স্কুল থেকে ফিরে মামার বাসার গেটের সামনে সামান্য জটলা দেখে ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখলাম তাতে আমার মনে তেমন কিছু আমার আগ্রহ তৈরি করতে পারলো না ।
ছেড়া ছালা বিছিয়ে কুচকুচে কালো জীর্ন এক চেংড়া ছেলে মুচির বাক্স নিয়ে মামার গেটের সামনে আস্তানা গেড়েছেন । এতে করে অভিজাত(!) শ্রেনির মামার ভাড়াটিয়াদের সম্মান যায় যায় অবস্হা । তাই তাকে স্হানচুত করার আপ্রান চেষ্টা । কিন্তু সদ্য শহরে পা রাখা ছেলেটি গো ধরে বসেই আছে।
বাধ্য হয়ে বাড়িওয়ালা মামার দুপুরের আরামের শয্যা ত্যাগ করে নিচে আসতে হলো । জটলার ফিসফিসানিতেই চেংরা ছোড়া বুঝে নিলো উনিই আসল লোক যাকে ধরলে তার এই ভবিষ্যত রোজগারের যায়গাটুকুতে একটা বন্দোবস্ত হবে ।
যেমন ভাবা তেমন কাজ । সোজা পায়ের উপর ঝাপ এবং বেদম কান্না । হতভম্ব মামা কিছুটা সুস্হির হয়ে প্রশ্ন করলো
-কবে আসছিস ঢাকায় ??
-আজকে সকালে ।
-আর কোনো জায়গা পেলি না তোর দোকান সাজানোর জন্য ??
-ফার্মগেটে চেষ্টা করছিলাম । সবাই খেদাইয়া দেয় ।
-নাম কি তোর ??
-নিখিল ....
-বাড়ি কোথায় ???
-মনোহরদি ।
মামা কি যেন চিন্তা করলেন । তারপর উপস্হিত ভাড়াটিয়াদের বললেন ।
নিখিল আজ থেকে এখানেই বসবে , এতে আপনাদের কারো যদি আমার বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হয় তবে আপনারা বাড়ি বদলে ফেলতে পারেন । এইবলে আবার নিখিলের দিকে ফিরলেন ।
-রাতে কোথায় থাকবি ???
নিখিল অশ্রু ভরা চোখে এমন এক দৃষ্টিতে তাকালো যেনো এটা কোনো প্রশ্নো হলো ???
দ্বিতীয় বার একই প্রশ্নের উত্তরে বোঝা যায় না এমন স্বরে বললো
-জানিনা ।
মামা আরেকবার কি যেনো চিন্তা করে আঙুল ইষারায় পাঁচ তলার ছাদের সিড়ির ল্যান্ডিংটা দেখিয়ে বললো ওখানে রাতে ঘুমাবি । রাস্তা ঘাটে রাতে থাকিস না ।
নিখিল শুধু ঘাড় কাত করলো । সেই সাথে ভাড়াটিয়াদের গুন্জন শুনতে পেলাম । মামা সব কিছু উপেক্ষা করে দোতলায় উঠে গেলেন ( সম্ভবত সাথে সাথে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়েও গি্যেছিলেন )
নিখিলের এমন এন্ট্রান্স মামার ফ্যামিলি খুব ভালো ভাবে মেনে না নিলে ও কেউ তার প্রতিবাদ ও করার সাহস দেখায়নি ।
ধীরে ধীরে আমরা জানতে পারলাম যে , নিখিলের দুইটা এতিম ও নাবালক ভাতিজা ছাড়া এই জগতে আর কেউ নেই । ভাতিজা দুটাকে আপাতত মনিহরদিতে এক দুরসম্পর্কের বোনের বাসায় রেখে এসেছে ।
এমনি করেই নিখিল টিকে গেলো ব্যাস্ত ঢাকায় তবে আমার জন্য নিয়ে এলো এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা, অন্য এক জগৎ ।
স্কুল পড়ুয়া আমার সাথে নিখিল অনেক গল্প করতো । তার শৈশব , তার কুড়ে ঘর , বড় ভাই ভাবি যখন জিবীত ছিলো তাদের গল্প । সেই সাথে গ্রামে কাঠাল চুরি করে খাওয়া , ভর দুপুরে নদীতে ডুব সাতার । আমি যেন নিখিলের সাথেই কাঠাল চুরি করছি অথবা ভরা নদীতে ডুব সাতার দেই ।
ধীরে ধীরে নিখিল আমার প্রিয় বন্ধু হলো । স্কুল ছুটির পড়ে আমি নিখিলের কাঠের বাক্সের উপর বসে বসে তার গল্প শুনি । বাসা থেকে প্রায়ই প্যাদানি খাই একটা মুচির সাথে অন্তরংগতার কারনে । কিন্তু আমার গল্পের নেশাতো আর কাটে না । আরো ধীরে ধীরে নিখিল আমার আম্মা আব্বার ও মন জয় করে ফেললো তার গ্রাম্য সরলতা দিয়ে ।
গল্পের পাশাপাশি সেও আমাকে শিখায় কি ভাবে জুতাতে কালি লাগাতে হয় । কি ভাবে ব্রাশ করলে জুতা আরো বেশি চকচকে হয় । সাদা কেডস কি ভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার রাখতে হয়, ইত্যাদি ।
নিখিলের একটা স্বভাব ছিলো যে , হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে যেত তবে ফিরার পরেই বড় মামার তুমুল গালি খেয়ে ও ভীষন আনন্দিত মুখে আমার কাছে এসে বলতো মামা (আমাকে সে মামা বলতো) ভাই টা যে কি খালি বকা দেয় ( যেন এ বকা খাওয়ার আনন্দটুকু পাওয়ার জন্যই সে নিরুদ্দেশ হয় )।
এরই মধ্যে আমি কলেজে উঠলাম ।
হঠাৎ একদিন বিকেলে খবর পেলাম বড় মামা হসপিটালে ,অবস্হা ভীষন খারাপ । ছুটলাম সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে । জানলাম অবস্হা সত্যিই বেশি খারাপ রাতটা টিকে কিনা ঠিক নেই । আশে পাশে শত আত্বীয় স্বজনের মাঝে নিখিলকে আবিস্কার করলাম সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে লাল দেয়াল ঘেসে উপুৎ হয়ে পড়ে আছে । আর মাঝে মাঝে কেপে কেপে উঠছে ।
শুনলাম , এম্বুলেন্সের সাথে জোর করেই সে হসপিটালে চলে এসেছে এবং আসার পর থেকেই কারো সাথে আর কোনো কথা বলে নাই । এবং ঐ ভাবেই উপুৎ হয়ে পড়ে আছে তাকে কেউ নাড়াতে পারছে না । সে যাত্রায় মামা বেঁচে গেলো ..
দীর্ঘ ৪৮ ঘন্টা নিখিল হাসপাতাল ছেড়ে নড়েনি... এমনকি তাকে চা ব্যাতিত অন্য কিছু খাওয়ানো যায়নি । নিখিলের এমন আচরনে যেনো আমাদের ও চোখ খুলে দিলো । নিখিল আমাদের শেখালো, শুধু মাত্র রক্ত অথবা ধর্ম মানুষ মানুষকে আপন করে না ।
মানুষ আপন হয় তার মহানুভবতায় , তার গুনে এবং তার সৃষ্টিতে ।
এরপর থেকে নিখিল যেনো আরো বেশি আমাদের আপন হয়ে গেলো । নিখিল ও ভালোবাসার সুযোগ বুঝে মামাকে তার এতিম এক ভাতিজাকে ঢাকায় আনার অনুমতি চাইলো । অনুমতি পাওয়া মাত্রই ভাতিজা হাজির । নাম মালু, ছিপছিপে শুকনা এক ১২/১৪ বছরের কিশোর ।
চোখ ভরা তার স্বপ্ন । মামা স্কুলে দিতে চাইলে নিখিল রাজি হলো না । তার ইচ্ছা ভাতিজা ভালো করে মুচির কাজটা শিখুক , তা না হলে ভবিষ্যত অন্ধকার (!!!) ।
মালু সারাদিন তার কাকার কাজ শিখে আর আমি কলেজ থেকে ফিরলেই পিছু পিছু সোজা আমার বাসায় । আমার সাথে সিনেমা দেখা অথবা আমার ফাইফরমাস খাটা তার প্রিয় শখ বলে মনে হতো ।
এভাবেই দিন যায় .... একদিন শুনলাম নিখিল বিয়ে করতে বাড়ি গেছে । বিয়ে করে বউ ও নিয়ে আসলো ঢাকায় । ঘর ভাড়া করলো আগারগাও । কাকা-কাকির সাথে মালু ও চলে গেলো আগারগাও । তবে প্রতিদিন চাচা-ভাতিজা আমাদের এলাকায় চলে আসতো কাজ করতে ।
ভীষন সুখি সংসার তাদের ।
এরই মাঝে মালুকে তার কোনো এক দেশিলোক এস,এম(ডি ইউ) হলে কাজ করতে বললো । যথারিতী মালু আমার অনুমতি চাওয়াতে আমি বললাম চলে যাও । ওখানে গেলে তোমার আয় রোজগার ভালই হবে । তবে সে যেতে রাজি হলো এক শর্তে ।
আমাকে সপ্তাহে একবার অন্তত তাকে দেখে আসতে হবে । আমি বললাম কোনো অসুবিধা নেই , আমিতো অই এলাকাতে বেশি আড্ডা দেই । সপ্তাহে কেনো? প্রতিদিনই যাওয়া যাবে ।
আসলে মালুর অইখানে মাসে একবার ও যাওয়া হতো না । এতে তার ভীষন ক্ষোভ জমলো এবং একদিন এসে আমাদের বাসার জুতার রেক থেকে আমার সব জুতা স্যান্ডেল ব্যাগে ভরে নিয়ে গেলো ।
আম্মা কারন জিগ্গেস করাতে বললো ভাইয়া সব জুতা পরিস্কার করতে কইছে ।
আমিতো বাসায় এসে মাথায় হাত । আম্মাকে পুরা ঘটনা বলতেই সেতো হেসেই খুন । আম্মা বল্লো কালকে অবশ্যই যেয়ে মালুর মাথা ঠান্ডা করে আসবি, তানা হলে বাসার সবার জুতা নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে । যাইহোক পরদিন আমাকে দেখেই তার একমুখ হাসি আমাকে সত্যিই ভীষন আনন্দ দিয়েছিলো ।
আসলে ইট পাথরের শহরে ধনী-গরিব মুর্খ অথবা শিক্ষিত সবাই আমরা সজিব প্রানের কাছেই বুঝি ছুটে বেড়াই । এতটুকু যদি তা পাই কেউ তা ছাড়ি না । যেমন ছারেনি মালু .... তার সব নতুন নতুন গল্প আর সপ্নের কথা শুনতে শুনতেই ৪ ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছিলো।
এরই মাঝে নিখিল তার আরেক ভাতিজা রাখাল কে ঢাকায় নিয়ে এলো । এটা আর শুটকা পাতলা নয় ।
গায়ে গতরে যথেষ্ট ভালো । তার বয়স যখন ১৭ তথন একদিন নিখিল আর মালু আমার আব্বার কাছে আসলো । উদ্দ্যেশ্য , রাখালকে বিদেশে পাঠানোর জন্য কিছু সাহায্য করা। আব্বা বলে দিলেন কিছু দেয়া যাবে ব্যাবস্হা করো । আমাকে ও দিতে বলা হলো কারন আমি তখন নতুন চাকরিতে ঢুকেছি ।
রাখালের বিদেশ যাওয়ার ব্যাবস্হা হতে হতে প্রায় ২ বছর লেগে গেলো । সালটা ২০০২ অক্টোবরে রাখালের ফ্লাইট ঠিক হলো । রাখাল মনোহরদি গেলো তার দুরের আত্বীয়দের কাছে বিদায় নিতে । এদিকে চাচা নিখিল এতিম ভাতিজার জন্য নতুন শার্ট কিনলো মালু তার ভাইয়ের জন্য প্যান্ট কিনলো । ছোট ভাইটা বিদেশ যাবে , তাদের চাচা ভাতিজার সংসার টায় অনেক স্বপ্ন তা তারা একে একে পুরন করবে ।
এমনি সময় মনোহরদি থেকে জরুরি ফোন আসলো রাখাল অসুস্হ ..... পাগলের মতোন ছুটে যায় নিখিল আর মালু কিন্তু ততক্ষনে রাখাল চেপে বসেছে অজানা অন্যকোনো দেশের বিমানে ।
এরপর থেকে নিখিল ও মালুর জীবন থেকে যেনো সব হাসি মিছে গেছে ...... নিখিলের জীবনে আরেকটা শক ছিলো তার পরের বছরেই আমার বড় মামার মৃত্যু । যা তার জীবনে বেশি বড় আঘাত হয়ে আসে ।
আমি ও জীবন যুদ্ধে নেমে তাদের বেশি খোজ খবর করতে পারি না । শুনেছি মালু এখন টেম্পু চালায় ..... নিখিল ধরে আছে তার পৈত্রিক পেশা ।
কিন্তু তারা রেখে গেছে আমার জীবনে কিছু ভালোবাসার ছাপ যা আসলে মানুষকে মানুষ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে যুগে যুগে ।
আমি নিখিলকে চিনি প্রায় ২২ বছর । গতকাল হঠাৎ নিখিলের পরিবারের কথা মনে পরাতে সবার সাথে শেয়ার করলাম ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।