বাংলাদেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, রাজপথে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা আর সন্ত্রাসবাদের উত্থানের আশঙ্কায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন মার্কিন কংগ্রেস।
গতকাল বৃহস্পতিবার মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্র-বিষয়ক উপকমিটির শুনানিতে কংগ্রেস সদস্যদের পাশাপাশি প্যানেল আলোচকেরা এসব বিষয়ে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
‘নৈরাজ্যে বাংলাদেশ: খাদের কিনারে একটি দেশ?’ শীর্ষক এ শুনানিতে সভাপতিত্ব করেন মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান স্টিভ শ্যাবোট।
সভাপতির সূচনা বক্তৃতার মধ্য দিয়ে শুনানি শুরু হয়। এরপর তিন কংগ্রেস সদস্য ব্র্যাড শারমেন, জেরার্ড কোলোনি ও টুলসি গ্যাবার্ড বক্তৃতা করেন।
তাঁদের পর পাঁচ মিনিট করে বক্তব্য দেন তিন প্যানেল আলোচক উইলসন সেন্টারের পাবলিক পলিসি স্কলার আলী রীয়াজ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনীরউজ্জামান ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক জন শিফটন। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব আর মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েসের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয় দেড় ঘণ্টার এ শুনানি।
ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন বিভিন্ন দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে এ ধরনের শুনানি হয়ে থাকে। অর্থাৎ কোনো দেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ আছে এমন তথ্য পেলে এ নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে শুনানির আয়োজন করা হয়। শুনানির আলোচনা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওই দেশের জন্য মার্কিন নীতি প্রণয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
গতকালের শুনানিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এড রয়েস। শুধু হিন্দু সম্প্রদায় নয়, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও নাস্তিক লোকজনের ওপর হামলায় তিনি উদ্বিগ্ন। এ পরিস্থিতিতে মাদ্রাসা শিক্ষা বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদে মদদ জোগাচ্ছে কি না, কিংবা এ সমস্যা কতটা প্রকট, তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। তিনি প্যানেল আলোচকদের কাছে জানতে চান, পাকিস্তানের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির কোনো সাযুজ্য আছে কি না। পাকিস্তানে এ সমস্যা অঙ্কুরে বিনষ্ট করা যায়নি, ফলে তা গভীর সংকট তৈরি করেছে বলে তিনি মনে করেন।
স্টিভ শ্যাবোট মন্তব্য করেন, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসার প্রাক্কালে রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর সফরের সময় বিরোধী দল বিএনপির ডাকে হরতাল চলছিল। আর তাতে সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। সহিংসতা বন্ধের জন্য দুই নেত্রীকে অনুরোধ জানানোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সহিংসতা বন্ধ না হলে তা অস্থিতিশীলতাকে উসকে দেবে।
শ্যাবোট বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম, গ্রামীণ ব্যাংক ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে হেনস্তার জন্য এ ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে বলে তাঁর কাছে অভিযোগ করা হয়েছে।
প্যানেল আলোচনার শুরুতে বক্তব্য দেন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের পাবলিক পলিসি স্কলার আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তিন ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথমত, সব দলকে নিয়ে একটি রুটিনমাফিক নির্বাচন করা। তবে দুই দলের অনড় অবস্থানের কারণে এ ধরনের নির্বাচনের সুযোগ কম।
এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্য থেকে বিরোধী দলের দাবি মেনে নিয়ে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন। এবারকার পরিস্থিতি ’৮৮ ও ’৯৬-এর চেয়ে আলাদা হওয়ায় এর ফলাফলটা হবে আলাদা। তাই একতরফা নির্বাচন ‘কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পায় না’ বলে বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়েই নির্বাচনের ব্যবস্থা করা উচিত বলে মত দেন তিনি।
তৃতীয় সম্ভাবনা হতে পারে নির্বাচনটা পিছিয়ে দেওয়া।
শেষ সম্ভাবনায় আপাতত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে মনে হলেও তা শেষ পর্যন্ত প্রধান দুই দলের বৈরিতা কমানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে বলে তাঁর মত।
আলী রীয়াজ মনে করেন, দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট দূর করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নির্বাচনের পর সংযত আচরণের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্ট করে বিবৃতি দিতে হবে, যাতে করে সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যেন নির্যাতনের শিকার না হয়। ধর্মীয় মৌলবাদ মোকাবিলায় সব দলকে একসঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা। ভারতের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ দূর করা।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা, যাতে করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রতিবেশী বা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি তৈরি না করে।
এ এন এম মুনীরউজ্জামান বলেন, বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই সরকার নির্বাচন করতে যাচ্ছে। যা দেশকে সংঘাত ও কঠিন সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। তাই দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে, একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণ সম্ভব।
মুনীরউজ্জামান বলেন, বর্তমানে বিরোধী দলের প্রতি সরকারের যে সহনশীলতার অভাব এবং রাজনৈতিক সংঘাত চলছে, তা অব্যাহত থাকলে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।
আর এ পরিস্থিতি জঙ্গিবাদের উত্থানে মদদ জোগাবে। চূড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
জেনারেল মুনীরউজ্জামান বলেন, ‘আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সহিংসতা অব্যাহত থাকলে সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা আছে কি না? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই। ২০০৭ সালের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের কোনো ইচ্ছে নেই। তবে সহিংসতা অব্যাহত থাকলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনো একপর্যায়ে তাদের ভূমিকা নিতে দেখা যেতে পারে।
আমাদের বোধ হয় এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করাটা সমীচীন হবে না। ’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক জন শিফটন বাংলাদেশকে এখনই জিএসপি সুবিধা না দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি দাবি করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ‘ন্যায়নিষ্ঠভাবে’ হচ্ছে না। বাংলাদেশে মানবাধিকার বিপন্ন। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সমুন্নত রাখতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে আলী রীয়াজ বলেন, একাত্তরে যারা ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হতেই হবে। তা না হলে বাংলাদেশে আইনের শাসনের প্রত্যাশা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে। বিচারব্যবস্থায় ঘাটতি বা কোনো ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করা যেতে পারে। তবে ওই বিচার বন্ধ করা যাবে না। এটি বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের দাবি।
একাত্তরে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের স্বজনেরা বিচার দেখে যেতে চান।
প্রশ্নোত্তর পর্বে জেরার্ড কোলোনি, টুলসি গ্যাবার্ড, ডাগ কলিন্স ও গ্রেস ম্যাংয়ের পাশাপাশি স্টিভ শ্যাবোট নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় কারা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবেন, জঙ্গিবাদের উত্থানের কারণ ও শ্রমমানের বিষয়ে জানতে চান।
এইচ টি ইমামের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে অনুষ্ঠিত শুনানি বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রশাসন-বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। গতকাল বিবিসিকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘এ ধরনের শুনানি আমাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। হয়তো কোনো একটি বিশেষ লবিং গ্রুপ এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
’ তিনি বলেন, মার্কিন কংগ্রেসে এসব কথা আসা উচিত নয়।
ওই শুনানির আয়োজন নিয়ে এইচ টি ইমাম আরও বলেন, ‘আয়োজনে এমন সব লোকজনকে ডাকা হয়েছে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। এমন লোকজনও সেখানে গেছে। ’ বর্তমান পরিস্থিতির জন্য শেখ হাসিনা দায়ী কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘শেখ হাসিনার ওপর দায়ভার বা অভিযোগ করার বিষয়টি যেকোনো বিবেকবান মানুষই বলবেন, সম্পূর্ণ মিথ্যা। সবারই জানা, আমেরিকায় লবিং গ্রুপ কীভাবে কাজ করে।
সারা বিশ্বেই তাদের প্রচুর রিসোর্স আছে, পয়সা আছে। বিশেষ করে, জামায়াত লবিং প্রচণ্ড শক্তিশালী। তারা পয়সা দিয়ে বড় বড় লবি নিয়োগ করে। ’
এ শুনানির ফলে বাংলাদেশে কেমন প্রভাব পড়বে—এমন এক প্রশ্নের জবাবে এইচ টি ইমাম বলেন, প্রভাব পড়বে না। কারণ, মার্কিন কংগ্রেসে এমন বহু বিষয়েই শুনানি হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।