রাজনীতির মাঠ যত উত্তপ্ত হচ্ছে, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ততই ককটেল বোমার ব্যবহার বাড়ছে। চোরাগোপ্তা হামলা থেকে শুরু করে প্রকাশ্য মিছিল-মিটিং আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এ ভয়ঙ্কর ককটেল বোমা। বোমার আঘাতে কাউকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে, আবার আহত অনেকেই অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বিছানায়। কাউকে আবার জীবনের তরে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। যেখানে-সেখানে পড়ে থাকা ককটেলকে বল ভেবে খেলতে গিয়ে বিস্ফোরণে মারাত্দক আহত হচ্ছে শিশুরা।
এসব শিশুদের কারও হাত, আবার কারও আঙ্গুল উড়ে গেছে। ভয়ঙ্কর এ বোমায় এখন আতঙ্ক সর্বত্র। পরিস্থিতি এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, বোমার কারণে সাধারণ মানুষ এখন ঘর থেকে বেরোতে ভয় পাচ্ছেন। কখন কার ওপর বোমা এসে পড়বে- এমন আশঙ্কা নিয়েই চলাফেরা করছে মানুষ।
পুলিশ ও গোয়েন্দাদের মধ্যেও এ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
তাদের আশঙ্কা, সামনের দিনগুলোয় বোমার ব্যবহার আরও বাড়বে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোয় আক্রমণের ধরনে যে পরিবর্তন হচ্ছে বোমার ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ। উল্লেখ্য, গত দুই দিনের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে শুধু রাজধানীতেই একজন নিহত এবং আহত হয়েছেন ৪০ জন। এদের প্রত্যেকেই সাধারণ মানুষ। রাজনীতির সঙ্গে এদের কারও সম্পৃক্ততা নেই।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, গত বছরও বিক্ষোভ, হরতাল, অবরোধ ও সমাবেশে বোমার ব্যবহার তেমন ছিল না। তখন ইটপাটকেল-লাঠির ব্যবহার ছিল বেশি। চলতি বছরের শুরু থেকেই পুলিশের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা, ১৮ দলের বিক্ষোভ, হরতাল-অবরোধে ব্যাপকহারে হাতবোমার ব্যবহার করা হয়। বোমা হামলায় মানুষের যেমন ক্ষতি করা গেছে, আতঙ্ক ছড়িয়েছে সর্বত্র। এ কারণে বোমার ব্যবহার বেড়ে যায়।
সূত্র জানায়, গত ২০১২ সালে বিরোধী দলের হরতালের সময় একশর মতো ককটেল আটক করে ডিবি। সেখানে এ বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ১৮ দিনে ২৬টি অভিযানে ৬৬০টি ককটেল ও পাঁচটি সার্কিট বোমা আটক করা হয়েছে। এর সঙ্গে সোয়া চার কেজি বোমা তৈরির উপকরণও আটক করা হয়। এসব উপকরণ দিয়ে এক হাজার ককটেল তৈরি করা যায়। ডিবির হিসাব অনুযায়ী, গত ২৬ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচশর মতো ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থা গত ৪ বছরের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি বিশ্লেষণ করে দেখেছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে হঠাৎ করেই হরতাল-অবরোধ, বিক্ষোভ কর্মসূচিতে বোমার ব্যবহার বেড়ে যায়। ওই দুই মাসে সারা দেশে অন্তত ২ হাজার হাতবোমা ব্যবহার করা হয়েছে। এতে পুলিশসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। বেশির ভাগ ঘটনা জামায়াত-শিবির কর্মীরা ঘটিয়েছে বলেও ওই গোয়েন্দা সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, সালফার, পটাশিয়াম ক্লোরেট, আর্সেনিক ডাই-সালফাইড, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, ফসফরাস, অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের মতো কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে ককটেল ও বোমা।
বোমা বিধ্বংসী করতে তাতে দেওয়া হচ্ছে কাঁটাতারের চোরকাঁটা, সাইকেলের বিয়ারিং বল, ছোট পেরেক। ককটেল ফাটলে এগুলো ছড়িয়ে গিয়ে লোকজনকে আহত করে। তবে এসব কেমিক্যাল আনা হচ্ছে বিদেশ থেকে। দিয়াশলাই, সার, সিমেন্ট, ওষুধ, রড, কসমেটিকস, চামড়া শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে বিদেশ থেকে আনা হচ্ছে এসব কাঁচামাল। দেশে আতশবাজি ও পটকা তৈরির লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন নিষিদ্ধ করে বন্ধ করা গেলেও সন্ত্রাসীদের ককটেল-বোমা তৈরি বন্ধ করা যায়নি।
সূত্র জানায়, অনেক শিল্প কারখানা বা ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তাদের লাইসেন্সের মাধ্যমে এ ধরনের কাঁচামাল আমদানি করে তা খোলাবাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। খোলাবাজারে ছেড়ে দেওয়া এসব কাঁচামাল দিয়ে ককটেল-বোমা তৈরি হচ্ছে। আর জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের অনেকেই উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিশালী ককটেল-বোমা তৈরি করছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বিগত বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে ককটেল- গ্রেনেড-বোমা ব্যবহার শুরু করে জঙ্গিরা। জঙ্গি দমন করা হলে এসব বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
তবে হরতালের মতো নৈরাজ্যকর ও ধ্বংসাত্দক কর্মসূচিতে অতীতের মতো আবারও ককটেল বোমার ব্যবহার শুরু হয়। এসব বিস্ফোরক দ্রব্যের মাধ্যমে মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। কিন্তু বিস্ফোরক দ্রব্যের উৎসের ব্যাপারে তেমন কোনো তদন্ত হয় না। এমনকি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হলেও কারও শাস্তি হয়েছে এমন নজির দেখাতে পারেনি ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা। সূত্র জানায়, পুলিশি হয়রানি ও নজর এড়াতে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ককটেল তৈরির কারখানা এখন খোদ রাজধানীতেই গড়ে উঠেছে।
আবাসিক এলাকা কিন্তু সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ও সন্দেহের বাইরে, এমন ফ্ল্যাট ও বাড়ি ককটেল তৈরির উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয়ে থাকে। তবে জামায়াতের সব মেসই এখন বোমার কারখানায় রূপ নিয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রমতে, প্রযুক্তির কল্যাণে এখন ককটেল ও বোমা সহজেই ঘরে বসে তৈরি করা যায়। উত্তপ্ত রাজপথ ধরে যেহেতু ককটেল এখন অপরিহার্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে, তাই কেউ নিজেরা এগুলো তৈরি করছেন, কেউ বা তৈরি করে বিক্রি করছেন নগদ অর্থের বিনিময়ে। বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর ওয়েবসাইট থেকে বোমা তৈরির কলাকৌশল রপ্ত করছে বোমা-কারিগররা বলে মনে করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
৫ শতাধিক বোমা কারিগরের নাম গোয়েন্দাদের তালিকায় রয়েছে। যাদের পুলিশ এখন খুঁজছে বলে জানান ডিবির বোমা উদ্ধার ও নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রধান অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।