'অসাংবিধানিক' হিসেবে। কেরালা হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, 'কোনো সমিতি, সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের হরতাল ডাকা এবং তা পালন করা বেআইনি ও অসাংবিধানিক।' আদালত এই মত ব্যক্ত করেন যে, 'যেসব সংগঠন এ ধরণের হরতাল ডাকবে, তারা সরকার, জনগণ ও সাধারণ নাগরিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে দায়বদ্ধ থাকবে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতির জন্য। আপিল করা হলেও এ রায় বহাল রাখেন সুপ্রিমকোর্ট। ১৯৯৯ সালের ১৩ মে হরতালের পক্ষে ও বিপক্ষের সব তৎপরতাকে আমলযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয় হাইকোর্টের দেওয়া একটি রায়ে। এসব কার্যক্রমে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় পুলিশ ও নিম্ন আদালতকে। বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আপিল করেন হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে। শুনানি শেষে ২০০৭ সালের ২ ডিসেম্বর হাইকোর্টের রায় বাতিল করেন আপিল বিভাগ। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, দেশে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী হরতালে বিশৃঙ্খলা বা সহিংসতা আমলযোগ্য ও বিচার্য। পুলিশ ও নিম্ন আদালত ব্যবস্থা নিতে পারে প্রচলিত আইনেই। কাজেই পৃথক নির্দেশনার প্রয়োজন নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হরতাল সাংবিধানিক কোন অধিকার নয়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় ঔপনৈবিশিক শক্তি বা স্বৈরতন্ত্র থাকলে হরতাল যৌক্তিক হতে পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে হরতাল প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আর্থিক যে ক্ষতির বিবরণ দেওয়া হয়, হরতালে ক্ষতি আসলে এর চেয়েও অনেক বেশি। আর সেই ক্ষতির আর্থিক হিসাব করা সম্ভব নয়। কারণ, হরতালের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়, দেশটি যে বিনিয়োগের একটি আস্থাভাজন জায়গা, সেই আস্থার জায়গাটি নষ্ট হয়, রপ্তানির নিরাপদ উৎস হিসেবে বাংলাদেশ আর বিবেচিত হয় না। বিশ্বায়িত এই বিশ্বে একবার আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হলে তা সহজে ঠিক করা যায় না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, চলমান সহিংস রাজনৈতিক বিরোধ ও নানা কর্মসূচির তাৎক্ষণিকভাবে বড় ভুক্তভোগী হলেন খেটে খাওয়া মানুষ, দৈনন্দিন আয়ের ওপর নির্ভর করে যাদের জীবিকা। এটি একটি মানবিক সমস্যা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, মানুষ হিসেবে চলাফেরা, যানবাহন ব্যবহার ও ব্যবসায় জানিজ্য তথা পেশা চালিয়ে যাওয়ার অধিকার রয়েছে প্রত্যেক নাগরিকেরই। এ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে হরতালের নামে বাধা দেওয়া, ভীতি প্রদর্শন বা আক্রমণ করা সমর্থন করে না কোন আইনেই। তিনি বলেন, হরতালের নামে কেউ ফৌজদারি অপরাধ করলে অবশ্যই আইনের আমলে আসতে হবে তাকে। ফলে নাগরিকের জীবন, সম্পত্তি, চলাফেরা ও স্বাধীনভাবে কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে কেউ বাধা সৃষ্টি করলে মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার করতে হবে অপরাধ সংঘটনকারীদের বিরুদ্ধে। উচ্চ আদালতের হরতাল বিষয়ক রায়ের নির্দেশনা এবং প্রচলিত আইনে হরতালের নামে যারা অপরাধ সংঘটন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিপূর্ণ সুযোগ রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, হরতালে ক্ষয়ক্ষতির দায়িত্ব হরতাল আহবানকারীদের। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী এটি ফৌজদারি অপরাধ। এজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে দায়ীদের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, 'হরতালের নামে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অন্যান্য কারণে ক্ষয়ক্ষতি থেকে প্রতিকার চেয়ে কেউ আবেদন করলে ব্যবস্থা নিতে পারেন আদালত।

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.