একটা সময় ছিল রূপকথার। ছিল স্বর্ণযুগের। ছিল দারুণ সব উত্তেজনাকর মুহূর্ত। সময় এগিয়ে চলে কিন্তু স্মৃতি রয়ে যায় মনের গহিনে। আধুনিক যুগের ফুটবলে যে আক্রমণাত্মক খেলা আমরা উপভোগ করি, আমাদের শিরায় শিরায় শিহরণ খেলে যায়; কারা নির্মাণ করেছিলেন সেই ফুটবল? এই যে আজকের যুগের মেসি কিংবা রোনালদোর এত শৈল্পিক ফুটবল, সেটার উত্স কোথায়?
এর সূচনার অন্যতম কৃতিত্ব একজন মানুষের।
যাঁর সৌজন্যে ১৯৫৪ বিশ্বকাপে অন্য রকম এক ফুটবল দেখেছিল পৃথিবীবাসী। তাঁর নাম ফেরেঙ্ক পুসকাস। যাঁকে ডাকা হতো ‘দ্য গ্যালোপিং মেজর’ নামে। হাঙ্গেরির ফুটবলের শুরু এবং শেষ পুরোটাই পুসকাসময়। এর আগে কিছু যেন নেই, নেই পরেও।
পুসকাসের সময়ই হাঙ্গেরি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়। জেতে মধ্য ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাও। কিন্তু ১৯৫৪ বিশ্বকাপে কেন চ্যাম্পিয়ন হতে পারল না, সেটি আজও ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’ হয়ে আছে ফুটবলের ইতিহাসে!
বিশ্বকাপ আর জেতাই হয়নি পুসকাসের। কিন্তু তাই বলে ফুটবল কিংবদন্তির আসনে তাঁকে বসাতে দ্বিধা নেই কারও। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে ষাটের দশকে তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ জেতা পুসকাসের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী গেল মাত্র কদিন আগে।
পুসকাসের জন্ম ১৯২৭ সালে বুদাপেস্টে। ১৬ বছর বয়সে স্থানীয় দল বুদাপেস্ট হনভেডের হয়ে ক্লাব ফুটবলে অভিষেক। ক্লাবটি আসলে আগে অন্য নামে পরিচিত ছিল। হাঙ্গেরির সেনাবাহিনী দলটির দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই নামটি পরিবর্তিত হয়। তারপর দলের সবাইকে সেনাবাহিনীর র্যাংক দেওয়া হয়।
পুসকাস একসময় ‘মেজর’ হয়ে যান। তারপর থেকেই তাঁর নাম হয়ে যায় ‘গ্যালোপিং মেজর’।
বুদাপেস্ট হনভেডের হয়ে ৩৪১ ম্যাচে ৩৫২ গোল! খোদ এ সময়ের লিওনেল মেসি আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে ঈর্ষায় ফেলে দেওয়ার মতো রেকর্ড! এর থেকেই বোঝা যায় কতটা ভয়ংকর গোল-স্কোরার ছিলেন। এরপর এল ১৯৪৫ সাল। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে অভিষেক।
সেই সময় হাঙ্গেরির অপ্রতিরোধ্য জাতীয় দলটি পরিচিত হয় ‘মাইটি ম্যাগিয়ার্স’ নামে।
পুসকাসের নেতৃত্বে হাঙ্গেরি জাতীয় দলে যুক্ত হয় সান্দোর ককসিস, জলতান চিবর, নান্দোর হিদেকুতি ও ইউজেফ বজিকের মতো অসাধারণ প্রতিভাবান সব খেলোয়াড় । সেই সময়ের দলটি ‘গোল্ডেন টিম’ নামের পরিচিত ছিল। আর পুসকাস ছিলেন সেই দলের নিউক্লিয়াস। এ সময় হাঙ্গেরি টানা ৩২টি ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ডও গড়েছিল।
জাতীয় দলের হয়ে পুসকাস ৮৫ ম্যাচে করেছেন ৮৪ গোল।
১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ ছিল পুসকাসের ও হাঙ্গেরি দলের জন্য রূপকথার গল্পের মতো। বাঘা বাঘা সব দলকে হারিয়ে তারা ফাইনালে পৌঁছে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল পশ্চিম জার্মানিকে গ্রুপ পর্বে ৮-৩ গোলে হারানো। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই পশ্চিম জার্মানির কাছেই ফাইনালে ৩-২ গোলে হেরে যায় তারা।
অথচ ম্যাচের আট মিনিটেই পুসকাস ও চিবরের গোলে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছিল হাঙ্গেরি। সেই ম্যাচটি আজও ফুটবল ইতিহাসে ‘মিরাকল অব বার্ন’ নামে পরিচিত।
এরপরের ঘটনা শুধুই দুঃখের। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন হাঙ্গেরিতে হামলা চালালে অনেক মানুষ দেশ ছাড়া হয়। ভেঙে যায় হাঙ্গেরির সেই স্বপ্নের দলও।
পুসকাসের নতুন ঠিকানা হয় স্পেন। রিয়ালে নাম লেখান পুসকাস। এই ক্লাবে থেকেই খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টেনেছিলেন। রিয়ালের হয়েও গোল-বন্যা অব্যাহত ছিল তাঁর। ১৮০ ম্যাচে করেছেন ১৫৬ গোল।
খেলোয়াড় পুসকাসকে নিয়ে নাক উঁচু ব্রিটিশরা অবশ্য সমালোচনা করত। শারীরিকভাবে একটু মোটাসোটা ছিলেন বলে। ব্রিটিশরা তাঁকে বলত ‘লিটল ফ্যাট চ্যাপ’। কিন্তু তিনি সব সমালোচনার জবাব দিয়েছিলেন তার বাঁ পা দিয়ে। বলা হতো পুসকাসের বাঁ পা যেন ছিল সোনায় মোড়ানো।
পুসকাসের জীবনের শেষ গল্পটা সেলুলয়েডের মতো। ২০০০ সালে এই মহান ফুটবলারের আলঝেইমার ধরা পড়ে। ছয় বছর অশেষ কষ্ট ভোগ করে ২০০৬ সালের ১৭ নভেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান এই মর্ত্যে পা রাখা সর্বকালের অন্যতম সেরা এক ফুটবল প্রতিভা।
এই প্রজন্মের কিশোরেরা হয়তো পুসকাসকে মনে রাখেনি। কালের আবর্তে তাঁর কীর্তির ওপর বিস্মৃতির ধুলো জমেছে।
কিন্তু পুসকাস না জন্মালে ফুটবলটাই হয়তো হয়ে যেত অন্য রকম! তিনি তাঁর ফুটবল কীর্তিতেই বেঁচে থাকবেন চিরকাল। কিছু কিছু মানুষের যে মৃত্যু নেই!
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।