আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে টেন্ডুলকার যা বললেন

গতকালই প্রায় ২০ মিনিটের লম্বা বিদায়ী বক্তৃতায় বলেছিলেন অনেক কিছুই। কিন্তু সাংবাদিকদের কাছে যে ছিল তাঁকে করারও আরও অনেক প্রশ্ন। আজ মুম্বাইয়ে তাই শেষবারের মতো বিদায়ী ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার এলেন সংবাদ সম্মেলনে। পরনে কিন্তু ছিল ভারতীয় দলের সেই ব্লেজার। এখনো ভারত দলটার অংশই যে ভাবছেন নিজেকে! প্রায় এক ঘণ্টার সেই সংবাদ সম্মেলনে টেন্ডুলকার যা বললেন:

অবসরের পর প্রথম সকাল: সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে খুব দ্রুত গোসল সেরে ম্যাচের জন্য প্রস্তুত হতে হয়নি।

স্ত্রীর সঙ্গে সকালটা উপভোগ করেছি। অনেকেই আমাকে শুভকামনা জানিয়েছিল। অনেকটা সময় নিয়ে তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। সকালটা কেটেছে খুব ঢিলেঢালাভাবে। আর তার পর আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।



মাকে নিয়ে: মা আমার ৭৪ রানের ইনিংসটা নিয়ে খুবই খুশি। তাঁর জন্য কোথাও যাওয়াটা খুব কঠিন। সেকারণেই আমি বিসিসিআইকে অনুরোধ করেছিলাম যেন শেষ টেস্টটা মুম্বাইয়েই আয়োজন করা হয়। তিনি এসেছিলেন, আমাকে কিছুক্ষণের জন্য খেলতে দেখেছিলেন। মুম্বাই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কাছে একটা আলাদা ঘর রাখতে বলেছিলাম।

কিন্তু তিনি সেটার প্রয়োজন মনে করেননি।


পরিবার নিয়ে: আমি যখন কোনো টুর্নামেন্ট শেষে বাড়ি ফিরতাম তখন আমার পারফরম্যান্স নিয়ে কোনো কথাই হতো না। এটাই আমার পরিবারের সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার। আমি সেঞ্চুরিই করি বা ১৫-২০, আমার বাবা-মা সবসময়ই আমাকে উত্সাহ দিয়ে গেছেন। কেউই আমার ভালো বা খারাপ পারফরম্যান্স নিয়ে অভিযোগ করেনি।

আরও অনেক ভারতীয় পরিবরের মতো আমরাও মিষ্টি কিনে এনেছি আর ঈশ্বরকে উত্সর্গ করেছি। আমার মা গতকালও এমনটা করেছেন।


ভবিষ্যতে তরুণদের পথ দেখাবেন কিনা: অবসরে যাওয়ার আগেও আমি ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের তরুণদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। তাদের সঙ্গে মিশতে আমার ভালো লাগে। এটা থেকে আমি অনেক কিছু শিখতেও পারি।

এখনও আমি সেটা করে যাব। নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের সাহায্য করতে পারলে আমার ভালোই লাগবে।


আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ প্রতিপক্ষ নিয়ে: ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বমানের খেলোয়াড় আছে। উত্থান-পতন তো সবারই থাকে। কোনো কোনো সময় কিছু জিনিস ঠিকমতো হয় না।

আমার মনে হয় এই সিরিজটাও তাদের জন্য এরকমই একটা সময় গেছে। কিন্তু তারা খুবই ভালো দল। তারা খেলাটা সঠিক চেতনা নিয়েই খেলে।


ক্রিকেট নিয়ে: ক্রিকেট মাঠের ২২ গজ আমার কাছে ছিল মন্দিরের মতো। আমি ক্রিকেটকে শুধু ধন্যবাদই বলতে চাই।

সেটাই আমি করেছিলাম গতকাল। আমি আমার জীবনে যা কিছু পেয়েছি সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছি ক্রিকেটকে।


ইনজুরি নিয়ে: ইনজুরিকে কখনোই সৌভাগ্য বলে ভাবিনি। ইনজুরিতে পড়ার পর আমাকে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। আমার ইনজুরিগুলোও সাধারণ ছিল না।

এই ধরনের ইনজুরি কাটিয়ে উঠে আবার মাঠে ফেরাটাও সহজ ছিল না। যদি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য তিন মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়, তাহলে শুধু জিমে গিয়ে অনুশীলন করলেই আড়াই মাসে মাঠে নামার জন্য তৈরি হওয়া যায় না। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য সময় দিতেই হবে। আমার যখন কনুইয়ের ইনজুরিটা হয়েছিল তখন চিকিত্সক আমাকে সাড়ে চার মাস বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। আমি তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি।

সময়কে সম্মান জানাতেই হবে। ইনজুরির সময় আমি অর্জুনের প্লাস্টিক ব্যাটও হাতে তুলতাম না।


বড় ভাই অজিত প্রসঙ্গে: আমি আমার শেষ বক্তৃতাতেও বলেছিলাম যে, আমরা দুজনে মিলে একটাই স্বপ্ন লালন করেছি। আমি ক্রিকেটে আমার দেশের পাশাপাশি অজিতেরও প্রতিনিধিত্ব করেছি। ও আমার জন্য যা করেছে সেটা কথায় প্রকাশ করা কঠিন।

গতকাল ও খুবই আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেটা আমাকে দেখায়নি। ও স্বস্তিও পেয়েছিল কারণ আমি যেভাবে অবসরে গেলাম এবং সবাই সেটাতে যেভাবে সাড়া দিল, তেমনটা পরিকল্পনা করে হয় না। এটা ঈশ্বরেরই নির্ধারণ করা ছিল। তিনি আমাকে এই দিনটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন যার পর আমি আর কোনো কিছুই চাইতে পারব না।

অজিতের অনুভূতিটাও এরকমই। আমরা খুব বেশি কথা বলিনি। কিন্তু সবকিছু ঠিকমতোই হওয়ার ফলে তাকে খুব ভারমুক্ত মনে হয়েছে।


ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্মরণীয় মুহূর্ত: প্রথমটা ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরি। আর পরে ২০০৮ সালে চেন্নাই টেস্টে।

সেখানে আমরা ৩৮৭ রান তাড়া করেছিলাম।


আগামী অ্যাশেজ প্রসঙ্গে: দুই দেশই এটা জেতার চেষ্টা করবে। ইংল্যান্ড আরও একবার প্রমাণ করতে চাইবে যে তারা অস্ট্রেলিয়াকে আবারও একটা কঠিন সময়ের মুখোমুখি ফেলতে পারে। এটা হবে খুবই উত্তেজনাকর একটা লড়াই।


ভারতের কোচ কেমন হওয়া উচিত: কোচ বিদেশি কিনা, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো কে কোচিং করাচ্ছে এবং দলকে ধারাবাহিক ভালো খেলার ক্ষেত্রে তারা কী করছেন।

আমার মতে তিনিই আমাদের দলের সঠিক কোচ হবেন, যিনি খেলোয়াড়দের ভালো মতো বুঝতে পারবেন। ক্রিকেটের এই পর্যায়ে এসে সবাই জানে কাভার ড্রাইভটা কীভাবে খেলতে হয়। সেটা শেখানোর জন্য কোচের দরকার পড়ে না। খেলোয়াড়ের সঙ্গে কোচের সম্পর্ক ভালো থাকলে খেলোয়াড় কোনো সমস্যায় পড়লে সে সেটা কোচের কাছে গিয়ে বলতে পারে। কোচের ওপর তার এই আস্থা থাকা দরকার যে কোচ সেটা ফাঁস করে দেবেন না অন্যের কাছে।

কোচের ওপর আস্থা থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।


দর্শকদের প্রতি: ক্রিকেট সব সময় আমার ভেতর থেকে শিশুর মতো প্রাণোচ্ছ্বাস বের করে এনেছে। সব ক্রিকেটপ্রেমীর মধ্যেই ক্রিকেটের প্রতি এই ভালোবাসাটা থাকা উচিত।


সমালোচনা ও পরামর্শ প্রসঙ্গে: আমার ক্যারিয়ারে যাঁরা শুরু থেকে আমাকে পথ দেখিয়েছে, তাঁরা সব সময় আমার কাছের মানুষ হয়ে ছিলেন। আমি সব সময় তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের পরামর্শ নিয়েছে।

আপনি জীবনে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যাবেন, যখন বুঝতে পারবেন কাদের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বুঝতে পারবেন কাদের সমালোচনা গঠনমূলক, কাদেরটা নয়।


উত্তরসুরীদের প্রসঙ্গে: আমি সবার সাফল্যই উপভোগ করি। ক্রিকেট একটা দলগত খেলা। এখানে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স গুরুত্বপূর্ণ নয়।

এখানে সব সময়ই হয়তো দুই-তিনটি অসাধারণ পারফরম্যান্স থাকবে, বাকিরা সেটার ওপর ভিত্তি করেই খেলবে। নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের প্রসঙ্গে বলব, নতুন যারা এসেছে তাদের সবার সঙ্গে খেলেই আমি উপভোগ করেছি। যখন খেলা শুরু করেছিলাম, ভূবনেশ্বরের তখন তো জন্মই হয়নি। আমি তাই কৌতুক করে ওদের বলতাম, ড্রেসিংরুমে আমি ঢোকার সময় ওদের বলা উচিত, ‘গুড মরনিং স্যার। ’


কোন মুহূর্তটি সবচেয়ে হতাশার: ২০০৩ বিশ্বকাপের কথাই বলব।

আমরা খুবই ভালো খেলে ফাইনাল পর্যন্ত উঠেছিলাম। কিন্তু শেষ বাধাটা আর টপকাতে পারিনি।


সেরা মুহূর্ত: দুই বছর আগে আমরা যখন বিশ্বকাপ জিতলাম। এর জন্য আমাকে ২২ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এটা তাই বিশেষ একটা মুহূর্ত ছিল।

গতকালও যখন সবাই আমাকে এভাবে ভালোবাসা দিচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে সাড়া দেব, আমি শুধু একটা বড় ধন্যবাদ দিতে চেয়েছি সবাইকে। এটাও বিশেষ একটা মুহূর্ত ছিল।


ছেলে অর্জুন সম্পর্কে: বাবা হিসেবে আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করব ওকে ওর মতো থাকতে দিন। ওর বাবা ক্রিকেটে যা করেছে, একই রকম কিছু ওর কাছ থেকে প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। আমার বাবা যেমন ছিলেন অধ্যাপক, কেউ তো তাকে বলেনি কেন আপনার ছেলে কলম হাতে তুলে নিল না।

অর্জুন ক্রিকেটটা পাগলের মতো ভালোবাসে। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ও কীভাবে খেলল, কতটা কী করতে পারল এসব নিয়ে আমি ওর ওপর কোনো চাপ তৈরি করতে দিতে চাই না। আশা করি আপনারাও তা করবেন না।


উইকেটকে শেষবারের মতো সালাম করা: আমি যখন উইকেটে গিয়ে দাঁড়ালাম, বুঝতে পারলাম এটাই ভারতীয় দলের অংশ হিসেবে ভরা স্টেডিয়ামে শেষবারের মতো উইকেটে দাঁড়ানো।

এটা আমাকে খুবই আবেগাক্রান্ত করেছিল। আমার হাতে আর ব্যাট থাকবে না, ভারতের হয়ে আর খেলব না! এর পর আমি ড্রেসিংরুমে ফিরে এসেছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অনেকের সঙ্গে হাত মেলানোর সময় মাথা তুলে তাকাতে পারছিলাম না। কারণ আমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম।

 



সোর্স: http://www.prothom-alo.com

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.