২০০৫-০৬ ঘটনা। আমি তখন আরামবাগে বড় মামার বাসায় আরামেই থাকি আর ওমেকাতে কোচিং করি। কাজিন ভিকারুন্নিছা’র (নাম ভুল করলাম কি?) ধানমন্ডি শাখার ছাত্রী। ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ে হয়ত। মাঝে মধ্যেই ওকে আনতে যেত হতো ধানমন্ডিতে।
রাস্তায় জ্যামের কথা মাথায় রেখে হাতে বাড়তি সময় নিয়েই বেরিয়ে পড়তাম। কোন কোনদিন কাটায় কাটায় ছুটির ঘন্টা পড়ার মুহুর্তে পৌছতাম। আবার কোন কোনদিন রাস্তা ফাঁকা থাকলে বেশ আগেই পৌছে যেতাম।
আগে আগে পৌছে গেলে খালাম্মাদের ভিরে সময় কাটানোই মুশকিল হয়ে যেত। তাই এর থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করলাম।
খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম স্কুলের গলির সাথে মেইন রোডের পাশে অবস্থিত ক্যাপিটাল মার্কেটে সিডির দোকান আছে। তো যেদিন ছুটির অনেক আগেই চলে আসতাম সেদিন সোজা সিডির দোকানে চলে যেতাম। বাংলা ব্যান্ডের পুরোনো পুরোনো সিডি কিনে নিয়ে আসতাম।
একদিনের ঘটনা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কোন সিডি পছন্দ হলোনা। সিডি বিক্রেতা কিছুটা বিরক্ত হলেন।
আমিও উনাকে আশ্বাস দিলাম পছন্দ হলে সিডি নিতাম। আর পায় কে!!! দোকানী 'সানী জুবায়ের'-এর ‘নির্জন স্বাক্ষর’ হাতে ধরিয়ে দিল। আমিতো মরি মরি অবস্থা। সাদাকালো সিডি কাভার। প্রচ্ছদে শিল্পীরা সাদাকালো ক্লোজ-আপ ছবি।
হাসিখুশি নয় আবার ভাবুকও নয়। কেমন যেন, ঐতিহাসিক কিছু ছবির মত। অপলক দৃষ্টি।
‘সানী জুবায়ের’ শিল্পীর নামই জীবনে শুনিনি কোনদিন। ভেতরে প্রযোজকের বাণীতে 'ভূমিকার বদলে' লেখা “যারা আমাদের সব সময় বলে থাকে একটু আলাদা, একটু অন্য রকম গানের অ্যালবাম আপনারা প্রডিউস করেন না কেনো? যাই হোক ‘নির্জন স্বাক্ষর’ একটি ভালো অ্যালবাম, আমাদের ধারণা”।
দেখেই কিছুটা বিরক্ত হলাম, মনে মনে ভাবলাম চাপা মেরে গান শোনাতে চাচ্ছে! আমি সিডি বিক্রেতাকে সিডি ফিরিয়ে দিলাম। বললাম, না ভাই, পছন্দ হয়নি!
সিডি বিক্রেতা অনেকটা জোর করেই সিডি ধরিয়ে দিল। অগত্যা সিডি নিতেই হবে বুঝতে বেশী বাকি রইলনা। যখন টাকা দিতে গিয়েছি তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে দোকানী বললো টাকা নেব না। আগে গান শুনবেন।
ভালো লাগলে টাকা দিয়ে যাবেন। ভালো না লাগলে সিডি ফেতর দিয়ে যাবেন। অনেকটা জোর করেই সিডির মূল্য দিলে ‘নির্জন স্বাক্ষর’ হাতের মুঠোয় চেপে ধরে কাজিনকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
সেদিনই অনেকটা অনাগ্রহে রাতের বেলা সিডিটি রিপ করা হয়েছিল। একটা একটা করে সবগুলো গান শুনলাম।
নাহ্! পুরাই ধরা!! বিরক্তিকর একটা অ্যালবাম। অযত্নে রেখে দিলাম সিডিটি। বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন আমি আর বাবু (মামাতো ভাই) ডেস্কটপে গান শুনছিলাম তখন ড্রয়িং রুম থেকে একটি গানের সুর ভেসে এলো। মুহুর্তেই ভালোলাগায় ভরে গেল আমার মন।
তাড়াহুড়ো করে গেলাম টিভি রুমে। ঝাঁকড়া চুলের একজন শিল্পী হারমোনিয়াম নিয়ে গান গাচ্ছেন
‘মেঘে মেঘে ঢেকে ঢেকে গেল কত কত বেলা
রঙের সাথে রঙের শুধু লুকো লুকোচুরি খেলা
তুমি ফাগুন আমি কোকিলের গান গাওয়া
হবেনা আমার না পেলে তোমায়
কোন কিছু আর পাওয়া . . .
পথে যেতে যেতে মনে হলো মিছে এ পথচলা
বলার ছিল যে কথা রয়ে গেল হলো নাতো বলা
আমি শ্রাবণ তুমি ঝিরি ঝিরি ঝিরি হাওয়া
হবেনা তোমার না পেলে আমায়
কোন কিছু আর পাওয়া . . . আমি আগুন তুমি মৃদু মন্দ হাওয়া
নিত্য আমার অনুভবে তোমার আসা যাওয়া’ শিরোনামঃ আমি আগুন
কথা, সুর, সঙ্গীত ও কণ্ঠঃ সানী জুবায়ের / (অ্যালবামঃ নির্জন স্বাক্ষর)
পথে যেতে যেতে মনে হলো মিছে এ পথচলা
বলার ছিল যে কথা রয়ে গেল হলো নাতো বলা
আমি শ্রাবণ তুমি ঝিরি ঝিরি ঝিরি হাওয়া
হবেনা তোমার না পেলে আমায়
কোন কিছু আর পাওয়া . . .
আমি আগুন তুমি মৃদু মন্দ হাওয়া
নিত্য আমার অনুভবে তোমার আসা যাওয়া’
শিরোনামঃ আমি আগুন
কথা, সুর, সঙ্গীত ও কণ্ঠঃ সানী জুবায়ের / (অ্যালবামঃ নির্জন স্বাক্ষর)
মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠলো। এ গান আমি শুনেছি। কিন্তু শিল্পীকে চিনতে পারছিনা। কোথায় শুনেছি কোথায় শুনেছি কোন ভাবেই মনে করতে পারছিনা।
আমার একটা সমস্যা হলো যখন কোন গানের লিরিক মাথায় ঢুকে পড়ে এবং আমি যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা কোন গানের লিরিক খুঁজে বের করতে না পারি ততক্ষণ অস্থির অস্থির লাগে। মাথার ভেতরে শুধু সার্চ দিয়েই যাই। বেশ কিছুক্ষণ পর মনে হলো নতুন যে সিডিটা কিনেছি কোন কারণে কি সেই অ্যালবামের গান হতে পারে? কিন্তু বিশ্বাস হতে চাচ্ছিলো না। কারণ আমি অ্যালবামটা একবার শুনেছিলাম। তবুও অবিশ্বাসকে বিশ্বাস করে রিচেক করার চিন্তা করলাম।
খুঁজে বের করলাম সেই সিডি। শিল্পীর চেহারার সাথে কিছুটা মিল পাওয়া গেল। নতুন করে শুনতে থাকলাম ‘নির্জন স্বাক্ষর’। প্রথম গান ‘আজ আমার মন ভালো নেই’ কিন্তু আমি খুঁজছি একটু আগে টিভিতে দেখা-শোনা গানটি। আমাকে হতাশ হতে হলো না।
সেকন্ড ট্র্যাকেই পেয়ে গেলাম কাঙ্খিত সেই গানটি।
মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনলাম, শুনতেই থাকলাম। যতই শুনি ততই আমার ঘোর বাড়তে থাকে। তৃপ্তির চূড়ান্ত সীমা ছাড়িয়ে যাবার পর পুরো অ্যালবাম প্রথম থেকে শুনতে শুরু করলাম। এরপর থেকে সুযোগ মিললেই শুনতাম ‘নির্জন স্বাক্ষর’।
ফার্স্ট ট্র্যাক ‘আজ আমার মন ভালো নেই’। এবার আমার বিষ্ময়ের পালা শুরু। আমাকে মুগ্ধতার জালে বন্দী করে ফেললেন এই সাদাকালো ফ্রেমের অচেনা অজানা শিল্পী সানী জুবায়ের। ‘আজ আমার মন ভালো নেই’, ‘আমি আগুন তুমি মৃদু মন্দ হাওয়া’, ‘সন্ধ্যার হাহাকার’, ‘একটি চাওয়া’, ‘শুধু শখের জন্য’, ‘ওরে হৃদয়’, ‘যদি বলো আমি’, ‘মোহর আমার’, ‘সহজ চোখে’ ও ‘নির্জন স্বাক্ষর’।
এক একটি গান এক একটি সন্ধ্যার হাহাকার।
প্রতিটি গানের লিরিক এত সুন্দর ও কাব্যময় যে আমি শুধু মুগ্ধতায় পুড়ে গিয়েছি। ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতায়োজনে সানী জুবায়ের-এর এক একটি উপস্থাপন নিঃসন্দেহে বাংলা সঙ্গীতাঙ্গনের এক একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
আমি যখন ‘নির্জন স্বাক্ষর’ জ্বরে পুড়ছি তখনই উপলব্দি করলাম ‘ওয়ার্ল্ড মিউজিক’ কর্তৃপক্ষ সানী জুবায়ের সৃষ্টিকর্মের যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারেনি, তার সৃষ্টিকর্মের উপর আস্থা রাখতে পারেনি, তার সৃষ্টিকর্মগুলোকে উপলব্ধি করতে পারেনি। যদি সানী জুবায়ের-এর ‘নির্জন স্বাক্ষর’কে মূল্যায়ন করতে পারতো তবে তারা ‘ভূমিকার বদলে’তে এটা বলতো না যে ‘নির্জন স্বাক্ষর একটি ভালো অ্যালবাম, আমাদের ধারণা’!!!
সানী জুবায়ের এর ‘নির্জন স্বাক্ষর’ শুধুই অসম্ভব ভালো একটি অ্যালবামই নয়, বাংলা সঙ্গীতের একটি উল্লেখযোগ্য ও বিষ্ময়কর সংযোজন।
এই যে সানী জুবায়ের শোনা শুরু করলাম, আর কখনোই থামাইনি।
বসুন্ধরা সিটির সিডির দোকানের ধূলির স্তুপ থেকে খুঁজে বের করে নিয়ে শুনলাম প্রথম অ্যালবাম ‘সারা’। আমাকে স্তব্দ করে দেবার জন্য ‘শুধু তোমার জন্য’ শিরোনামের একটি গানই যথেষ্ট ছিল।
সে বছরই শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। সেজ মামা সিলেট থাকতেন। গিয়ে উঠলাম সেজ মামার সাথে।
সেজ মামার সনির থ্রী-ট্রের একটা দানবীয় সিডি প্লেয়ার ছিল এবং এখনও আছে। প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরেই বিকেল বেলা থেকে সন্ধ্যা অবদি পুরোটা সময় ধরে শুনতাম ‘নির্জন স্বাক্ষর’। আমি বাক্সপেটরা নিয়ে যখন সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দেই তখন আমার মানি ব্যাগে ভাঁজ করে রাখা ‘তুমিহীনা সারাবেলা’, ‘বেস্ট অব মিজান’ আর ‘আলোড়ন’ অ্যালবামের কাভার এবং বলার মত সঙ্গী ছিল সানী জুবায়ের- এর অডিও সিডি ‘নির্জন স্বাক্ষর’। সিলেটের প্রথম দিকের বিকেল বেলাগুলো আমার এভাবেই কেটে যেত . . . ‘পথে যেতে যেতে মনে হলো মিছে এ পথ চলা/বলার ছিল যে কথা রয়ে গেল হলো নাতো বলা . . .’।
এরপর ডিপার্টমেন্টে বন্ধু জুটে গেল।
লেখা পড়ার কাজে সহায়ক হবে এই অযুহাতে সেজ মামার বাসা থেকে মেসে চলে গেলাম। সমমনা কয়েকজন বন্ধু মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকটা কাছেই মেস ভাড়া করে থাকতে শুরু করলাম। ওদেরকেও পরিচয় করিয়ে দিলাম ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী সানী জুবায়ের এর ‘নির্জন স্বাক্ষর’ অ্যালবামের সাথে। যখন সানী জুবায়েরকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আমার বন্ধুরা তখন মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে ‘লিন্কিন পার্ক’, ‘সিসটেম অফ এ ডাউন’, ‘মেটালিকা’, ‘আইরন মেইডেন’ কিংবা বাংলার ‘আর্টসেল’, ‘অর্থহীন’, ‘শিরোনামহীন’, ‘ক্রিপ্টিক ফেইট’ সহ আরও অন্যান্য। ওরা সানী জুবায়ের পছন্দ করবে!!! না, সানী জুবায়ের-এর গান ভালো না লাগা নিয়ে কোন শঙ্কা ছিলনা আমার মনে।
প্রথমেই শুনতে দিয়েছিলাম ‘আমি আগুন তুমি মৃদু মন্দ হাওয়া’। ব্যাস্! তাতেই হয়ে গেল কাজ। মজার ব্যাপার হলো সানী জুবায়ের এর চতুর্থ (অজস্র কবিতা) ও পঞ্চম (অদ্ভুত আঁধার এক) অ্যালবামের সিডি আমাকে কিনতে হয়নি কিংবা কিনতে দেয়া হয়নি। আমার বন্ধুরাই কিনেছে। ‘অজস্র কবিতা’ অ্যালবামটি ‘নির্জন স্বাক্ষর’ অ্যালবামের মতই ধ্রুপদী ও অনন্য! প্রতিটি গান মুগ্ধতার জালে জড়িয়ে ফেলে অজান্তেই।
খুব সহজেই বশীভূত করে ফেলে সানী জুবায়ের এর এক একটি কথা, সুর ও উপস্থাপন। আমি যে শিল্পীদের গান প্রাত্যহিক শুনি ‘সানী জুবায়ের’ তাদের অন্যতম। আজ আমার এই প্রিয় শিল্পীর জন্মদিন। ১৯৭৩ সালের ২-রা ডিসেম্বার তিনি জন্ম নিয়েছিলেন।
প্রিয় শিল্পীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর মত উপযুক্ত কোন শুভেচ্ছাবাণী জানা নেই আমার।
শুধু জমে থাকা অনুভূতিগুলোর একমুঠো উপলব্ধি লিখে পাঠালাম। ভালো থাকবেন ধ্রুপদী গায়ক। ভালো থাকুক যত সুরের মূর্ছনা।
আপনার গানে আমি শুধু বার বার বিষ্মিত হতে চাই, মুগ্ধ হতে চাই!
কারো চোখ যদি উঠে বিষাদে ভরে
কারো মন যদি হাহাকার করে মরে
আশার প্রদীপ জ্বেলে দেবে তার ঘরে
তার ছোয়াতে মরু হবে যে সরোবর .... শহরে এসেছে সুরের যাদুকর
চোখে তার স্বপ্ন করছে এখন ভর
গানে গানে দেবে ভরে বিশ্ব চরাচর কথা, সুর, সঙ্গীত ও কণ্ঠঃ সানী জুবায়ের
অ্যালবামঃ অজস্র কবিতা
.... শহরে এসেছে সুরের যাদুকর
চোখে তার স্বপ্ন করছে এখন ভর
গানে গানে দেবে ভরে বিশ্ব চরাচর
কথা, সুর, সঙ্গীত ও কণ্ঠঃ সানী জুবায়ের
অ্যালবামঃ অজস্র কবিতা
* সানী জুবায়ের এর প্রকাশিত সলো অ্যালবামঃ
১. সারা (ডিবাট সলো)
২. আপনা খেয়াল (গজল অ্যালবাম)
৩. নির্জন স্বাক্ষর
৪. অজস্র কবিতা
৫. অদ্ভুত আঁধার এক
৬. কেন মেঘের ছায়া (নজরুল সঙ্গীতের অ্যালবাম)
মিক্সডঃ যুগসন্ধি (সানী জুবায়ের-এর সুর ও সঙ্গীতায়োজনে অসাধরণ একটি মিক্সড অ্যালবাম)
বিদ্রঃ অফিস থেকে ফিরে লেখা শেষ করে উঠতে উঠতেই ০৩ তারিখ হয়ে গেল। শিল্পীকে যথাসময়ে শুভেচ্ছা জানাতে পারিনি।
মনটা বিষাদে ভরে গেলো।
----------------------------------------------
মোখলেছুর রহমনা সজল - ০৩/১২/২০১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।