মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে , সাথে নিজেকেও । এটা মার্কস অথবা এঙ্গেলসের একটি বক্তব্য , এখন আমার ঠিক মনে নেই । ছাত্র জীবনে পরেছিলাম । এখানে এই বক্তব্যটা উল্লেখ করার কারন সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিয়ে একজনের একটা লেখা দেখলাম ফেসবুকে কিন্তু মন্তব্য করার জন্য এখন আর লেখাটা খুজে পাচ্ছি না । লেখক বলতে চেয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের মন মানসিকতার পরিবর্তন হলেই সমাজ পরিবর্তন হয়ে যাবে ।
সেই আন্দোলনে উনি দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো কে পাথেয় মনে করেন । সেই জন্যই আমার নিজ মতামত দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি । আর একটি কারন হচ্ছে ছাত্র জীবনে প্রগতিশীল আন্দোলন করতে গিয়ে নাওয়া, খাওয়া, পরীক্ষা, জীবনের ক্যারিয়ার ইত্যাদি পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন বিষয়ে আলোচনা করতে করতে মুখে ফেনা তোলা সহ দিনের পর দিন নষ্ট করেছি ( অভিবাবকদের ভাষায় নষ্ট ) ।
সামান্যতম রাজনৈতিক অর্থনীতি সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে তারা মাত্রই জানেন যে সংস্কৃতি হচ্ছে অর্থনীতির একটি প্রতিফলিত রুপ । সাংস্কৃতি মানুষের মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রন করে ।
অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতি দ্বারা । চাহিদা বেশি হলে এবং জোগান কম হলে পন্যের দাম বাড়বে ইত্যাদি সাধারন কিছু নিয়ম ছাড়া অর্থনীতির পুরটাই রাজনৈতিক অর্থনীতি । রাষ্ট্র চাইলে অর্থনীতিকে ব্যক্তি মালিকানা থেকে সামাজিক মালিকানায় ( রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ) পরিবর্তন করতে পারে । আবার সামাজিক মালিকানা থেকে ব্যক্তি মালিকনায় আনতে পারে । উৎপাদনের উপায়ের এই মালিকানার উপর নির্ভর করেই গড়ে উঠে উৎপাদন ব্যবস্থা ( Mood of Production ) ।
এই উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতিফলিত রূপ হচ্ছে সংস্কৃতি । আমি তাই জানি । এই উৎপাদন ব্যবস্থার উপর দাড়িয়ে মানুষ দৈনন্দিন যে সমস্ত কার্যকলাপ করে থাকে তাহাই সংস্কৃতি । অর্থাৎ মানুষ দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামে যে আচার আচরন, কথা বার্তা , চাল চলন , পোশাক পরিচ্ছদ , নীতি নৈতিকতা প্রদর্শন করে তাহাই সাংস্কৃতি এবং কবি সাহিত্যিকরা লেখনির মাধ্যমে মানুষের এই দৈনন্দিন কার্যকলাপকেই তুলে ধরে । কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ও শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থা যেমন এক রকম নয় তেমন দুই ব্যবস্থার সাংস্কৃতিও এক নয় ।
আমরা এখন কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থায় উত্তরন পর্বে রয়েছি । এই উত্তরন পর্বে সাংস্কৃতির পরিবর্তনটাও খুব স্বাভাবিক ব্যপার । সামন্ত সাংস্কৃতিক চর্চায় যারা অভ্যস্ত তাদের পুঁজিবাদী সংস্কৃতির উত্তরন পর্বে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হচ্ছে । আবার ইউরোপ আমেরিকার পুঁজিবাদ এর পর্যায়ে যেতে আমাদের অনেক সময় লাগবে বিধায় তাদের সংস্কৃতির সাথে মিল খুজতে যাওয়া বা অনুসরন করারও কোন উপায় নাই । পুঁজিবাদী অর্থনীতির উত্তরন পর্বে নীতি নৈতিকতার পরিবর্তন হয় এবং সাথে সাথে রাষ্ট্রকেও তার আইন পরিবর্তন করতে হয় ।
বর্তমান সময়ে খ্যাদ্যে বিষাক্ত ফরমালিন ব্যবহার করাটা হচ্ছে মুনাফা বা অতি মুনাফার সংস্কৃতি । আমরা যে বিষ মেশাচ্ছে তাকে দোষারোপ করছি , আইনে এর কোঠর শাস্তি না থাকায় সে অতি মুনাফার এই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে । আবার রাষ্ট্র যখন আইন তৈরি করবে তখন সেই আইনের পক্ষে একটি প্রয়োগিক সংস্কৃতি তৈরি হয় এবং তার দ্বারা অতি মুনাফার সংস্কৃতি পরাজিত হয় । মানুষ আইন চর্চা করে, তাকে লঙ্ঘন করে না শাস্তির ভয়ে । এটাও একটা সংস্কৃতি ।
বাংলাদেশের অর্থনীতি মুলত লুটেরা পুজি নির্ভর । লুটেরা পুজি যেহেতু রাতারতি তৈরি হয় , কাজেই এই পুজি বিনিয়োগে কোন নিয়ম কানুন মানতে হয় না । রাষ্ট্রীয় আইন এখনও বেশির ভাগ সামন্ত উৎপাদন ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে তৈরি । এই আইন যত ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে পুজি তার চেয়ে অনেক দ্রুত ব্যবহার হচ্ছে । আর বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে লুটেরা পুজির মদদ দাতা ও প্রতিনিধি ।
রাষ্ট্র এখনও পুজির ব্যবহারিক নিয়ন্ত্রন করার মত আইনি কাঠামো ও লোকবল নিয়োজিত করতে পারছে না । রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্রকে লুটেরা পুজি তৈরির মেশিন হিসাবে ব্যবহার করছে বিধায় সেই স্বদিচ্ছাও নেই । লুটেরা পুজির অর্থনীতির উপর দাড়িয়ে যে সংস্কৃতি তারই ফলাফল স্পেকট্রাম গার্মেন্টস , তাজরিন ফ্যাশন , সর্বশেষ রানা প্লাজা । সবই অতি মুনাফা করার অর্থনৈতিক সংস্কৃতি ।
জনগণ যতই চিল্লাচেল্লি করুক না কেন এই সমস্ত ঘটনা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অর্থনীতির সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ফলাফল এবং অবশ্যম্ভাবী পরিনতি ।
এখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে যারা ( বিশেষত প্রথম আলো ) সমাজকে বদলাতে চান তারা এই বদলানোর কথা বলে আরও একটি অতি মুনাফার ব্যবসা ফেদে বসেছে । রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অর্থনৈতিক কাঠামোর সুনির্দিষ্ট রূপরেখা অনুযায়ী অর্থনীতিকে পরিচালিত করতে পারলে এবং সেই অর্থনীতি বিকাশের সহায়ক আইন ও রাষ্ট্র কাঠামো গঠন করতে পারলে একটি সুন্দর সাংস্কৃতিক বিকাশ সমাজে প্রতিফলিত হবে – এটাই নিয়ম । ইতিহাস ঘাঁটলে তাই পাওয়া যায় ।
সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা সাংস্কৃতিক বিপ্লব বলতে কিছু নেই । মানুষ যা করে তাই সংস্কৃতি ।
কৃষকের গামছা ব্যবহার , মাথায় মাতলা ব্যাবহার সবই প্রয়োজন থেকে । এই প্রয়োজনকেই ফ্যাশন বলা হয় । এখন মাতলা ব্যবহার হয়না বলে তা সংস্কৃতির ঐতিহ্য । অর্থনীতির বিকাশের প্রতিটি ধাপের সাথে সাথে তার সংস্কৃতিও বিকশিত হয় । জোর করে আলাদা ভাবে অর্থনীতির বিকাশকে পাশ কাটিয়ে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয় ।
সেই চেষ্টাকে আমি অবজ্ঞা করবো না বরং সম্মান জানানোই উচিৎ কিন্তু লক্ষ্যটা যে মুনাফা করা । সেই জন্য আমি এটাকে সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন না বলে পরিস্কার ব্যবসা বলতে চাই ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।