বিকট
*
"আমাদের দেশেও রয়েছে উন্নতমানের এক্সপোর্ট কোয়ালিটি সাইকো। কিন্তু প্রচারের অভাবে পিছিয়ে রয়েছি আমরা। পশ্চিমা বিশ্বে কেউ শটগান দিয়ে গুলি করে কিছু বাচ্চাকাচ্চা মেরে ফেললে, অথবা ধারাবাহিক খুনযজ্ঞের সাথে জড়িত হলে প্রচারমাধ্যম তাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কিন্তু আমরা, বাংলাদেশী সাইকোরা, এর চেয়ে সুন্দর কাজ দেখিয়েও থেকে যাই নিভৃতে। "
এটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আমাদের নবগঠিত সংগঠন "নিখিল বাংলাদেশ সাইকো সমিতি"র প্রতিষ্ঠাতা সালাউদ্দীন খাঁ।
আমরা তার দীর্ঘশ্বাসের সাথে একাত্মতা জানিয়ে নীরবতা পালন করলাম। আমাদের মৌন সমর্থন পেয়ে তিনি বলে চলেন,
"হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমাদের দেশে এখনও আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন সিরিয়াল কিলার তৈরি হয়নি। যার কারণে সাইকোমিটারে আমাদের কাঁটাটা নিচের দিকেই থাকে। তবে এটা সকলকেই বুঝতে হবে যে, সকল দেশের অপরাধ মনস্তত্ব এক না। আর এখানে অপরাধই বা বলছি কেন! সাইকোইজম একটা আর্ট।
এটা তো চুরি-ডাকাতি, জমিজমার জন্যে খুনের মত ছ্যাচরা ফৌজদারী অপরাধ না! সকল সাইকোই অপরাধী, তবে সকল অপরাধী সাইকো না। তো যা বলছিলাম, সাইকো মনস্তত্ব এবং তার দেশভেদে তার প্রায়োগিক বৈচিত্রতার কথা। পশ্চিমা দেশগুলোতে সাইকো কালচার ডিফারেন্ট। সেখানে সিরিয়াল কিলিং একটি নিয়মিত চর্চিত ব্যাপার। কিন্তু সিরিয়াল কিলাররাই সাইকো জগতের দায়ভার কাঁধে নিয়েছে ব্যাপারটা তো এমন না! হ্যাঁ, এটা স্বীকার করি যে সাইকো স্বত্তাকে ভেরিফাইড করার জন্যে সেটা একটা উৎকৃষ্ট পন্থা, কিন্তু একমাত্র না।
পশ্চিমা দেশের অন্ধ অনুকরণ না করে আমরা বরং নিজেদের স্বকীয়তায় অনড় থাকলেই লাভবান হব। তবে জনপ্রিয় বৈশ্বিক সংস্কৃতিকে তো একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না, আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিক মানের সিরিয়াল কিলার তৈরির ব্যাপারে কিছু কর্মশালার আয়োজন করব"
বক্তব্যের এ পর্যায়ে আমরা আনন্দিত হয়ে তুমুল করতালি দিতে থাকি। সালাহউদ্দীন খাঁ সন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হবার প্রাথমিক পর্যায়ে উপনীত হওয়া গেছে। বেশ কিছু অভিজ্ঞ এবং সম্ভাবনাময় সাইকোপ্যাথের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এই সংগঠনটি।
আমাদের লক্ষ্য,
১/ সারাদেশে সাইকোপ্যাথদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা।
২/ সরকারি চাকরিতে এবং শিক্ষাঙ্গনে সাইকোপ্যাথ এবং তাদের সন্তানদের জন্যে কোটা পদ্ধতি চালুর জন্যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা।
৩/ বিদেশি সাইকোপ্যাথদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগের ব্যবস্থা করে নিজেদের দক্ষতাকে শাণিত করে তোলা।
৪/ সুবিধাবঞ্চিত সাইকোপ্যাথদের জন্যে মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করা।
আপাতত এই কটাই।
আরো কিছু যোগ করা হবে আমাদের মিটিং শেষে। আজকের অনুষ্ঠানটি নিয়ে আমি খুব এক্সাইটেড। এতদিন যাদের মত হবার স্বপ্ন দেখেছি তাদের অনেকেই আমার চোখের সামনে! তারা সাইকো রোডম্যাপ সংক্রান্ত দিকনির্দেশনা দেবেন। নিজেদের অভিজ্ঞতা বয়ান করবেন। আমাদের মত নবাগত সাইকোদেরও নিশ্চয়ই কিছু বলতে দেবেন।
সেই সুযোগটা পেলে হয়! এই মুহূর্তে সালাহউদ্দীন খাঁ গতমাসের সাইকো বিবরণী পড়ে শোনাচ্ছেন। খুব ডিটেইলড এবং নিট একটা কাজ হয়েছে। সংগঠনের প্রতি তার দায়বদ্ধতা এবং ডেডিকেশন (ডেডিকেশন শব্দটার মধ্যে কিন্তু একটা মজা আছে! একমাত্র সাইকো মনই তা ধরতে পারবে। ডেডিকেশন-ডেড ইকুয়েশন, ক্লোজ এনাফ!" মাসিক সাইকো বিবরণীতে পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত মোটামুটি সবগুলো সাইকোকর্মই তুলে ধরা হয়েছে। কয়েকজন মিলে কুপিয়ে একজনকে মারা, স্ত্রী পরীক্ষা দিতে চাওয়ায় হাত কেটে দেয়া, বালিকাকে তুলে নিয়ে গিয়ে আড়াইমাস ধরে ধর্ষণ- কে বলে আমরা পিছিয়ে আছি! কে বলে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ! গর্বে আমার বুক ভরে উঠল।
প্রকাশিত সংবাদের পাশাপাশি তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু ঘটনা সংগ্রহ করেছেন। সেগুলো আরো সুন্দর। আরো একবার তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে আসে। অভিজ্ঞতা বর্ণন শুরু হল কেবল। তিনি তার সুদীর্ঘ কর্মজীবনের কথা বলতে শুরু করলে চোখদুটো খুনরঙা জোছনার আলোয় রক্তিম এবং স্বপ্নীল হয়ে ওঠে।
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যাই! তিনি বংশ পরম্পরায় সাইকো। খুন, ধর্ষণ, পেডোফিলিয়া, সমকাম কোনটা তিনি করতে বাকি রেখেছেন! মানুষ প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে খুন, ধর্ষণ করতেই পারে! কিন্তু কজন পারে এগুলো ক্রমাগত করে যেতে এবং যত্নের সাথে স্মৃতির শোকেসে সাজিয়ে রাখতে? কজন পারে অনুশোচনা, বিবেক নামক হাস্যকর অনুভূতিগুলোর কাছে আত্মসমর্পণ না করে তৃপ্তকন্ঠে নিজের কৃতকর্ম সদর্পে বলে যেতে? কজন পারে?
"এবার আমি আহবান করব তরুণদের মধ্যে কেউ এসে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলার জন্যে। কেউ কি আছে, আগ্রহী?"
বেশ কটা হাত উঠলো। এবং কী সৌভাগ্য! আমাদের মহান প্রতিষ্ঠাতা এবং নেতা আমার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে ইঙ্গিত দিলেন স্টেজে উঠে আসতে। আমি উল্লাসে "ইয়েহ!" জাতীয় একটা শব্দ করে স্টেজে উঠে গেলাম।
এর আগেও স্টেজে উঠতে হয়েছে আবৃত্তি করার জন্যে। সেবার তো একদম হাঁটু কাঁপাকাঁপি অবস্থা ছিলো! এবার মোটেই সেরকম না। আমি দ্রুত স্টেজে উঠে গিয়ে আনন্দমিশ্রিত কম্পিত কন্ঠে বলা শুরু করলাম,
"অনুষ্ঠানে উপস্থিত সুধী সাইকোসমাজ, আপনাদের সাথে এক হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমার নাম জিমি। জানি না আপনাদের সাথে কথা বলার যোগ্যতা এখনও অর্জন করতে পেরেছি কী না।
আমি অতি সামান্য এক সাইকো। তবে স্বপ্ন আমার আকাশছোঁয়া। একদিন আমিও হয়তোবা হতে পারবো ইউক্রেনিয়ান সাইকো লিজেন্ড Dnepropetrovsk ম্যানিয়াকসদের মত কেউ। পুরো পৃথিবী জানবে আমার কথা, আমার দেশের কথা!"
সবাই তালি দিয়ে আমার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বক্তব্যকে স্বাগত জানায়। সেইসাথে কিছুটা তাগাদাও দেয় যেন গৌরচন্দ্রিকা সংক্ষেপ করে মূল বক্তব্য শুরু করি।
তাদের আগ্রহের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি আমার বক্তব্যের মূল অংশে চলে যাই।
"বলার মত তেমন কিছু এখনও করি নি। অতি সাধারণ এক সাইকো আমি। তবে কিছু তো করেছি বটে! নইলে এই মহতী সম্মেলনে আমার জায়গা হয়! আমার বয়স যখন তের, তখন আমি মাঝেমধ্যেই একটা কাজ করতাম। আমাদের বাসায় বেড়াতে আসা বিরক্তিকর ছোটখালার গ্যাদা বাচ্চাটা ঘুমিয়ে গেলে, আশেপাশে কেউ না থাকলে তার নাক চেপে ধরতাম।
নিঃশ্বাস নিতে না পেরে ছটফট করত কিছুক্ষণ। তারপর ভ্যা করে কান্না শুরু করে দিত। ছোটখালা হয়তো তখন গোসলে। বাসার সবাই ভাতঘুমে। তারপর কী যে একটা হুড়োহুড়ি লাগতো না! ততক্ষণে আমি আমার রুমে গিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছি! পনের বছর বয়স পর্যন্ত এরকম টুকটাক নগন্য সাইকো কাজকর্ম করে হাত পাকিয়েছি।
এখন আমার বয়স আঠার। গত তিনবছরে আমি বাসের মধ্যে অন্তত ৫০ জন মেয়ের পিঠে পিন ফুঁটিয়েছি, নেশার মত হয়ে গেছে এটা। এবং দারুণ দক্ষতাও অর্জন করেছি!"
শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্যে আমি একটু বিরতি দিই। যা ভেবেছিলাম তাই! কারো ভেতর কোন চাঞ্চল্য দেখে যায়না। কারো কারো ঠোঁটে অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য এবং বিরক্তি মিশ্রিত হাসি।
"আমি বুঝতে পেরেছি আপনারা আমার গল্পের সূচনায় যতটা আশান্বিত হয়েছিলেন, সর্বশেষ পরিণতিতে সেই আশাটা কিছুটা হলেও হতাশায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু স্যার, গল্প এখনও শেষ হয়নি। আমি কিছুদিন আগে কি করেছি জানেন? একজন দুর্বলচিত্তের হার্টের রোগীকে মওকামত পেয়ে ইউক্রেনিয়ান ম্যানিয়াকদের সেই ভিডিও ফুটেজটা তার কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে টানা একঘন্টা যাবৎ দেখিয়েছি। ফলাফল যা হবার তাই! ওখানেই হার্ট এ্যাটাক করে মৃত্যু!"
এবার সবাই আস্থা ফিরে পায় আমার প্রতি। হাততালির পাশাপাশি উৎসাহব্যঞ্জক কিছু শব্দও খরচ করে তারা আমার জন্যে।
স্বয়ং আমাদের প্রতিষ্ঠাতা এসে আমার পিঠ চাপড়ে দেন। গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে। এ সংগঠনের ভেতর যে একাত্মতা দেখছি, তা আমাদের অনেক দূর নিয়ে যাবে। "নিখিল বাংলাদেশ সাইকো সমিতি" দেশের মুখ উজ্জ্বল করবেই। চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে আমি স্টেজ থেকে নেমে যাই।
মধ্যাহ্নবিরতির পরে আবার নতুন করে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। সাখাঁ ভাই যথারীতি চমৎকার দক্ষতায় সব তদারক করতে থাকেন। তার দ্বিতীয় বক্তৃতা শুরু হল কেবল। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য। সংগঠনের ভবিষ্যত রূপরেখার বৃহদাংশই এখান থেকে উৎপন্ন হবে।
"আমাদের প্রথম কাজ হবে সংগঠনের একটা ভৌত কাঠামো তৈরি করা। আমাদের নিজস্ব অফিস থাকবে সরকারী সনদপ্রাপ্ত। অফিসের কাজের জন্যে অনেক লোক দরকার হবে। আমাদের এখান থেকে অনেকেই যোগদান করবেন, এছাড়া কাগজে এবং অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়েও লোক নেয়া হবে। অফিসের ভবনটি হবে আমাদের নিজস্ব।
কোন ভাড়া করা দালান না। এ অনেক খরচান্ত ব্যাপার। তবে আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের মধ্যে সাইকোর অভাব নেই। তারা আমাদের সবরকম সাহায্য করবেন স্বতপ্রণোদিত হয়েই, এ আশা অমূলক নয়।
বিরোধীদলের নেতারাও এ ইস্যুতে অন্তত সরকারের বিরুদ্ধচারণ করবে না, এটা জোর দিয়ে বলা যায়। একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছেন কী?"
সবাই উৎকর্ণ হয়ে থাকে কোন ব্যাপার সেটা জানার জন্যে। সাখাঁ ভাই তখন নিজের কন্ঠে ভর করা দুর্দমনীয় আবেগ সামলাতে ব্যস্ত। আমরা তাকে সময় দিই নিজেকে সামলে নেবার জন্যে। খুব বেশি সময় তিনি নেন না।
আবেগঘন কন্ঠে বলেন,
"এই আমরা, শুধুমাত্র আমরা সাইকোরাই পারি কোন ইস্যুতে সরকার এবং বিরোধীদলকে এক করতে। সাইকোবিহীন রাজনীতি কে কবে চিন্তা করতে পেরেছে? বিশেষ করে বানংলাদেশে? আজকালকার ছেলেমেয়েরা রাজনীতিবিমুখ। তারা ফেসবুকে "আই হেইট পলিটিক্স" বলে রাজনীতিকে এড়িয়ে গিয়ে ঢুলুঢুলু চোখে সারারাত লুতুপুতু গল্পে মজে থাকে। অথচ রাজনীতিই দেশের চালিকাশক্তি। আর তরুণেরা রাজনীতিতে না এলে দেশের সমৃদ্ধি হবে কী করে? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাইকোইজমের গুরুত্বটা এখন বুঝতে পারছেন? আপনি ভাবছেন আপনি অগুরূত্বপূর্ণ কেউ।
অবসর সময়ে কিছু খুন টুন করে, রক্ত ঝরিয়ে, বা অন্য কোন সৃজনশীল অপরাধী উপায়ে নিজের মনের খোরাক মেটান। আপনি বিচ্ছিন্ন। অবহেলিত। এমন কী ঘৃণিত! অথচ আপনার ভেতর যে উচ্চতর অপরাধ দর্শন এবং নিস্পৃহতা রয়েছে, তার সাথে আমাদের দেশ পরিচালনাকারীদের মনস্তত্ত্বের অনেক মিল। তাই তো তারা একটা ভবন ধ্বসের ঘটনায় হাজারখানেক মানুষ মারা গেলেও নিস্পৃহ থেকে উচ্ছল হাসি দিয়ে ফটোসেশন করতে পারেন, অসার ঝাঁকুনি তত্ত্ব দিয়ে রসিকতা করে টেনশনটা নিউট্রালাইজ করার চেষ্টা করতে পারেন।
তাই তো তারা লঞ্চডুবিতে মানুষ মারা গেলে ছাগল পালনের প্রতিশ্রূতি দিয়ে পুরো জাতির সাথে ট্রোলিং করতে পারেন। দেশ চালাতে হলে এরকম করতে হয়। চাপাতির কোপে মৃত লাশকে রাস্তায় রেখে দু পাশ থেকে তারা হ্যাঁচকা টান দিতে পারেন নিজেদের স্বার্থে। দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এসব করতে হয়। এসব করতে জানতে হয়।
আমাদের ভেতর এসব গুণাবলী বেশ ভালোভাবেই বিদ্যমান। তাহলে আমরা কেন পারবো না দেশের উন্নয়নের স্বার্থে আমাদের মাঝে বিরাজমান নির্বিকার খুনী স্বত্তাকে শাসনযন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত করে এই ধারাকে আরো বেগবান করতে? আর যদি তা পেরে থাকি, আমরা কেন বিশেষ সুবিধে চাইবো না? কেন চাকুরিতে আমাদের জন্যে কোটা থাকবে না? কেন অবহেলিত দুঃখী সাইকোপ্যাথেরা মাসিক ভাতা পাবে না? বন্ধুগন! অনেক হয়েছে নিভৃতযাপন। এবার অধিকার বুঝে নেবার সময়। আমাদের মাঠে নামতে হবে। আপনারা সাথ থাকছেন তো?"
দমবন্ধ করে শুনছিলাম আমি।
উত্তেজনায় ঠোঁট কামড়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলেছি। এত চমৎকার করে বলতে পারে কেউ? কে পারে এভাবে উদ্দীপ্ত করে তুলতে? হীনমন্যতায় ভোগা একজন কিশোর সাইকোর অন্তর্গত শক্তিকে এভাবে জাগিয়ে তুলতে কজন পারে! শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত এখন এ প্রাঙ্গন। খুব বেশি মানুষ না, কিন্তু শব্দের জোর সুস্পষ্টভাবে আমাদের প্রানশক্তির কথা জানিয়ে দিচ্ছে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে। স্বপ্নালু চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুকে নিয়ে আমি সমাবেশস্থল ছেড়ে যাই।
*
সাখাঁ ভাই কাজের মানুষ।
ফাঁকা বুলি আওড়ান না। অল্প সময়ের ভেতরেই তার প্রতিশ্রূত "সাইকো ভবন" গড়ে তুললেন সরকারী অনুদানে। বিরোধী দলও সরকারের এ কর্মকান্ডকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। দেশাত্মবোধের চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে আমাদের কর্মস্পৃহা বেড়ে গেছে শতগুণ। আমি একটা চাকরী পেয়েছি সাইকো ভবনে।
কাজ টাজ তেমন কিছু না, দেশের সাম্প্রতিক সাইকো কাজকর্ম নিয়ে ডাটাবেজ বানানো। আমি একা করি না, আমাদের প্রায় দশজনের একটা দল আছে। প্রচুর শ্রম দিতে হয়, তবে কাজটাকে ভালোবাসি। সাইকো ভবনে কাজ করার বাসনায় অনেকেই সিভি পাঠায়। সেগুলো গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তায় মাঝেমধ্যে।
কয়েকজনের সিভি দেখে হাসি পায়! প্র্যানকটিকাল এক্সপেরিয়েন্সের জায়গায় লেখা থাকে ওয়ান মার্ডার বা ব্রুটাল গ্যাংরেপ। ডিটেইলসে গেলে দেখা যায় এগুলোর বেশিরভাগই মাদকতাড়িত অথবা ব্যক্তিগত শত্রুতার জন্যে। এগুলো তো সাইকো কর্মকান্ড না! এগুলো রীতিমত ক্রাইম। এসব মাদকাসক্ত দুনিয়াদারী সর্বস্ব ক্রিমিনালকে ধরিয়ে দেয়া আমাদের নৈতিক কর্তব্য। তাদের ইনফরমেশন আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে পাঠিয়ে দিই।
কত বোকা লোকজন এভাবে ধরা খেয়ে যাচ্ছে আমাদের কাছে! দেশের উপকারে এভাবেই কাজ করে যাচ্ছে নিখিল বাংলাদেশ সাইকো সমিতি। হুহ, সাইকো হতে চায় ক্রিমিনালগুলো! সাইকো হওয়া যেন ছেলের হাতের মোয়া! ভালো করে খুঁজে-ঘেঁটে দেখলে এদের মধ্যে এমনও অনেককে পাওয়া যাবে যারা জবরদস্ত কোন সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হলে অনুশোচনায় ভুগে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে থাকবে! বিরক্তিকর ব্যাপার স্যাপার!
সরকারের আনুকূল্য এবং দয়াদাক্ষিণ্য প্রদান অব্যাহত রয়েছে। তাই কৃতজ্ঞতাবশত আমাদের মাঝেমধ্যে অফিসটাইম শেষে বাড়তি কিছু সরকারী কাজকর্ম করতে হয়। হয়তোবা একটা বস্তি উচ্ছেদ করে গার্মেন্টস বানানোর প্ল্যান আছে কোন সরকারী চামুন্ডার। বস্তিটায় আগুন জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।
তা এ কাজ তো কিছু টাকা দিলে গুন্ডা-বদমাশরাও করে দিতে পারে! আমাদের তলব করা কেন? গুন্ডা-বদমাশদের সাথে আমাদের পার্থক্য আছে বলেই না ডাকা হয়! তারা তা করে জীবিকার তাগিদে, আর আমরা করি মনের আনন্দে। পুড়ে কাবাব হয়ে যাওয়া হাড়গিলে শরীরের মৃত্যুপূর্ব চিৎকার অথবা নাক থেকে অবিরত সিকনি ঝরানো নোংরা বাচ্চাটার আকূল আর্তনাদ আমাদের মত করে কে আর পারে উপভোগ করতে?
বিরোধী দলের কাজও করে দিই আমরা। হরতালের আগের রাতে কিছু গাড়ি পোড়ানোটা অত্যাবশ্যক। সেইসাথে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া মানুষ পেলে তো কথাই নেই! আমরা খুব আগ্রহের সাথে ভরা বাস থামিয়ে কাউকে বের হবার সুযোগ না দিয়ে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারি, আর দেখি কার বোমায় কয়জন পড়ল! খুবই চিত্তাকর্ষক ব্যাপার।
*
ইদানিং অফিসের কাজে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে আমার নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা একদমই হয়ে ওঠে না।
সমষ্টিগত ভাবে অবশ্য সাইকো কার্যক্রম চলছে, তবে ওগুলো তো ফরমায়েশী কাজ। ওখানে কোন সৃজনশীলতা নেই। কতদিন ধরে ভাবছি পাশের বাসার মেয়েটাকে একদিন ধরে এনে একটু কড়কে দেব। কড়কে দেয়া মানে গলা চেপে ধরে ধর্ষণ করে ফেলা না। ওগুলো ক্রিমিনালদের কাজ।
আমার চিন্তাধারা অন্য। ভাবছি তাকে আমাদের বিশাল বাসার পরিত্যক্ত কোন রুমে ধরে নিয়ে গিয়ে আঁটকে রাখব চোখ বাঁধা অবস্থায় মাসখানেক। রুমটা হবে সাউন্ডপ্রুফ। সারাদিন সারারাত উচ্চ ভলিউমে Naked city'র স্ক্রিমার গান Bonehead চলতে থাকবে। এখানে উল্লেখ্য, মেয়েটি আবার বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত অনুরাগী।
আমি তার পায়জামার ভেতর ইঁদুর ঢুকিয়ে দিয়ে মজা দেখব। এরপর না হয় ধর্ষণ করা যেতে পারে। কিন্তু মেয়েটাকে বাগে পাওয়া যাচ্ছে না কোনভাবেই। কী যে করি! তুলে নিয়ে এসে রেপ করে ফেলব নাকি? নাহ সেটা ক্রাইম হয়ে যাবে। আমাদের সরকার এটা পছন্দ নাও করতে পারে।
গত কয়েকমাসের কর্ম অভিজ্ঞতা আমাক দেশ পরিচালনার খুঁটিনাটি কাছ থেকে দেখতে সাহায্য করেছে। তাই আমি এখন কোনকিছু করার আগে এর সাথে দেশের সংশ্লিষ্টতা ভাবি। কিন্তু এভাবে আর কত নিজেকে প্রবোধ দেয়া যায়! কী একখানা মেয়ে! আবার চোরাচোখে তাকায়! আবার ফ্লার্ট করে! ঠিক আছে দাঁড়াও, তোমার ফ্লার্ট করা বের করছি! আমি আমার সহকর্মী কয়েকজনকে ফোন দেই। ব্যাপারটার সাইকোকরণ করা দরকার। একা ফাঁকা পেয়ে আমি একজন মেয়েকে রেপ করে বসতেই পারি! সেটা একটা জঘন্য অপরাধ।
কিন্তু দশজন মিলে গ্যাংরেপ করে ফেললে এবং অনাবশ্যক টর্চার করলে সেটা আর সাধারণ অপরাধ থাকবে না। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের সঙ্গম করতে যে খুব ইচ্ছে করছে তা না, আমরা ঘৃণ্য নেশাদ্রব্য দ্বারাও তাড়িত নই। আমরা এই একটু হাত মকশো করার জন্যে একটা গ্যাংরেপ করব। আমার বন্ধুরা আসতে শুরু করে একের পর এক। দশজন সর্বমোট।
আমাদের বিশাল আলিশান বাসায় একটা ফাঁকা কোণ খুঁজে নেয়া কোন কঠিন ব্যাপার না। এখন শুধু মেয়েটাকে পটিয়ে আমাদের বাসায় নিয়ে আসা! আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে তার দিকে আধা কামুক হাসির তীর ছুড়ে দিই। সেও দেয় পাল্টা। তার সাথে আমার কথা হয় প্রায়ই। বাসায়ও এসেছিলো কয়েকবার।
-নতুন হোম থিয়েটার কিনেছি। মুভি দেখবা?
-তাই নাকি! কী মুভি?
-ভিজুয়্যাল এফেক্ট সমৃদ্ধ কোন মুভি হলে বেশ ভালো হয়। লাইফ অফ পাই দেখা যেতে পারে। কী বল?
-ইস! আছে তোমার কাছে? আমার খুবই ইচ্ছা এটা দেখার। এক মিনিট দাঁড়াও, এখনই আসছি!
তারপর দশজন সরকারী কর্মচারী কর্তৃক একজন সপ্তাদশী নির্যাতিত এবং ধর্ষিত।
বারবার বারেবার! পালাক্রমে। তবে এটার বর্ণনা দেয়া ঠিক হবে না। অশ্লীল হয়ে যাবে। যৌনকর্মের বর্ণনা দিয়ে অশ্লীলতা নিরোধক আইনে ফেঁসে যাই আর কী! ওটা হচ্ছে না। আমরা আইন মেনে চলা সুনাগরিক।
*
অফিসে তুমুল হট্টগোল চলছে। আমাদের বস ক্ষেপে আগুন হয়ে গেছেন। আমাদের দশজনকে সামনে পেয়ে সমানে ঝাড়ছেন।
-তোমরা এটা কী করেছ? শেষপর্যন্ত ছিচকে ধর্ষকদের কাতারে নেমে গেলে! ছি ছি ছি!
-স্যার...আমরা শুধুমাত্র ধর্ষণ করিনি, অনাবশ্যক টর্চারও করেছি। আর এটা স্রেফ কামনা মেটানোর ব্যাপার ছিলো না।
নিভৃতে একটু ব্যক্তিগত সাইকোচর্চা...
-চুউউপ!
তার সিংহগর্জনের সামনে আমরা একেবারে চিমসে চুপসে যাই।
-খুব বড় বড় কথা শিখে গেছো, তাই না? আমাদের রেপুটেশন একদম মাঠে মারা যাবে। তোমাদের নামে কেস করে দিয়েছে। এবং স্পষ্টতই এটা ধর্ষণের কেস। এটা অপরাধ।
নিম্নমানের কাঁচা অপরাধ। এটাকে তোমরা উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে পারো নি। তোমরা আইন মেনে চলা সুনাগরিক, যাও এখন জেল খাটো। আচ্ছা, সাধারণ ধর্ষণ আর সাইকো ধর্ষণের পার্থক্যটা ভুলে গেছ তোমরা?
-আমরা তো সব ঠিকঠাক মতই করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু...
আমার আরো কিছু বলার ছিলো, কিন্তু বাঁধা পড়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত মিডিয়া সেলের সম্মানিত প্রধান সুন্নী মাহার কন্ঠে। তার নিয়োগ নিয়ে আমাদের মধ্যে অসন্তোষ ছিলো।
কারণ তার ভেতর কোন সাইকো উপাদান খুঁজে পাইনি আমরা। তারপরেও তিনি মিডিয়া সেলের প্রধান তাও আবার ফুলটাইম জব করেন না, অনারারি পদ। কিন্তু আমাদের বস সালাউদ্দীন খাঁ ওরফে সাখাঁ কোন কাঁচা কাজ করেন না। সুন্নী মাহার কথায় আমাদের ভুল ভাঙে,
-আরে অত টেনশনের কী আছে! বলে দিলেই হবে যে মেয়েটা সেক্সি ড্রেস পরে ঘোরাফেরা করছিলো। পরিমলের কেসে এরকম বলেছি তো আমি।
একটা রিপোর্ট বানায়ে দেবো নে। টেনশনের কিছু নাই।
ছোট্ট কয়েকটা বাক্য, অথচ কী ভীষণ শক্তিশালী! এই বাক্যগুলোর ভেতর আছে ভিকটিমের তথাকথিত যন্ত্রণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান নির্বিকার সাইকো উপেক্ষা। ধর্ষিত হবার অবদমিত আকাঙ্খা। আর কী চাই! সাইকো হতে সবসময় যে ভায়োলেন্স করতে হবে তা না।
সেটাকে উপভোগ করার স্পোর্টিং মানসিকতাও থাকতে হবে। হ্যাটস অফ সুন্নী মাহা! ইউ আর আ রিয়্যাল সাইকো!
*
কিছু পজিটিভ রিপোর্ট এবং মুদ্রা চালাচালি এবং তোষামোদের পর ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেলে নিখিল বাংলাদেশ সাইকো সমিতির কাজকর্ম আবার জোরেসোরে শুরু হয়। পত্রিকায় আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ছাপা হয়।
"সাইকো হোন, দেশ গড়ুন"
"সাইকো সমিতিতে যোগ দিয়ে জনগণ এবং সরকারের মেলবন্ধনকে দৃঢ় করুন"
বিডিজবসে টপরেটেড জবের জায়গায় আমাদের প্রতিষ্ঠান থাকবেই সবসময়।
অফিসে সম্প্রতি একজন তরুণীকে নেয়া হয়েছে।
কাজকর্ম তেমন কিছু পারে না। তাই সারাদিন বসে বসে সেলাই করে। সেলাই করে সে একটা অদ্ভুত সূচিকর্ম তৈরি করেছে। সরকার এবং বিরোধীদলকে দাবা বোর্ডের সাদা রাজা আর কালো রাজা বানিয়েছে আর মাঝখানে আমাদের সাইকো সমিতিকে উভয়দলীয় লাল রঙা মন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করে সংযোগ করেছে সূতো দিয়ে। বেশ বানিয়েছে।
টানলে ছেড়ে না। মেঝেতে কিছু ভাঙাচোরা সৈন্য পড়ে ছিল। তার হাতে ওগুলো তুলে দিয়ে বললাম,
-এগুলোও কাজে লাগাতে পারো। এগুলো হল, উমম... মনে কর জনগণ।
-দরকার নেই।
সে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে আবার কী যেন বোনা শুরু করে। আমারও তাই মনে হয়। দরকার নেই তাদের। আমিও কাজে ডুবে যাই।
নিখিল বাংলাদেশ সাইকো সমিতি অভীষ্ঠ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে দুর্বার গতিতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।