আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাংস্কৃতিক পরিবর্তনই অন্ধকার কাটাবে

তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি তিনি। একই সঙ্গে আত্মপ্রত্যয়ী একজন নারী। রাজনীতি-সচেতন। ফেনীর মেয়ে, যদিও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তিনি লাকী আক্তার।

শাহবাগ গণজাগরণে নেতৃত্বে ছিলেন। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা। বিজয়ের মাসে এই তরুণের কাছে জানতে চাই দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, নারী বিষয় নিয়ে তাঁর ভাবনা ও স্বপ্নের কথা। ব্যক্তিগত জীবনের নানা তথ্যও জানালেন। ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয়ে কথা হলো লাকী আক্তারের সঙ্গে।

 

রাজনীতিতে এলেন কীভাবে?
আমি রাজনীতিতে এসেছি ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ২০০৯ সাল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তখন আবাসিক হলের আন্দোলন, বর্ধিত ফি প্রত্যাহার, ক্যাফেটেরিয়ার খাবার মানসম্পন্ন করা, উন্নয়ন ফি তিন হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা করার বিরোধী আন্দোলন করেছি। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনও করেছি। এরপর ২০১১ সালে আমি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হই।

এর আগে সব আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে থেকেছি। আমার বাবাও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে, তারও একটা বড় প্রভাব আছে আমার মধ্যে।

অনেক শিক্ষার্থী রাজনীতিতে আসার কথা ভাবলেও আসেন না। কিন্তু আপনি ছাত্র আন্দোলন থেকে ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেন কেন?
শুরুতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে ছাত্র আন্দোলন করতাম।

পরে একটা সময়ে মনে হলো, আন্দোলনকে ধারণ করার জন্য ছাত্ররাজনীতি করা প্রয়োজন। আমি নিজেকে দিয়েই বুঝেছি। যেমন ধরুন, ২০০৯ সালে আমি যেভাবে কোনো কিছু বিশ্লেষণ করতাম বা দিকনির্দেশনা দিতাম, ২০১১ সালে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর দেখলাম, আমার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বেড়েছে। রাজনীতির বিষয়ে একটা কথা বলার আছে।

কী সেই কথা?
অনেকে মনে করেন, বর্তমান সময়ে মেধাবী ও ভালো ছাত্ররা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন না।

এখনো বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নে মেধাবী ছাত্ররাই ভিড় করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে আমার ব্যাচে আমি সর্বোচ্চ সিজিপিএর অধিকারী। শাহবাগ আন্দোলনের কারণে সে সময় স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তবে আশা করছি, আমি এই ফল ধরে রাখতে পারব। বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করার কারণে গত বছর যে আটজন ছাত্রনেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে আমিও ছিলাম।



মেধাবীরা কেন এখনকার রাজনীতিতে আসছেন না?
এর জন্য মেধাবীদের দোষ দেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে সন্ত্রাস, লুটপাট ও আদর্শহীনতায় আচ্ছন্ন। নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সময়েই শিক্ষাঙ্গন থেকে গণতন্ত্র চর্চার কেন্দ্র ছাত্র সংসদ উধাও। সব কটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো, তাহলেও দেখতেন, অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে আসছেন রাজনীতিতে। তবে কেউ কেউ বিরাজনীতিকীকরণের দিকে ছাত্রদের ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার অবস্থা।

তার মানে কি আপনি হতাশ?

একদমই না। এ সময়ের তরুণদের নিয়ে আগে অনেক নেতিবাচক কথা শুনেছি। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনে তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ততাই বলে দিয়েছে, তাঁরা এখনো ফুরিয়ে যাননি। রাজনীতির দুর্যোগ মোকাবিলায় ছাত্র-তরুণেরাই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবেন।

বাংলাদেশ নিয়ে আপনার কী ভাবনা?

১৯৭১ সালের আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু আমরা দেখেছি, আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে যারা ছিল, তারা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে নিজেদের বিস্তার ভয়ালভাবে ঘটিয়েছে। এখন চাওয়া হলো, আবার স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হোক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চাই।

আর এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন না এলে আমরা অন্ধকারেই থেকে যাব। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের হাতিয়ারই হচ্ছে রাজনীতি।

রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধদলীয় নেতার কাছে আপনার কী চাওয়া?

এখানে আমার বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। এ সময়ে দেশে যে সংকট, সহিংসতার সৃষ্টি হয়েছে, মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে, সবই কিন্তু তাঁদের ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই। কিন্তু আমার চাওয়া হলো, পাঁচ বছর পর পর নির্বাচনের সময়ের জন্য সব গণতান্ত্রিক দল মিলে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি যেন খুঁজে বের করে, যা সব দলই মেনে চলবে।

কিন্তু এখানে জামায়াতকে সম্পৃক্ত করা যাবে না। আমি মনে করি, জামায়াত কোনো রাজনৈতিক দল নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে তারা একটি অবৈধ দল। অবৈধ উপায়ে তাদের রাজনীতি করতে দেওয়া হচ্ছে। আর আন্দোলন হতে হবে আন্দোলনের মতো।

এর নামে দেশের মানুষ ও সম্পদের ক্ষতি করা যাবে না। সহিংসতার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। সহিংসতার রাজনীতি জামায়াত-শিবিরকে শক্তিশালী করছে।

দেশ এখন রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে। একজন তরুণ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আপনার কী মনে হয়? এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী?

আমি মনে করি, একতরফা নির্বাচন কিংবা রাজনীতির নামে সহিংসতা কোনোটাই হতে পারে না।

দেশের স্বার্থে উভয় পক্ষকে আলোচনায় বসে সমাধান বের করতে হবে।

অনেকে দেশ নিয়ে ভাবেন। দেশের জন্য কাজ করতে চান। কিন্তু আপনি শুরু করে দিয়েছেন। কীভাবে এতটা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হলেন?
ছোটবেলা থেকেই ভাবতাম, মানুষের জন্য কাজ করব।

কেননা, মানুষের শোষণ-বঞ্চনা আমাকে ভাবাত। কিন্তু কীভাবে করব, কোথায় গিয়ে করব, সেটি বুঝতে পারতাম না। জানতাম, মানুষকে এসব থেকে মুক্তি দিতে হবে। আর আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। ফলে, দেশের প্রতি ভালোবাসার শিক্ষা ঘর থেকেই পাওয়া।



শাহবাগের লাখ লাখ মানুষ আপনার সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছে। সেসব দিনের কথা কিছু বলবেন?
এত মানুষের সঙ্গে সেবারই শাহবাগে প্রথম স্লোগান দিয়েছি। এটি অন্য রকম ভালো লাগা। মনে হচ্ছিল, আমার সঙ্গে সমগ্র বাংলাদেশ আওয়াজ তুলছে। ছোট ছোট শিশুর মধেই আমার জনপ্রিয়তা বেশি।

তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ছড়িয়ে দিতে পেরেছি বলে নিজেকে স্বার্থক মনে হয়।

নারীর স্বাধীনতা বলতে আপনি কী বোঝেন?
যখন কোনো নারীর চিন্তা, চেতনা ও মননে কোনো রকমের বাধা তৈরি করা না হয়।

রাজনীতিতে এখন সরকার ও বিরোধী দল—উভয় পক্ষেই নারী নেতৃত্ব। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

অনেকে মনে করেন, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা দুজনই যেহেতু নারী, সুতরাং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়েছে। আমি সেটি মনে করি না।

আমার কাছে নারীর ক্ষমতায়ন মানে, সমাজের সব ক্ষেত্রে নেতৃত্বে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকা নিশ্চিত হতে হবে।

বাংলাদেশের কোন খাতের নারীদের কাজ আপনাকে আন্দোলিত করে?

অবশ্যই পোশাকশিল্প খাতের নারীরা। তবে এই খাতে বিপুলসংখ্যক নারী কাজ করলেও তাঁরা সঠিক মজুরি, সুযোগ-সুবিধা কিছুই পাচ্ছেন না।

এবার কিছু ব্যক্তিগত কথা জানা যাক। কয় ভাইবোন আপনারা?

তিন ভাই, তিন বোন।

আমিই সবার বড়।

রাজনীতির বাইরে আর কী করেন?

নিজের চলার জন্য আগে টিউশনি করতাম। এখন অনুবাদের কাজ করি।

দেশের মধ্যে শেষ কবে ঘুরতে গিয়েছিলেন?

শাহবাগে আন্দোলনের কয়েক দিন আগে টাঙ্গাইলে বেড়াতে গিয়েছিলাম। এমনিতে পাহাড় ও সমুদ্রে বেড়াতে ভালো লাগে।

গান শোনা হয়?

লালনের গান ও গণসংগীত বেশি শুনি। লালনের গান গাইতেও ভালো লাগে।

কোন ধরনের বই পড়তে ভালো লাগে?

ইতিহাসনির্ভর যেকোনো বই।

পরিবারের সমর্থন কেমন পান?

সব সময়। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও পরিবার আমার পাশে থাকে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী আপনার?

ভবিষ্যতে আমি জাতীয় রাজনীতিতে আসতে চাই।

 

অবরোধ, তার সঙ্গে হরতাল। দেশে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংকট। কিন্তু এই তরুণের সঙ্গে কথা বলার সময় লক্ষ করলাম, কী নিদারুণ স্থির ভাবনা তাঁর। চারপাশের হতাশার মধ্যেও আশাবাদী তিনি।

ডিসেম্বরের রোদের ছটা যখন মুখে এসে পড়ছিল, দেখলাম চোখে-মুখে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। তাঁর কথায় আছে বিশ্বাস-যুক্তি, নেই বিদ্বেষ। এই তরুণ প্রজন্মই কী ভবিষ্যতের বাংলাদেশ!

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.