সুখের ঘর ছেড়ে যেদিন সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য নিজের শরীরে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়েছিল রাবেয়া, সেদিনই এই গল্পের শুরু। সোহেলদের বাড়ি থেকে মাত্র শ’দুয়েক গজ দূরে তালেব এর বাড়ি। আর এই তালেবের স্ত্রীর নামই রাবেয়া।
দিনটা বৃহস্পতি ছিল। গ্রামে হাটের দিন।
ওখানে তালেবের একটা ব্যবসায় ছিল, নারকেলের। গ্রামে গ্রামে ঘুরে সে নারকেল কিনে পাইকারি বিক্রি করতো। যদিও ক্রমাগত লোকসানের মুখে তার ছিল খিটখিটে মেজাজ। লোকসানটাও নিজের অবুঝ ব্যবসায়িক মাথার কারণে। বাজারের হালচাল না বুঝে এর-তার কথায় গন্ডায় গন্ডায় টাকা খরচ করে নারকেল কিনে অবশেষে লসে বিক্রি করতে হত।
তবুও ব্যবসায় তার করাই লাগবে। শত মানা করলেও শোনার ছেলে সে না।
আর এই গল্পের সাথে এখানেই সংঘর্ষ। লসের উপর লস দিয়ে পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে চোলাই মদ গিলে ঘরে এসে বৌ এর সাথে ঝগড়া। তারপর নির্যাতন।
এতে আবার বাতাস দিত তার মা। ওই মহিলা সারাদিন বারান্দার চৌকিতে শুয়ে থেকে বেটার বৌ এর খুঁটিনাটি নোট করে রাখত। ছেলে বাড়ি ফিরলেই যে কোন এক ফাকে কানে লাগাত। আর যায় কোথায়! শুরু হত তুলকালাম।
তাও বেশ চলছিল।
বৌটা মানিয়ে নিতে চাইছিল সব কষ্ট সহ্য করেও। কিন্তু পারলো না। আগাগোড়া মদ্যপ হয়ে সেদিন বাইরে থকে ফিরেই সামান্য একটা বিষয় নিয়ে বেঁধে গেল। গালিগালাজ, হাকডাক এর সাথে শুরু হল এবং শেষ হল হালের গরুকে পেটানো ‘হেলো লাঠি’ এর মারে! বৌ যে কোন মানুষ তা এই পেটানো দেখলে মনে হবেনা। মনে হবে শত সহস্রের অবলা জীবকে কষে পেটাচ্ছে মহাকালের কোন ষাড়!
চল্লিশ হাজার টাকা দাবি করেছিল সে শশুরের কাছে।
এই নিয়ে বায়নার তৃতীয় ধাপ চলছিল। প্রথম ধাপে একটা রঙিন টিভি এবং দ্বিতীয় ধাপে একটা বাই সাইকেল ছিল। রাবেয়ার বাবা প্রথম দুটি মিটিয়েছিলেন অনেক কষ্টে। কারণ মেয়ে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। বিয়েতে কিছুই দেওয়া হয়নি।
তালেবরা তাদের চেয়েও একটু শরীফ ঘরের ছেলে। তাই জামাই এর সামান্য আবদার মিটাতে কলুর বলদের মত খেটে আগের দুটো দিয়ে ছিলেন। কিন্তু এবার চল্লিশ হাজার টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। আর এমন দিতে থাকলে চলে কি করে। তারতো আরো মেয়ে আছে।
তারাও দেখছে। ওদেরও বিয়ের পরে যদি এমন দাবী থাকে তবে নিজের শুধু খেটেই যেতে হবে জামাইদের আবদার মেটাতে।
এজন্য রাবেয়া যেদিন প্রথম এসে টাকার কথা উঠিয়েছিল তাকে প্রকারান্তে না করে দিয়েছিলেন। একটু কড়া কথাও শুনিয়ে দিয়েছিলেন। তার মা জামাইকে বুঝিয়ে বলতে বলেছিলেন।
এবং সে এসে তাইই করেছিল। কিন্তু কাজ হয়নি। ফাও পাওয়ার স্থান বন্ধ হয়ে গেলে অলস ও দুষ্কৃতিকারি লোকের মাথা গরম হয়ে যায়। মেনে নিতে পারেনা। তালেবও মেনে নিতে পারলোনা।
তারপর থেকে ভালোবাসা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ও শুরু হল বৌ এর উপর নির্যাতন।
অকথ্য নির্যাতনের মাত্রা এমন সীমাছাড়া হয়েছিল যে বৌকে পিটিয়ে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হত মাঝে মধ্যে! তাতে কাজ না হওয়াতে নতুন ফন্দি আঁটা শুরু করল তার মা। মায়ের কথা মত বৌকে সন্দেহের চোঁখে দেখতে শুরু করল। বৌ নাকি পাশের বাড়ির সোহেলের সাথে হেসে হেসে কথা কয়! তাকে দেখলেই নাকি গলে পড়ে! এই সব কানে ঢুকত আর চুলের মুঠি ধরে কষে লাথি মারত সাধের বৌ এর পেটে! পাড়া প্রতিবেশিরা আগে মানা করতো, ঠেকাতে আসতো। তারপর তারাও বাদ দিয়েছিল।
দূরে দাড়িয়ে মজা দেখতো। সোহেলের মা-ই ঠেকাতে আসতেন বেশিরভাগ সময়ে। তবে ছেলের সাথে অপবাদ দিচ্ছে শুনে উনি ভুলেও আর এমুখো হতেন না। ছেলেকেও মানা করে দিয়েছিলেন এই বাড়ির সীমানায় পা না দিতে।
এভাবেই ওদিন একচোট মারের পরে ভাতের থালা বাইরে ছুড়ে দিয়ে গজ গজ করে বেরিয়েছিল তালেব।
প্রতিবেশিদের সামনেও চরমভাবে হেনস্তা করেছিল।
দিন গড়িয়ে সন্ধার প্রায় কাছাকাছি সময়ে সোহেল দেখলো তাদের বাড়ির পিছনের পেয়ারা গাছের পাশেই আচমকা দাউদাউ শিখা জ্বলে উঠলো! ভয়ে, আকস্মিকতায় চিত্কার দিয়ে উঠলো সে। দেখলো একটা মানুষ জ্বলন্ত শিখাময় শরীর নিয়ে মরণ চিত্কার করে দৌড়ে আসছে তাদের বাড়ির দিকে। চিত্কারে বাড়ির সবাই বেরিয়ে এল। সবাই হতবাক! বুঝলো রাবেয়াই আসছে এভাবে।
কিন্তু সে আসতে পারলোনা। লুটিয়ে পড়লো। পোড়ার যন্ত্রণায় বেঁকে যাচ্ছিল বলে মনে হল। দৌড়ে গেল সে ও তার মা। একটা ছেড়া কাঁথা চেপে ধরলেন গায়ে আর সে শার্ট খুলে ঝেড়ে নিভাতে লাগলো।
রাবেয়ার শাশুড়ি ও তার ছোট ছেলে, ছেলের বৌও এসেছিল। ধরাধরি করে নিয়ে গেল বাড়িতে। বাড়ির উঠোনে পাটিতে দলাপাকানো শরীরটা রেখে ছোট ছেলে ছুটলো ডাক্তার আনতে। সে ওই যে গেলতো গেলই। পালিয়ে গেল বুদ্ধি করে।
তালেবকেও ফোন করে অবস্থার কথা জানালো। এবং সেও আর বাড়ি মুখো হল না। ডাক্তার অবশেষে সোহেলেরই ডেকে আনতে হল। সারা পাড়া ভেঙে পড়লো পোড়া রাবেয়াকে দেখতে! এর মধ্যেই তার বাবা, মা, ভাই এবং বোনরা এসে গিয়েছিল পাশের গ্রাম থেকে। কান্নাকাটি, হৈ-হুল্লার মাঝে কোন এক সময়ে রাবেয়া পৃথিবী ছাড়ল।
কেউ টের পেলনা। ডাক্তার এসে দেখলেন মরে গেছে। এবং তখনি তার শাশুড়ি মড়া কান্না শুরু করে দিল ‘ আমার সোনার মানিক চলে গেল রে...ওরে কি লক্ষি ছিল রে....!’
রাবেয়ার মা অজ্ঞান হয়ে গেলেন মেয়ে হারানোর শোকে। বোনরা কাঁদতে লাগলো গলা ছেড়ে। আর তার বাবা শোকে পাথর হয়ে ছুটলেন থানায়।
যদিও তার মনে সন্দেহ ছিল কেস হওয়া না হওয়ার ব্যপারে। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে ময়নাতদন্ত না করে কেস যে নেবে না তা জানতেন। তারপরেও ছুটতে হল। পুলিশ এল। সবাইকে সরিয়ে লাশ নিয়ে গেল।
আটক করলো শুধু শাশুড়ি ও তার ছোট বেটার বৌকে। সোহেল ও তার পরিবারকে পোহাতে হল জিজ্ঞাসাবাদের চরম অসহনীয় পরিস্থিতি।
রাত গভীর হল। চোঁখের সামনে ভেসে উঠলো আগুনের লেলিহান শিখা। ভয়াল চিত্কার কানে টু-টু শব্দের মত গেঁথে রইল।
জ্বর এল শরীর কাঁপিয়ে। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকলো। তারপর সকালে উঠে দেখলো সব ঠান্ডা। গতকালও এমন সকাল ছিল। আজ শুধু ও বাড়ির চিত্কার-চেচামেচিটা নেই, রাবেয়া ভাবীর কান্না কানে আসছে না, পাড়া প্রতিবেশির উত্সুক দৃষ্টি নজরে আসছেনা।
আগুন ভাবীর নির্যাতিত শরীর, চিত্কার, কষ্ট, কান্নাকে চিরতরে পুড়িয়ে দিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে! এ আগুন কেরোসিনের ছিল না, ছিল যৌতুকের! ভালোবাসা মানুষে মানুষে ছিল না, ছিল টাকায়-পশুতে। কিন্তু তার চলে যাওয়া ভুলে যাওয়ার নয়, শিক্ষার। এমন করেই শত শত রাবেয়ারা পুড়ে যায়। তবু সমাজ শিক্ষা নেয় না। গোয়ার মস্তিষ্কে নারী মানেই ভোগ্য সামগ্রি! সে তার শরীর হোক বা তার দ্বারা পাওয়া সেবা, অর্থ অথবা অন্য কামণায়!
পেয়ারা গাছের কাছে গেল ধীরে ধীরে।
যেতে যেতে মনে হল এখনো বাতাসে পোড়া গন্ধ ভাসছে..! যেন যুগ যুগ ধরে তা থেকে যাবে...!
শাশ্বত ৩০.১০.১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।