১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর থেকে ক্রমান্বয়ে রাজনীতি মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। শিক্ষিত, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিজের ও পরিবারের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে সরাসরি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চান না। ফলে দেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চাকরিজীবী এবং তরুণ সমাজ রাতারাতি ধনী হওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তার খেসারত দিতে হচ্ছে নিরীহ জনসাধারণকে। অনেকে আজ বিপদগামী ও দুর্নীতিগ্রস্ত।
নব্য ধনীদের অনেকে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত। বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। দেশের সংস্কৃতিতে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। এক কথায় বলতে গেলে, সমগ্র সমাজ আজ দিকনির্দেশনাহীন এবং লণ্ডভণ্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে।
এর মূল কারণ_ দুর্নীতি ও সামাজিক অবক্ষয়ের ডালপালা সমাজের সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করেছে।
আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব প্রায় লোপ পাচ্ছে। নামেই আমরা মুসলমান। মসজিদ থেকে জুতা ও মোবাইল ফোন চুরি করা থেকে এহেন কোনো কাজ নেই যে, আমরা করছি না। বাস্তবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশগুলো মেনে চলতে অনেকেরই অনীহা। অপসংস্কৃতি আমাদের প্রতিনিয়ত গ্রাস করে চলেছে।
অন্যদিকে দুর্নীতিবাজরাও উইপোকার মতো দেশকে খেয়ে ফেলেছে। আছে শুধু আবরণ। যে কোনো সময় বড় ধরনের ধস নামতে পারে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অর্থ হলো, যা পাও তা খাও, যা ইচ্ছা তা বলতে পার। যা ইচ্ছা তা করতে পার, যখন ইচ্ছা প্রতারণা করা যায়, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যায়, মানুষকে ধোঁকা দেওয়া যায়, অবাধে দুর্নীতি করা যায়, ইচ্ছা করলে মানুষ খুনও করা যায়।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে সাত খুন মাফ। রাজনীতির মূল লক্ষ্যই হলো, যে কোনো পন্থায় হোক না কেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। আর সেই ক্ষমতা হলো ত্যাগের জন্য নয়, ভোগের জন্য। দেশের বা মানুষের মঙ্গলের জন্য নয়। এ ধরনের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল।
একজন এমপি বা মন্ত্রী শপথ গ্রহণ করার পর, তিনি কখনো নিজ দলের বা কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য নিজকে আত্দনিয়োগ করতে পারেন না। সবার প্রতি ন্যায় আচরণ এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে আত্দনিয়োগ করতে হয়।
অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে আমাদের দেশের যুবসমাজ অধিকতর জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, সৃজনশীল এবং কঠোর পরিশ্রমী। প্রয়োজন শুধু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর। তাদের চরিত্র গঠনের ব্যাপারে আমরা উদাসীন এবং বিপদগামী করার জন্য দায়ী।
প্রশ্ন হলো, দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতি এ ধরনের দায়িত্ব পালনে কতটুকু সক্ষম।
আমাদের যুবসমাজের প্রাণশক্তি, উদ্দীপনা, দেশ ও জাতির উন্নয়ন এবং অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। তারুণ্যের শক্তি যেমন দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে পারে, ঠিক তেমনি অপরদিকে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতির কারণও হতে পারে। যে কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি যুবসমাজের আসক্তি তার প্রাণশক্তিকে অকালে নষ্ট করার পাশাপাশি, তাকে অসামাজিক ও ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে তাড়িত করে এবং ক্রমান্বয়ে বিপদগামী হয়। অন্যদিকে তরুণ সমাজের একটি অংশ স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের আপলোডের মাধ্যমে ভিনদেশি অপসংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
এর কুফলে ক্রমান্বয়ে ইভ টিজিং, অপহরণ, ধর্ষণ, খুন, গুম ও অপমৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
দুর্নীতি দেশের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে ফেলছে। দুর্নীতি সব সময় সরকারি দলের ছত্রছায়ায় এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয়েই হয়। ক্ষমতার লোভ, আমাদের দায়িত্বহীনতা ও সদিচ্ছার অভাব, দেশের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান অন্তরায়।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছে।
গণতন্ত্রের নামে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় আমরা আজ লিপ্ত। অনেকে মনে করছেন, চিরস্থায়ীভাবে তারা বাংলাদেশকে লিজ নিয়েছেন। অন্য কারও ক্ষমতায় আসার অধিকার নেই। ভিশন-২০২১ তারই উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
পঞ্চদশ সংশোধনী ও বর্তমান সরকারের খামখেয়ালিপনার ফলে দেশে সংঘাত, অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে।
এ ছাড়াও বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সৃষ্টি হয়েছে স্থবিরতা। সংকট নিরসনের জন্য সরকার দৃশ্যত এ যাবৎ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার পথ পরিহার করে, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত হুঙ্কার দেওয়া হচ্ছে। এতে প্রতিশোধপরায়ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে কারও মঙ্গল হবে না।
সমস্যার সমাধানও সম্ভব নয়। উগ্রবাদ বৃদ্ধি পাবে। কারণ বর্তমান সরকারের একগুঁয়েমির কারণে জঙ্গিবাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করছে। আইন ও সংবিধান জনগণের মঙ্গলের জন্য, অশান্তি-অরাজকতা বৃদ্ধি এবং জঙ্গিবাদ বিস্তারের জন্য নয়।
অনেকে কথায় কথায় বলেন, বাংলাদেশের লোক মৌলবাদী। তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ মৌলবাদী। কারণ আমরা সবাই নিজ নিজ ধর্মের মূল মন্ত্রে বিশ্বাসী। তবে উগ্রবাদী হওয়া ধর্মের পরিপন্থী।
জনগণ কি চায় বা তাদের দাবি কী, কীভাবে দেশে শান্তি ফিরে আসবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, সুখে-শান্তিতে ও নিরাপত্তায় বসবাস করতে পারবে_ তা নিয়ে এখন আমরা ভাবছি না।
আমরা ভাবছি নিজের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার কোনো বহিঃপ্রকাশ না ঘটিয়ে আমরা অপরাজনীতিতে লিপ্ত। জনগণের প্রতি রাজনীতিবিদদের দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। রাজনীতি হচ্ছে একটি আদর্শের নাম। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্বশীলতা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত।
মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করা হচ্ছে, আইন এবং সংবিধানকে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। জনগণকে তোয়াক্কা করার কোনো প্রয়োজন বোধ করে না। কখনো কি আমরা নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করেছি, আমরা যা করছি, তা সঠিক কিনা?
তাই পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের সমাজের সর্বস্তরে যেভাবে উইপোকা আক্রমণ করেছে, এর থেকে বের হতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই এখন ভাবার বিষয়। একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, যতদিন আমরা সমাজ থেকে দুর্নীতিকে চিরতরে বিতাড়িত করতে পারব না, অহঙ্কার পরিহার করতে পারব না, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হব না, ততদিন আমাদের দেশের অবস্থারও পরিবর্তন হবে না। ক্রমশ সংঘাত বৃদ্ধি পাবে।
লেখক : সংসদ সদস্য ও প্রেসিডেন্ট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।