মা-বাবার একমাত্র সন্তান আদিল। বয়স ১৩ বছর। ইদানীং দেখছে মা-বাবা কী নিয়ে যেন কথা বলেন আর তাকে দেখেই চুপ হয়ে যান। বাসায় আত্মীয়স্বজন আসছেন, কেউ কেউ মায়ের জন্য নিয়ে আসছেন ফুল। মায়ের তো জন্মদিন নয়, ফুল কেন? দু-এক দিন পর তার এক খালার কথায় সে জানতে পারল, তার নতুন ভাই বা বোনের জন্ম হবে কয়েক মাসের মধ্যেই।
বিষয়টি আদিলের মনোজগতে নানা ধরনের চিন্তা ডেকে আনল। এক দিকে সে খুব খুশি, পুতুলের মতো ছোট্ট একটা শিশু তাদের পরিবারে আসবে; অপর দিকে ভয়, মা-বাবা হয়তো নতুন শিশুকে পেয়ে তাকে আর আগের মতো ভালোবাসবেন না। আবার বিব্রতও হলো কিছুটা। এই ১৩ বছর বয়সে সে সন্তান জন্ম নেওয়া বিষয়ে যতটুকু জেনেছে, তাতেই এই কুণ্ঠার জন্ম। মা-বাবার সামনে যেতেই যেন তার দ্বিধা।
আর স্কুলের বন্ধুদের কাছে বিষয়টি যেন কোনোমতেই জানাজানি না হয়, সেই চেষ্টা করতে লাগল।
কেবল আদিল নয়, তার বয়সী বা আরেকটু বেশি বয়সী কিশোর-কিশোরীরা যখন এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তখন তাদের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে আদিলের বয়সটি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। তার বয়স যদি আরেকটু কম হতো, যেমন সাত-আট, তখন প্রতিক্রিয়া হতো আরেক ধরনের। আবার আরও কম, যেমন তিন-চার, হলে প্রতিক্রিয়াও হতো ভিন্ন।
আমাদের সংস্কৃতিতে বয়ঃসন্ধিকালের শিশু-কিশোরদের কাছে মায়ের গর্ভধারণের সংবাদটি একাধারে আনন্দের, ঈর্ষার এবং বিব্রতকর। এ কারণে এমন মিশ্র আবেগের সমীকরণে সে খানিকটা টালমাটাল হয়ে পড়ে, চিন্তা ও আচরণে আসে পরিবর্তন, লেখাপড়াসহ দৈনন্দিন কাজগুলোয় সে আগের মতো মনোযোগ দিতে পারে না।
কেন এমন হয়
সন্তানের জন্ম ও নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিষয়ে ভাসা-ভাসা খণ্ডিত জ্ঞান ও প্রচলিত সামাজিক ‘ট্যাবু’র কারণে বেশির ভাগ শিশু-কিশোর তার মায়ের গর্ভধারণের ঘটনাটিকে লজ্জাকর বলে মনে করে। মায়ের শারীরিক পরিবর্তনগুলো কোনো কোনো সময় সহপাঠীদের সামনে তাকে বিব্রত করে। সমবয়সী বন্ধুমহলে নিজে বা তার মা-বাবা ‘হাসির পাত্র’ হতে পারেন বলে মনে করে সে বিষয়টি গোপন করতে চায়।
পরিবারে তার ভূমিকা পরিবর্তিত হয়। পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে মা-বাবা তাকে আগের মতো সময় দিতে পারেন না। বাবা হয়তো মায়ের যত্ন নিতে ব্যস্ত আর মা নিজে শারীরিক কারণে আগের মতো কর্মক্ষম নন। সে ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীরা কিছুটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং এ জন্য তার মা-বাবা ও অনাগত বোন বা ভাইটিকে দায়ী করে। তার মনে জন্ম নেয় কিছুটা অভিমান, কিছুটা ঈর্ষা আর কিছুটা বিরাগ।
অপর দিকে, তার রয়েছে শিশুসুলভ কোমল একটি মন। পুতুলের মতো ছোট্ট একটি ভাই বা বোনকে সে আদর করতে চায়, তাকে পাশে পেতে চায়। এই চাওয়া এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের অন্যদের হাসিখুশি মুখ তাকে আনন্দের অনুভূতি দেয়। এখনো জন্ম নেয়নি এমন শিশুটির প্রতি সে স্নেহ আর ভালোবাসাও অনুভব করে। অধীর আগ্রহ নিয়ে সে শিশুটির জন্মানোর অপেক্ষায় থাকে।
আবার কখনো মায়ের শারীরিক সমস্যা বেড়ে গেলে সে উৎকণ্ঠা ও বিষণ্নতা বোধ করতে পারে। সবকিছু মিলিয়ে সে খানিকটা বিহ্বল হয়ে পড়ে।
কী করণীয়
l সন্তান জন্মবিষয়ক প্রকৃত তথ্য ও জ্ঞান তাকে দেওয়া প্রয়োজন। তবে তা অবশ্যই হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক, যথার্থ এবং তার বয়সের উপযোগী। এই বিষয়ে কোনো মনগড়া কথা বা রূপকথা তাকে শোনানো যাবে না।
l তার কাছ থেকে বিষয়টি লুকোনো যাবে না, বরং এটি যে একটি স্বাভাবিক ঘটনা এবং মায়ের শারীরিক পরিবর্তনগুলোও যে স্বাভাবিক, তা বুঝিয়ে বলতে হবে।
l কোনো কিশোর-কিশোরী যদি জানতে পারে যে তাদের মা সন্তানসম্ভবা, তবে মায়ের সঙ্গে সহজভাবে মিশতে হবে, মাকে এড়িয়ে চলা যাবে না এবং বন্ধুদের কাছে এ নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ভাই বা বোনের জন্মের পর তা বন্ধুদের জানাতে হবে।
l তার যত্নের যেন কোনো ঘাটতি না, হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। মায়ের গর্ভধারণের কারণে তার স্কুল, লেখাপড়া ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে বাবাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নজর দিতে হবে।
l অনাগত শিশুটির প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে, তাকে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। যেমন শিশুটির জন্য তার রাখা নামটিকে গুরুত্ব দেওয়া।
l নতুন ভাই বা বোনের পরিচর্যায় যথাসম্ভব অংশ নিতে হবে, অবসরে তার সঙ্গে খেলতে হবে। পাশাপাশি নিজের প্রতি কোনো অবহেলা করা যাবে না, খানিকটা দায়িত্বশীল হয়ে অন্তত নিজের গোসল, খাওয়া স্কুল-কলেজের ব্যাগ গোছানো ইত্যাদি নিজে নিজে করার চেষ্টা করতে হবে।
l পরিবারের কোনো সদস্যদের আচরণ যেন কোনোভাবেই তাকে বিব্রত না করে এবং কেউ যেন তাকে নিয়ে প্রতিনিয়ত বিদ্রূপ না করে, (যেমন: এখন থেকে তোমাকে আর কেউ ভালোবাসবে না, সবাই তোমার ছোট বোন বা ভাইকে আদর করবে ইত্যাদি) সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
l এর পরও যদি বয়ঃসন্ধিকালের শিশুটির মধ্যে চিন্তা ও আচরণের অস্বাভাবিকতা বেশি দেখা যায় এবং ক্রমাগত তার লেখাপড়া খারাপ হতে থাকে, তবে প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।