আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাদের মোল্লার শেষ চিঠি

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সমসাময়িক অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি। পাঠকদের জন্য ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো-

ছোট্ট একটি ব্যক্তিগত দায় থেকে আজকের লেখাটির অবতারণা। কাশিমপুর জেল থেকে মুক্তির দিন সকালেই ঘটল ঘটনাটি। মুক্তিলাভের আশা আর জেল গেটে পুনরায় গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কার দোলাচলে দুলতে দুলতে আমি আমার মালপত্র গোছাচ্ছিলাম। এমন সময় লুঙ্গি পরা এক ব্যক্তি আমার রুমে ঢুকে সালাম দিলেন এবং বললেন, কাদের মোল্লা সাহেব আপনাকে একটি চিঠি দিয়েছেন।

মুহূর্তের মধ্যে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, চিঠিটি গ্রহণ করব, না ফেরত পাঠাব। এরই মধ্যে আগন্তুক টেবিলের ওপর চিঠিটি রেখে তড়িৎ গতিতে চলে গেলেন। আমি কম্পিত হাতে চিঠিটি খুললাম। একটি ছেঁড়া ছোট কাগজে ৩-৪টি বাক্য লিখেছেন আবদুল কাদের মোল্লা।

কিন্তু বাক্যগুলোর তির্যক অভিব্যক্তি আমাকে যারপরনাই আহত করল। সে চিরকুটের ইতিকথা বলার আগে আরও কিছু প্রসঙ্গ পাঠকদের জানাতে চাই। কাশিমপুর জেলে ঢোকার পর পরই আমার জেলমেটদের কাছে কাদের মোল্লার সম্পর্কে বহু কথা শুনছিলাম হররোজ। বিশেষ করে খাবার টেবিলে তার সম্পর্কে আলোচনা হতো সবচেয়ে বেশি। ট্রাইব্যুনালের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী হিসেবে সুরমা সেলেই ছিলেন।

ডায়াবেটিসের রোগী। খাবার টেবিলে বসে প্রথমেই বলতেন কিছুই খাবেন না। তারপর একটার পর একটা খাবারের দিকে তাকাতেন। শিশুর মতো হাসি দিয়ে বলতেন, মামুন, গোশতের রংটা বোধহয় ভালোই হয়েছে। তারপর মাহমুদুর রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলতেন ঘ্রাণটাও তো চমৎকার।

মীর কাশিম বা অন্য বন্দীদের দিকে তাকিয়ে এমন ভাব করতেন যেন কাদের মোল্লাকে খাওয়ার জন্য একটু অনুরোধ করেন। একসময় তিনি অনুরোধে সাড়া দিয়ে খাওয়া শুরু করতেন এবং হই-হল্লোড়, হাসি-তামাশা এবং নানারকম গল্প-উপাখ্যান বলে পুরো খাবার টেবিল মাতিয়ে রাখতেন। বিষণ্ন বন্দীরা তাই কাদের মোল্লার উপস্থিতিটাকে একধরনের প্রশান্তি হিসেবে গণ্য করতেন। আমি যখন জেলে ছিলাম তখন কাদের মোল্লা ছিলেন অন্য সেলে সাধারণ বন্দীদের মতো। যুদ্ধাপরাধের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে তার প্রতি ছিল জেল কর্তৃপক্ষের সতর্ক প্রহরা।

ফলে প্রতি বিকালে পাশাপাশি সেলের বন্দীরা নিজেদের সীমানাপ্রাচীরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করতেন আবার পুরনো বন্দীদের কেউ কেউ রাস্তায়ও বের হয়ে আসতেন। কিন্তু কাদের মোল্লাকে সেই সুযোগ দেওয়া হতো না। কাদের মোল্লার সেবক সকাল-বিকালে আমাদের সেলে আসত ফ্রিজ থেকে ইনসুলিন নেওয়ার জন্য। জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কে বা কারা যেন সুরমা সেলে ছোট্ট একটি ফ্রিজ বসিয়েছিল কেবল কাদের মোল্লার ওষুধপথ্য রাখার জন্য। সেই ফ্রিজে কাদের মোল্লার ডায়াবেটিসের ওষুধপথ্য থাকত।

সেবক যখন ওষুধ নিতে আসত তখন তার কাছ থেকে কাদের মোল্লা সম্পর্কে টুকটাক জানতে পারতাম। বন্দীজীবনের নিরন্তর সময় যেন আর কাটতে চাইত না। ফলে আমরা সময়টুকুকে যথাসম্ভব আনন্দমুখর করার জন্য সর্বাত্দক চেষ্টা করতাম। যার যত জ্ঞান বা প্রতিভা ছিল, সবই উজাড় করে দিতাম সহযাত্রীদের আনন্দ দেওয়ার জন্য। একদিন বিকালে বসেছিলাম সুরমা সেলের বারান্দায়।

পাশাপাশি চেয়ার নিয়ে আমরা সবাই- গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, মাহমুদুর রহমান, মীর কাশিম আলী আর এ টি এম আজহারুল ইসলাম। হঠাৎ নীরব হয়ে গেলাম অজানা কারণে। অর্থাৎ বলার মতো কোনো কথা ছিল না কারও মুখে। হঠাৎ মামুনই বলে উঠলেন- এ সময় মোল্লা ভাই থাকলে আমাদের সবাইকে গান শোনাতেন। জামায়াতের লোক আবার গান গায় নাকি, মনে মনে টিটকারী কেটে জিজ্ঞাসা করলাম, কী গান গাইতেন? রবীন্দ্রসংগীত।

অসাধারণ তার গায়কী গলা আর সুরের ঢং- বললেন মাহমুদুর রহমান। আমি নিজে টুকটাক গাইতে জানি। তাই প্রস্তাব করলাম কিছু একটা গাওয়ার জন্য। তারা আগ্রহ দেখালে আমি একটি রবীন্দ্রসংগীত গাইলাম- 'মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে'। সবাই শুনলেন এবং প্রশংসা করলেন।

তবে এ কথা বললেন যে, আমার চেয়েও কাদের মোল্লা সুন্দর করে গান করেন। তার গান পরিবেশনের সময় তিনি উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে এমনভাবে চোখের ভাব বিনিময় করেন যে শ্রোতারা তার সঙ্গে গুনগুনিয়ে কণ্ঠ মেলাতে বাধ্য হন। ফলে পুরো অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। অন্যদিকে আমি গান করি চোখ বুঝে। যখন আমার সঙ্গী-সাথীরা আমাকে চোখ খোলা রেখে আরও একটি গান গাইতে অনুরোধ করলেন তখন আমি ভারী লজ্জা পেয়ে গেলাম এবং আর এগোতে পারলাম না।

ফলে তারা আবার কাদের মোল্লার প্রশংসা করতে থাকলেন। একদিন আমরা সবাই খাবার টেবিলে বসে দুপুরের খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। সেবকরা তখন খাবার পরিবেশনের জন্য আনজাম করছিল। এমন সময় কাদের মোল্লার সেবক এসে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের কাছে ছোট একটি চিঠি ধরিয়ে দিল। চিঠিটি পড়ার পর মামুনের মুখমণ্ডল ক্ষোভ, লজ্জা আর রাগে লাল হয়ে গেল।

এরপর তিনি চিঠিটি মীর কাশিম আলীর হাতে দিলেন। মীর কাশিম চিঠিটি পড়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আমার হাতে যখন চিঠিটি এলো তখন দেখলাম কাদের মোল্লা লিখেছেন-

প্রিয় মামুন, সালাম। নিতান্ত বাধ্য হয়েই তোমার সেবক মতির বিরুদ্ধে তোমার নিকট নালিশ জানালাম। ইদানীং কেন জানি আমার বেশি বেশি ডাল আর উস্তা ভাজি খেতে ইচ্ছে করে।

আমার নিজের অর্থ দিয়ে এসব কিনে খাওয়া যে সম্ভব নয় তা তুমি জান। তুমি আমার জন্য এযাবৎ অনেক কিছু করেছ, আর তাই তোমার ওপর অজানা এক অধিকার জন্ম নিয়েছে। সেই অধিকারবলে আমার সেবককে বলেছিলাম চোখায় (রান্নাঘরে) যখন খাবার ভাগাভাগি হয় তখন মামুনদের ভাগ থেকে একটু ডাল আর উস্তা ভাজি বেশি করে নিও আমার জন্য। কিন্তু তোমার সেবক আমাকে এই সুযোগ দেয়নি। জীবন-মৃত্যুর শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে এই অভাগা তার ছোট ভাইয়ের নিকট একটু ডাল আর উস্তা ভাজি চেয়ে যদি অন্যায় করে থাকি তবে মাফ করে দিও।

ইতি- চিঠি পড়ে আমরা সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মাহমুদুর রহমান বললেন, কাল থেকে মোল্লা সাহেবের জন্য আলাদা ডাল আর উস্তা ভাজি রান্না হবে। সব বিল আমি দেব। মামুন ক্রোধে কাঁপছিল আর সেবককে শাসাচ্ছিল। আর অন্যরা একধরনের বিষণ্নতার নস্টালজিয়ায় ভুগতে লাগলাম।

এবার আমি বলছি আমার কাছে লেখা কাদের মোল্লার চিরকুট কাহিনী। তিনি লিখেছেন- প্রিয় রনি, যদি কখনো সময় পাও এবং তোমার ইচ্ছা হয় তবে আমার ফাঁসির পর একবার হলেও বলো বা লিখো- কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের এক ব্যক্তি নয়। আমার আত্দা কিয়ামত পর্যন্ত কাঁদবে আর কসাই কাদের তখন কিয়ামত পর্যন্ত অট্টহাসি দিবে।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.