বাংলাদেশে আশাবাদী লোকের সংখ্যা প্রচুর। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে আলোচনা শুরু করতে বলেছেন। তাঁর এই দেড় মিনিটের মামুলি আহ্বানের পর আমার কাছে বিস্ফোরিত কণ্ঠে ফোন আসে কয়েকটি টিভি চ্যানেল থেকে। তাদের ধারণা, বিরাট এক ঘটনা ঘটে গেছে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের কারণে। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে এই আশাবাদ ব্যক্ত করে কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন যে এমন একটা মাহেন্দ্রক্ষণে কিছু একটা অবশ্যই বলা উচিত।
আমি নিজেকে বাস্তববাদী মানুষ মনে করি। অহেতুক আশাবাদের উচ্ছ্বাস এবং আশাবাদী মানুষের ইমেজ গড়ার ইচ্ছা নেই। আমার বরং ধারণা, এই আহ্বান অনেকাংশে আনুষ্ঠানিকতা এমনকি লোক দেখানো হতে পারে। কয়েক দিন আগে বিএনপির নেতা যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন, তা-ও ছিল অনুরূপ কিছু। আশাবাদী মানুষ নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন না।
এঁদের অনেকে আগে খালেদা জিয়ার কাছে প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোনের পর শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রায় হয়ে গেছে ধরে নিয়েছিলেন। আমার ধারণা, তাঁদের আশাবাদও ভুল প্রমাণিত হতে চলেছে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সবার অংশগ্রহণমূলক হওয়ার সম্ভাবনা কম, শান্তিপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা আরও কম।
বাংলাদেশে আসলে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ইতিহাস নেই। বর্তমান বাস্তবতায় এর সম্ভাবনা আরও নেই।
নেই যে তার প্রধান কারণ, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দলীয়করণ— সর্বোপরি নানা ধরনের দুঃশাসনের তাণ্ডব। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকার কর্তৃক দুঃশাসন ও বিরোধী দলের প্রতি নির্যাতন এমন মাত্রায় পৌঁছেছিল যে ক্ষমতা হারালে নানা ধরনের হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা তাদের ছিল। ছিল ক্ষমতা যেকোনো মূল্যে ধরে রাখার লোভও। বর্তমান সরকারের আমলে একই ঘটনা ঘটছে। এই আমলে কিছু ক্ষেত্রে বরং বিরোধী দলের প্রতি নির্যাতন ও দমননীতি আরও বেড়েছে।
ফলে গত বিএনপি সরকারের মতো এবারের আওয়ামী লীগ সরকারও ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি নিতে চাইবে না, এটিই স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক কালের স্থানীয় নির্বাচনগুলোর ফলাফল ও জনমত জরিপগুলোয় এটি স্পষ্ট যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বড় ধরনের পরাজয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এই পরাজয় এড়ানোর সহজ রাস্তা হচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। আর বিএনপি নির্বাচনে এলে তাতে কারচুপির সুযোগ সৃষ্টি করে রাখা। আওয়ামী লীগ সরকার সে পথেই এগোচ্ছে বলে মনে হয়।
আওয়ামী লীগের দৃশ্যমান প্রথম টার্গেট বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। এটি করা গেলে কারচুপি না করেই আগামী নির্বাচনে নিশ্চিতভাবে জিতে আসবে আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য প্রথমে অত্যন্ত বিতর্কিতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সামর্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার লক্ষ্যে বিরোধী দলের প্রতি অপপ্রচার, দমননীতি ও নির্যাতন চালানো হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় নির্বাচন-পূর্ব ৯০ দিন সময়েও আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন অনৈতিক ও অন্যায় পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে। মেরুদণ্ডহীন ও জি হুজুর ধরনের নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে বিএনএফ নামের একটি ভুঁইফোড় সংগঠনকে বিএনপির যৌক্তিক আপত্তি সত্ত্বেও নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে, আরপিও একতরফাভাবে সংশোধন করে বিএনপির যেসব নেতা সুবিধাবাদী হতে চাইবেন, তাঁদের যেকোনো দল থেকে নির্বাচন করার পথ উন্মুক্ত করা হয়েছে, জাতীয় পার্টিকে দৃষ্টিকটুভাবে মন্ত্রিত্ব এবং সম্ভবত আরও বিভিন্ন ধরনের উৎকোচ প্রদান করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা হয়েছে, বিএনপির জোটসঙ্গীদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে বিএনপিবিহীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসার তৎপরতা চালানো হচ্ছে এবং তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতাকে আরও বলীয়ান করা হয়েছে।
গত ২৭ অক্টোবর থেকে নির্বাচন-পূর্ব ৯০ দিন সময়ে সরকারের সবচেয়ে সাম্যমূলক ও গণতান্ত্রিক আচরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ এই সময়ে বিএনপির প্রতি দমননীতি ও বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ আরও তীব্রতর করা হয়েছে। যেমন হাস্যকর মামলায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ পাঁচজন নেতাকে নজিরবিহীনভাবে পুলিশি রিমান্ডে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের সবচেয়ে সক্রিয় নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে মাঝারি স্তরের নেতা ও সক্রিয় কর্মীদের কারাদণ্ড দেওয়া হচ্ছে এবং নির্বাচনকালীন ৯০ দিন সময়ে বিএনপির সভাসমাবেশের ওপর পুলিশি নিয়ন্ত্রণ আরোপের পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে অবাধে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হচ্ছে। এই ৯০ দিন সময়ে সরকারি ক্ষমতা ও সরকারি প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে অবাধে চলছে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রচারণা। সরাসরিভাবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার শামিল এসব কর্মকাণ্ডকে ব্যাপকতর সমালোচনা থেকে রক্ষা করার জন্য নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা থেকে এখন পর্যন্ত বিরত রয়েছে।
বিএনপিকে এখন নির্বাচন করতে হলে তা করতে হবে অত্যন্ত অসমতল ভূমি থেকে। নির্বাচনে অংশ নিতে হবে গত পাঁচ বছরে চরম দলীয়করণের মাধ্যমে সৃষ্ট জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রশাসনকে মেনে নিয়ে। সংবিধান, রুলস অব বিজনেস ও বর্তমান ‘সর্বদলীয়’ (যা প্রকৃত অর্থে এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে মহাজোটীয়) সরকারকাঠামো দেখলে এটি স্পষ্ট যে এই সরকারে বিএনপি যোগ দিলেও এসব প্রশাসন পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতা তাদের থাকবে না। এই ক্ষমতা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় অন্য কোনো দলের মন্ত্রীর যে একেবারে নেই, তা মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোয় অত্যন্ত স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছেন। এসব মেনে এবং শেখ হাসিনার মনমতো গঠিত সরকারে যোগ দিয়ে নির্বাচন করলে মাঠ-রাজনীতির মনোবলও নাটকীয়ভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে চলে যাবে।
এসব পরিস্থিতি আর যা-ই হোক, নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়ার পথ সুগম করার ইচ্ছা থেকে সৃষ্টি করা হয়নি। বিএনপির জন্য ‘অবভিয়াস চয়েস’ করে রাখা হয়েছে নির্বাচন বর্জন। এই রাজনীতিকে পরাভূত করে বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নাটকীয় সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাদের তা করতে হবে কারচুপির ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নির্বাচনী সরকারকে মেনে নিয়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে সরকার ও প্রশাসনের কারচুপি করার ইচ্ছা থাক আর না থাক, কারচুপি করার ক্ষমতা যে রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আর কারচুপি ও বৈষম্য করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নির্বাচনী সরকারকাঠামো সৃষ্টি করা হয়েছে কারচুপি না করার সদিচ্ছা থেকে, এটি বিশ্বাস করার লোক বাংলাদেশে বা বহির্বিশ্বে খুব বেশি নেই বলে আমার ধারণা।
নির্বাচনকালীন একটি মোটামুটি ধরনের নিরপেক্ষ সরকার ও প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিএনপির জন্য একমাত্র পথ হচ্ছে, এটি করতে আওয়ামী লীগ সরকারকে বাধ্য করা। ২০০৬-০৭ সালে রাজপথের তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। তেমন আন্দোলন গড়ে তোলার মতো বিপুল জনসমর্থন বিএনপির হয়তো রয়েছে, কিন্তু বিশেষ করে ঢাকায় বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মহানগর বিএনপি এখন পর্যন্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এই ব্যর্থতা দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে না পারলে এবং ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ্য না দেখাতে পারলে বিএনপিকে বৈরী, বৈষম্যমূলক ও একপেশে ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নির্বাচনকালীন সরকারকে মেনে নিতে হবে। এমন একটি সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপি তাতে অংশ নিলেও, আওয়ামী লীগ জিতে আসতে পারে।
আমার ধারণা, এমন একটি নির্বাচনী অঙ্ক আওয়ামী লীগের রয়েছে। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কর্তৃত্বাধীন সরকারের যা উদ্যোগ আয়োজন, তাতে নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে বিতর্কমুক্ত রাখার তেমন কোনো অর্থবহ প্রচেষ্টা তাই লক্ষ করা যায়নি। এমন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে আবার একটি আওয়ামী লীগ সরকারকে ভবিষ্যতে আমরা নির্বাচিত হতে দেখতে পারি। তবে সে সরকার হবে জনসমর্থনের দিক দিয়ে এবং নৈতিকভাবে ২০০৮ সালের সরকারের চেয়ে অনেক দুর্বল। সেই ভবিষ্যৎ সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে আরও অনেক বেশি দমনমূলক ও স্বৈরাচারী পদক্ষেপ নিতে হবে।
একপেশে ও বহুলাংশে বিতর্কিত একটি নির্বাচনী সরকারের মাধ্যমে আবারও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাই তারা বিজয়ী হবে সাময়িকভাবে। কিন্তু তাতে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।