এইখানটাতেই কারো আসার কথা! আমি খুব সুন্দর করে চিনিয়ে দিয়েছি সমান্তরাল রেল লাইন, দুটো কৃষ্ণচূড়া গাছ নিবিড় করে পরস্পরে জড়িয়ে ধরে আছে, দুটো ডাল পরস্পরের বাহু এভাবে ধরেছে দেখে যে ভালোবাসা আকৃতির একটা অবয়ব হয়ে গেছে, ওখান দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের রেললাইন ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলো রেললাইনের পাশের দিঘিটাতে পড়ে চোখে ঝিলিক দেয়!পুরোটা দীঘি জুড়ে অসংখ্য লাল লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল জলের উপর বিছিয়ে থাকে। এ জায়গাটা একবার দেখলে ভুলে যাওয়ার উপায় নেই। সব কিছু খুঁটিনাটি বলে দিয়েছি কিন্তু এখনও মানুষটার খোঁজ নেই!
সমস্যা বেঁধেছে এইখানটা আর সেইখানটা নেই! চারদিকটাতে ভালো করে তাকালাম। এবার সত্যি সত্যি সন্দেহ হতে লাগলো ও এই জায়গাটা চিনবে তো! কে বা কারা রেললাইন উপড়ে ফেলেছে, কৃষ্ণচূড়া গাছ দুটি কেটে রেললাইনের উপর ফেলে রেখে পথরোধ করেছে! সেই ডাল দুটির জড়াজড়ি হাতের ভালোবাসা আকৃতিটাকে পড়ে থাকতে দেখা গেল দীঘির জলে। যেভাবেই গাছদুটিকে কাটা হয়েছে তাদের বিচ্ছিন্ন করা যায় নি।
কিন্তু তাদের ফাঁক দিয়ে আর পড়ন্ত সূর্যের হাসির ঝিলিক চোখে পড়ছে না, বরং দীঘির জল উপড়ে উপচে ভালবাসাটাকে পূর্ণ করে রেখেছে । আবার হঠাত করে মনে হতে লাগলো, কে জানে এদের জল নয়তো? আচ্ছা , ভালোবাসা কি কাঁদে?
**** **** ****
তানি বুকের উপর থেকে বইটা সরিয়ে চোখ মেলল , বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে! কখন ঘুমিয়ে পড়ল! আর কখন ই বা সন্ধ্যা হল!! এই সব শীতের দিনে দিন বলতে আসলে কিছু নেই! সূর্য একবার হেলে পড়লে মনে হয় কেউ তাকে টান মেরে নিচে নামিয়ে ফেলে! টিভি অন করে রিমোট টিপে একবার ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত গেল, আবার উল্টো দিকে ১ পর্যন্ত নামল! কিছুই দেখার দেখার নেই! মাঝখানে দুই মিনিট থেমে একটু খবর দেখল। নতুন কিছু নেই, সেই একই জ্বালাও পড়াও, একই ভাংচুর, হানাহানি, গা সওয়া!! অমুক নেত্রী এটা বলেছেন তো তার প্রতিউত্তরে অমুকজন সেটা বলেছেন! বিরক্ত তো হয়ে টিভি বন্ধ করে দিল! এভাবে শীতের ছোট দিনে আর চলছে না , দেশটাতে এখন অনেক বেশি দিনের আলো দরকার!
তানি বারান্দা দিয়ে পাশের রুমে এসে পশ্চিম দিকের জানালা খুলে দিল। এখানটা থেকে বেশ ভালো আকাশ দেখা যায়। কিন্তু এই জানালা বেশিরভাগ সময় ই বন্ধ থাকে।
কারন জানালার নিচেই বস্তি । বস্তি না বলে ব্রথেল বলাই ভালো! বস্তির মানুষগুলো সবসময় কেন জানি ঝগড়া ফ্যাসাদ করে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ । তাই এদিকের জানালা খোলা বাপির বারন । আজকেও জানলা খোলার সাথেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ কানে এল! কোন ব্যাতিক্রম নেই! দুইজন মহিলার মাঝে ঝগড়া লেগেছে।
যা তা বলছে । একজন বলে উঠলো তোর নাগর............ তো আরেকজন আরেক কাঠি আগে বেড়ে তোর ভা......!! তানির হঠাত কেন জানি মনে হল একটু আগে টিভিতে তো এইসব ই দেখতেছিল! এখানের পরিবেশটা বরং আরও সভ্য!! টিভি খুললে তার ঘরটা এই বস্তির থেকেও খারাপ হয়ে যায়!!
এইসব ভাবনার মাঝে হঠাত তানির চোখ আটকে গেল দুজন মানুষকে দেখে! ওটা বাপি না! বাপির পিছনে পিছনেই জাহেদ এই গলি দিয়ে হেঁটে পাশের গলিতে ঢুকে গেল! কিন্তু ওরা এখানে কি করছে?!!
**** **** ****
খুরশাদ সাহেব খুব টেনসানে আছেন । নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে! একবার এ দল তো আবার সে দল! তিনি বুঝতে পারছেন না কি করবেন! বয়স হচ্ছে তো! এইসব অবস্থায় মাঝে মাঝে তাকে ব্রথেলটাতে আসতে হয়! তার নিজের মালিকানার। কিন্তু নিজের বাড়ির একদম পিছনে বলে আসেন না।
অবশ্য তানিকে কঠিনভাবে বলে দেয়া আছে পশ্চিমের জানলা না খোলার জন্য!! কিন্তু মেয়েটা একদম তার মত হয়নি ।
তার মনটা খুব খুতখুত করছে। আজকে তিনি পশ্চিমের জানলা খোলা দেখেছেন। জেবিনের মতই কেউ দাঁড়িয়েছিল! ভাগ্যিস তিনি চট করে জোছনার কুটিরে ঢুকে পড়েছেন, কিন্তু খুতখুতি কিছুতেই যাচ্ছে না!
**** **** ****
জাহেদ বুঝতে পারে এখান থেকে সে বেরুতে পারবে না! কঠিন প্যাঁচে পড়েছে। জীবনটা কিভাবে কিভাবে ছাত্ররাজনিতির এই বেড়াজালে কবে কবে এত শক্তভাবে জড়িয়ে গেছে সে বুঝতেই পারে নি! আজকে আবার নেতার মাথায় ভূত চেপেছে, উনার মন অশান্ত হয়েছে।
ক্ষমতায় না গেলে যেহেতু শান্ত হওয়া যায় না ভালো করেই জানেন তাই চেষ্টার কমতি নেই । বাবাসাহেবের মুরিদ হয়েছেন, বাবা সাহেব তাকে একটা খাস শরবত দিবেন, এইজন্যে আবার ব্রথেল থেকে লেবুর শরবত লাগবে!! সেই লেবুর শরবত জোগাড়ের দায়িত্ব পড়েছে জাহেদের কাঁধে!
সবকিছু ঠিক ই ছিল । কিন্তু হঠাত করে দেখল জাহেদ তানির বাবা এখানে! পাছে উনি আবার ওকে দেখে ফেলেন তাই পিছনের একটা গলিতে নিঃশব্দে ঢুকেছে তার আগমুহূর্তে দেখতে পেল জানালায় তানি!!
**** **** ****
তানি আসতে পারেনি। সম্ভবত পথ চেনেনি বলে। একা একা বসে আকাশ দেখছিলাম।
হঠাত করে কি মনে হতেই আমি চুপচাপ চোরাগুপ্তচরের মত ওর মনের ভিতরে ঢুকতে লাগলাম! সময় কাটানোর সবচেয়ে ভালো উপায় কারো মন পড়ে দেখা কি লিখা আছে!
আমি একটু একটু চিনি মানে অনুমান করতে পারি ওর মনের পথটা কেমন হবে! আমাকে এত নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছে না চিনে উপায় নেই! “সমান্তরাল রেল লাইন, দুটো কৃষ্ণচূড়া গাছ নিবিড় করে পরস্পরে জড়িয়ে ধরে আছে, দুটো ডাল পরস্পরের বাহু এভাবে ধরেছে দেখে যে ভালোবাসা আকৃতির একটা অবয়ব হয়ে গেছে, ওখান দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের রেললাইন ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আলো রেললাইনের পাশের দিঘিটাতে পড়ে চোখে ঝিলিক দেয়!! পুরোটা দীঘি জুড়ে অসংখ্য লাল লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল জলের উপর বিছিয়ে থাকে”
কিন্তু আজকে যখন চুপচাপ ওর মনের ভেতর ঢুকেছি দেখতে পাচ্ছি অন্যরকম!! বর্ণনার সাথে মিল নেই! একদম অন্যরকম! “কে বা কারা রেললাইন উপড়ে ফেলেছে, কৃষ্ণচূড়া গাছ দুটি কেটে রেললাইনের উপর ফেলে রেখে পথরোধ করেছে! সেই ডাল দুটির জড়াজড়ি হাতের ভালোবাসা আকৃতিটাকে পড়ে থাকতে দেখা গেল দীঘির জলে। যেভাবেই গাছদুটিকে কাটা হয়েছে তাদের বিচ্ছিন্ন করা যায় নি। কিন্তু তাদের ফাঁক দিয়ে আর পড়ন্ত সূর্যের হাসির ঝিলিক চোখে পড়ছে না, বরং দীঘির জল উপড়ে উপচে ভালবাসাটাকে পূর্ণ করে রেখেছে । আবার হঠাত করে মনে হতে লাগলো, কে জানে এদের জল নয়তো? আচ্ছা , ভালোবাসা কি কাঁদে?!” এত সুখী একটা মেয়ে কি কাঁদে?!
**** **** ****
তানি বুঝতে পারছে তার ভেতরে হঠাত করে ঝড় আসছে! যত ঝড় তত জল! ওর ইচ্ছে হচ্ছে বাসা থেকে উড়াল মেরে হারিয়ে হয়ে যায়! চারপাশের মানুষগুলো বড় নোংরা! পুরোপুরি তো হারানো যাবে না, বাপি যেখান থেকেই পারে খুঁজে বার করবে! নাহয় হারানো হলই কয়েকদিনের নামে । তবু তো হারিয়ে যাওয়া!
একা একা কি হারিয়ে যেতে তানির খুব ভয় লাগে! সেই মানুষটার সাথে ওর বিকেলে দেখা করার কথা ছিল।
আচ্ছা ওকে বললে ও কি হারিয়ে যাবে একসাথে? পরিচিত মানুষগুলো এত অপরিচিত হলে , অর্ধপরিচিত বা অপরিচিত কোন আকাশের হাত ধরে অজানায় হারিয়ে যাওয়ার নেশা বড্ড চেপে বসে, যেখানে একপাশে সমুদ্র, একপাশে রেললাইন!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।