রাজনীতির করাতকলে প্রতিদিন বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আন্দোলনের নামে মানুষ মারার বিচিত্র ফাঁদ পেতে রাখছে ক্ষমতালিপ্সুদের অনেকেই। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারার অসুস্থ খেলার সঙ্গে যুক্ত করেছে রাতের অন্ধকারে রেলের নাশকতা। চলন্ত বাসে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ জনকে মেরে ফেলা সম্ভব। কিন্তু ট্রেনে যদি নাশকতায় সফল হতে পারে দুর্বৃত্তরা, তাতে হয়তো তাদের সাফল্য (!) বেড়ে যাবে অনেকখানি।
দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে ১৮ দলের দেওয়া দফায় দফায় অবরোধ কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীদের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে রেলের নাশকতা।
রক্তহীন হরতাল ও মৃত্যুহীন অবরোধের কথা যেন আন্দোলনকারীরা ভুলে গেছে। তাই হরতাল কিংবা অবরোধের আগের সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় তাদের তাণ্ডব। প্রধানত সড়কপথই ছিল অবরোধ-হরতালকারীদের প্রধান লক্ষ্য। প্রথম দিকে দু-এক জায়গায় সামান্য পরিমাণ ফিশপ্লেট তুলে ফেলার কারণে রেলের বগি লাইনচ্যুত হতো।
তখন অনেকেই মনে করত, জনমনে ভীতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এ কাজ করছে তারা। কিন্তু এবার আন্দোলনকারীদের রেলপথে নাশকতার মাত্রা আর সেই সামান্য পর্যায়ে নেই। মানুষ মারার মধ্যেই যেন দৈনিক কর্মসূচির সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করছে। রেলে নাশকতায় কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে, আয় অর্ধেকে নেমে আসছে, জীবন হারাচ্ছে অনেকেই, পঙ্গু হচ্ছে অগণিত মানুষ। আর এসবের আড়ালে বীভৎস দাঁত বের করে হাসছে গণবিরোধী রাজনীতিকেরা।
এসব নাশকতা ও অবরোধ দুই জোটেরই কাম্য। সরকারদলীয় জোট মনে করে, বিরোধী জোট এ রকম কর্মসূচি চালাতে থাকুক। এতে করে বিরোধী দলের ওপর মানুষ ক্ষুব্ধ হবে। বিরোধী জোট মনে করে, তারা তাদের কর্মসূচি যথার্থভাবে পালনে সক্ষমতা অর্জন করেছে। দুই দলেরই লক্ষ্য সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তোলা।
রেলে নাশকতার ইতিহাস অল্প দিনের। আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার দিন থেকেই রেলে নাশকতা শুরু হয়। অবরোধের দিনগুলোয় তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে ১৮ দলের সঙ্গে থাকা কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে, যারা নাশকতা করছে, তাদের সরকার ধরছে না মানেই হচ্ছে সরকারি দলের কেউ নাশকতা করছে। মূলত রাজনৈতিক কর্মসূচির জাঁতাকলে পিষ্ট এখন সাধারণ মানুষের জীবন।
নাশকতা করার জন্য তো যেকোনো দলের সংগঠকদের উপস্থিত থাকার প্রয়োজন নেই। টাকা দিয়ে এসব মানুষ ভাড়া পাওয়া যায়, তারা টাকার দলের। কে করাচ্ছে এসব নাশকতা, সেটা চিহ্নিত করা জরুরি। তবে সন্দেহের তির যেদিকেই ধরার চেষ্টা করা হোক না কেন, তা অবরোধকারীদের দিকেই যাবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রেললাইনকে মানুষ মারার ফাঁদ বানাতে অল্প টাকা হলেই হয়।
একটি লাইনের সঙ্গে আরেকটি লাইন যুক্ত থাকে ফিশপ্লেটের মাধ্যমে। সেই ফিশপ্লেট খুলে ফেলতে সময় প্রয়োজন হয় মাত্র ১০ মিনিট। ১০ জন দুর্বৃত্ত যদি একযোগে ফিশপ্লেট তুলে ফেলে, তাহলে ১০ মিনিটে ১০টি রেললাইন খুলে ফেলা সম্ভব হয়। রেললাইনে আগুন দেওয়া, ট্রেনে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারা, স্লিপার তুলে ফেলা, গাছের গুঁড়ি লাইনের ওপর ফেলে রাখা, ট্রেনে আগুন দেওয়াসহ সব রকম হীন প্রচেষ্টা চলছে রেলকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করার।
রেল যাতে নিরাপদে চলতে পারে, সে জন্য রেলের কয়েক স্তরবিশিষ্ট প্রতিরোধব্যবস্থা রয়েছে।
এ ব্যবস্থাগুলো চালু থাকলে রেলের নাশকতা বন্ধ করা না গেলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। গত তিন সপ্তাহে রেলে নাশকতা দুই শতাধিক। এর মধ্যে কোথাও কোথাও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটেছে। ট্রেন যাতে নিরাপদে চলে, তার জন্য যে তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় সেগুলো হচ্ছে: যাত্রীবাহী ট্রেন যাওয়ার আগে একটি যাত্রীশূন্য কোচ (শাটল ট্রেন) নিয়ে একটি ইঞ্জিন আগে যাবে অথবা একটি ট্রলি আগে যাবে কিংবা হেঁটে টহলের ব্যবস্থা থাকবে। ৪ ডিসেম্বর গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া স্টেশনের পথে বুরুঙ্গি রেলসেতুর কাছে দুর্বৃত্তরা যে মরণফাঁদ বানিয়েছিল, তা অত্যন্ত ভয়াবহ।
পদ্মরাগ এক্সপ্রেসটি বোনারপাড়া ছাড়ার আগে ট্রলি টহল রেলপথকে নিরাপদ ঘোষণা করেছিল। তার পরও দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়নি ট্রেনটি। যারা এ মৃত্যুফাঁদ বানিয়েছিল, তারা চেয়েছিল ট্রেনভর্তি মানুষ যেন মারা যায়। দুর্বৃত্তরা বুরুঙ্গি সেতুর এমন দূরত্বে ফিশপ্লেট তুলে ফেলেছিল, যাতে ট্রেনটির ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে ব্রিজের নিচে গিয়ে পড়ে। তাহলে অন্য বগিগুলোও ব্রিজের নিচে পড়বে।
এতে করে পদ্মরাগ ট্রেনের ১০টি বগিভর্তি মানুষ সবাই মারা যেতে পারত।
প্রতিদিন রাজনীতির অসংখ্য বীভৎস নারকীয় নাশকতা দেখেও জীবনের তাগিদে মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে হয়। যোগাযোগব্যবস্থা বলতে ট্রেন ছাড়া এখন উপায় নেই। যত দেরি করেই হোক গন্তব্যে পৌঁছার নিশ্চয়তা ভেবেই মানুষ ট্রেনে যাতায়াত করে। শুধু সেই যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ করার ইচ্ছা যদি আন্দোলনকারীদের থাকত, তাহলে তারা ট্রেন অবরোধ করে রাখত।
লক্ষ্য তাদের শুধু অবরোধ নয়, মানুষ মেরে ফেলা। এ কারণে তারা রাতের অন্ধকারে ফাঁদ পেতে রাখে।
গত ২৭ নভেম্বর ভোরবেলা কৃষক তাজুল ইসলাম লাইন খোলা দেখে দৌড়ে গিয়ে স্ত্রীর লাল পেটিকোট কাঠির ওপর ঝুলিয়ে নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে মেঘনা এক্সপ্রেস চাঁদপুর থেকে লাকসাম স্টেশনের দিকে যাওয়ার পথে থামিয়ে ৫০০ মানুষের জীবন রক্ষা করেছেন। তিনি এগিয়ে না এলে বড় রকমের দুর্ঘটনাকবলিত হতো ট্রেনটি। রেলপথে প্রায় ৭০০টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এরই মধ্যে বেশ কিছু স্থানে নাশকতা প্রতিরোধের ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরিষার মধ্যে ভূত থাকে কি না, সেদিকেও নজর দিতে হবে।
যত বড় কর্মসূচি, তত মানুষের মৃত্যু। অনেক দিন আগে বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়া বলেছেন, আন্দোলনে কিছু মানুষ প্রাণ হারাবে। সম্ভবত তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হচ্ছে অথবা তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর ক্ষমতার মোহ নেই। এরও প্রমাণ মিলছে না। কার্যত, একদিকে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে, অন্যদিকে চলছে নির্বাচনী প্রস্তুতি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বিরোধী দল মানুষকে হত্যা করার পথ বেছে নিয়েছে। সেই কাজে অধিকতর সাফল্যের জন্য রেলপথ তাদের এখন সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।