কবে থেকে ওরা আমার পিছনে পড়ে আছে? পাঁচ-দশ-পনের, নাকি আরো বেশি সময়? মনে পড়ে না, মনে পড়ে ওরা আমার পিছে পড়ে আছে যখন থেকে আমি মানুষের সাথে মিশি। কখনো নামাজ পড়ার দাওয়াতে, কখনো কুইজ প্রতিযোগিতার নামে বা কখনো খেলার মাধ্যমে কিনা করেছে তাদের ছায়ায় নিতে আমায়। জানতাম না আফগানিস্তান কী, কোথায় অবস্থিত কিন্তু শুনেছি নাম পরিচয় না জানা কোন আগুন্তুকের মুখে, হয়তো দুয়েকদিনের জন্য এসেছিল কালসাপের ঝাঁপি নিয়ে আমার ছোট্ট গ্রামে, ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। সাধের বাংলা কেন আফগান হবে আর তালেবানই বা কী জিনিস কিছুই না জানার সময়ে শুধু তার কথা বলার ধরণে আর ইসলামের উপর তার জ্ঞান দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছিলাম। আর হব নাই বা কেন? পাঠ্যপুস্তক তাও আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইসলামিক জ্ঞান পর্যন্তই যে ছিল আমাদের দৌড়।
তখন যে আমরা প্রাথমিকে পড়ি। মুখে দাঁড়ি, মাঝে মাঝে আরবি বলে হয়তো ইংরেজিও বলেছিল ঠিক মনে নেয় কিন্তু তার ইসলাম প্রীতি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেই সময় পেয়ে গিয়েছিলাম প্রথম দাওয়াত, দেশকে পাক-স্তান বানানোর দাওয়াত। অনেক পরে যখন বাংলা ভাই নামক দানবের অস্তিত্ব আবিষ্কার হল মিলিয়ে দেখলাম আমিও পেয়েছিলাম দাওয়াত কিন্তু খুব বাঁচা বেঁচে গেছি কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমার এক বন্ধু ঠিক ছোবল খেয়েছে সেই সাপের।
বই পড়া শুরু করেছিলাম সেই ছোট্ট বয়স থেকেই।
নিজের লাইব্রেরি ছিলোনা তাই অন্যের বই-ই ভরসা। হয়তো শরৎ দিয়েই শুরু করেছিলাম, হয়তো শঙ্কর বা অন্য কেউ কিন্তু কিছুদিন যেতেই আমার টেবিলে কাশেম বিন আবু বকর শোভা পেতে লাগল। পুথি পড়ার সময় গেছে চলে সেই কবে কিন্তু তার রেশ তখনো চলছে আমাদের গ্রামে। মাঝে মাঝে রাতে দোকানে যাওয়া লাগতো, কখনো কেরোসিন, কখনো লবণ কখনো বা বাবার জন্য বিড়ি আনতে। দেখতাম একটা দোকানে অনেক মানুষের ভিড়- সবাই দোকানদারের কথা আগ্রহ নিয়ে শুনছে।
একদিন আমিও দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম, শুনেছিলাম একজন আমহদ মুসার দুঃসাহসিক জীবনের কথা। রাতে বাড়ির বাইরে অনেকক্ষণ থাকা রীতিমত অন্যায় তারপরও তার জীবনের পরতে পরতে থাকা বিপদ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। দেখেছিলাম সবাই চীৎকার করে বলছে আহমদ মুসাকে মুক্ত না করে বাড়ি যাবে না। জানিনা সেই রাত্রেই মুক্ত হয়েছিল কিনা আহমদ মুসা, হয়তো হয়েছিল হয়তো হয়নি। কিন্তু আমি আটকে গিয়েছিলাম সাইমুম ঝড়ে।
পরেরদিন সকালে সেই দোকানে গিয়ে দোকানদার চাচার কাছে থেকে নিয়ে আসি কয়েকটা সাইমুম। তারপর গোগ্রাসে গিলেছিলাম সেই সব বালি। সৌভাগ্যবশত কিছুদিন পরেই আরেক চাচার আলমারিতে পেয়েছিলাম মাসুদ রানাকে। সাইমুম ঝড় থেকে মুক্তি দিয়েছিল রানা আমায়। তাই রানার কাছে কৃতজ্ঞ আমি সারাজীবন।
কিন্তু যখন কলেজে উঠে এক শহরে গেলাম, পরিচিত হলাম আমার মেসের এক বন্ধুর সাথে বুঝলাম চোরাবালিতে ডুবেছে সে। রানা এখানে পুরোপুরিই ব্যর্থ।
তখন খেলতাম সারাদিন। কখনো ফুটবল কখনো ভলিবল কখনো বা ক্রিকেট। গ্রামে এক ভাই ছিলেন যিনি ফুটবল বা ভলিবল খেলতেন না, খেলতেন ক্রিকেট।
অন্যগুলো পারতেন না, ক্রিকেটও যে খুব পারতেন তা নয়, কখনো বল করতে গেলে বল পিচে না পড়েই ব্যাটসম্যানের সাহায্য ছাড়াই ছক্কা হয়ে যেত তবুও তিনি খেলতেন। আমাদের গ্রামে ক্রিকেট আগে কেউ খেলত না। আমরা বা আমাদের চেয়ে কয়েক বছরের বড় দুয়েকজন এই খেলাটা শুরু করি । আর ভলিবল বা ফুটবলের সে সময় রমরমা অবস্থা। ওখানে ভাল না খেললে সর্বচ্চ দর্শক হওয়া যায় মাঠে ঢুকার ফুরসৎ মিলতনা।
এই বড় ভাই ক্রিকেট শেখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। এতে আমাদেরও বিশাল লাভ। মাঝে মাঝেই বল পাওয়া যেত; বল না থাকার কারণে অনেকদিন খেলা বন্ধ রাখতে হত কিন্তু এই ভাই আসার পর সব সমস্যা সমাধান। দলে একটা যায়গা স্বভাবতই নিশ্চিত এবং বয়সের জন্য অধিনায়কত্বও। এর সুবাদে আমরা তার দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকি এবং আবিষ্কার করতে থাকি, আমরা মাঝে মাঝি চলে যাচ্চি শিবিরের মিটিঙে।
কতটুকু সময় পড়ি, নামাজ পড়লাম কিনা মাঝে মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতে যাই কিনা সব তথ্য জমা দিয়ে দিচ্ছি অত্যান্ত উৎসাহ ভরে। এখন বুঝি হয়তো চেষ্টা করলে সে ফুটবলও খেলতে পারত কিন্তু ওখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারতনা। ওখানে শুধু আমাদের বয়সীরা খেলত না, সারা গ্রামই যে খেলত।
এই ভাইয়ের কাছে জেনেছিলাম কবিগুরুর সোনার বাংলা জাতীয় সঙ্গীত হতে পারে না; এতে মা কালীর জয়গান গাওয়া হয়েছে। এমন কি তিনি যে বাংলাকে দুচোখে দেখতে পারেন না জেনে গিয়েছিলাম এই ভাইয়ের মাধ্যমে।
গর্বের ঢাকা ভার্সিটি যাতে না হতে পারে তার জন্য কবিগুরুর অপচেষ্টা জানতেও বাকী ছিল না। জেনে গিয়েছিলাম বাংলায় একজন শুধু কবি, তিনি ইসলামের কবি- কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলকে একজন পরহেজগার মানুষ কেন বলা হবে না তার উপর এক ঢাউস বই তিনি ধরিয়ে দিয়েছিলেন হাতে, ফলে আমি বিশ্বাস করেছিলাম নজরুলের ইসলামিত্বে।
তিনি বিচক্ষণ ছিলেন- একই সাথে তিনি বিজয় দিবস এবং বদর দিবস পালন করতেন, কোনটাই বাদ দিতেন না। বদর দিবসে যেকোন সুরা পড়লেই পুরষ্কার পাওয়া যেত- সাইমুম, কাশেম বিন আবু বকর কিংবা পৃথিবী ঘোরে না সুর্য ঘোরে টাইপ।
পড়ুয়া ছাত্রদের জন্য আবার নিয়মিত কুইজের অনুষ্ঠান করতেন। মানে আপনি যেমনই হোন না কেন আপনার দুয়ারে শান্তির আগুন পৌছে যাবেই। ইনার কারণেই আমরা বিজয় দিবসে গান বাজনা না করে মিলাদ পড়েছি মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে। তবে হিন্দু মুক্তিযোদ্ধাদের কী হবে এই নিয়ে আমরা প্রশ্ন উত্থাপন করিনি। যখন আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছিলাম পাকিস্তানের পতাকার নিচে নিজেদেরই অগোচরে, তখন আরেক রানার আবির্ভাব।
তিনি আমাদের স্কুলের একজন শিক্ষক। তিনি নতুন করে দীক্ষা দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ, নজরুল-রবীন্দ্রনাথ এবং জামাত ইসলামের। তিনি অবশ্য জামাত বলতেন না বলতেন ডামাট। কিন্তু এবারো দেখলাম আমার বেশ কিছু বন্ধু সেই পাক সার জমিনই গাইতে থাকল।
আমাদের খেলার মাঠের পাশেই একটা মুদিখানার দোকান ছিল।
দোকানদারের সাথে সদ্ভাব ছিলোনা এমন মানুষ আমাদের গ্রামে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গ্রামের সবাই তাঁর বন্ধু স্থানীয়। এই দোকানে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার বাজত। আমরা নিজেরাও ক্যাসেট কিনে এখানে বাজাতাম। এটা ছিল আমাদের এক আড্ডা স্থল; মনির খান হয়ে জেমস হাসান আয়ুব বাচ্চু সবাইকে এখানেই একে একে চিনেছিলাম।
আমাদের মতই কোন একজন, হয়তো তিনি নিজেই কিনেছিলেন সাইদীর ওয়াজ। সারা রমজান মাসে বাজত সাইদীর কন্ঠ। আমরা তো তাঁর ওয়াজ শুনে রীতিমত মুগ্ধ। কোন একদিন পাশের গ্রামে এসেছিল সাইদী ওয়াজ করতে, দেখেছিলাম তার জনপ্রিয়তা। এতো মানুষ যে হতে পারে ধারণাও ছিল না আমার।
সত্য বলছি দলমত নির্বিশেষে সেখানে হাজির হয়েছিল সবাই। এ যেন মানুষের সমুদ্র। সেই সময় জেনেছিলাম কেউ কেউ একে নাকি রাজাকার বলে। কিন্তু আমরা জেনেছিলাম তার বয়স যুদ্ধের সময় বড় জোর ১০ কি ১২ ছিল। আমরা ভাবতে বাধ্য হচ্ছিলাম একজন আল্লাহওয়ালা মানুষকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছিল কিছু মুরতাদ মানুষ।
এই সেদিন জানলাম তার ছেলের বয়স বাংলাদেশের বয়সের সমান। বুঝেছিলাম এতদিন জেনে আসা মানুষটিকে মুখোশের আড়ালেই দেখে এসেছি। সে আসলে ভণ্ড ধর্ম ব্যাবসায়ী ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা তো আগেই হয়ে গেছে। অনেকেই নীল হয়ে গেছে এই সাপের বিষে।
তাই যখন চাঁদে এই দানবের ছবি দেখা যায় সত্যি অবাক হয়না আমি।
আমাদের স্কুলটি নিম্নমাধ্যমিক ছিল। তাই অষ্টম শ্রেণী পাশ করেই এলাকার সব চেয়ে বড় স্কুলে ভর্তি হলাম। এলাকার সব ভালো ছাত্র-ছাত্রী ওখানে পড়ে। এখানেই সন্ধান পেয়েছিলাম আরেকটি কালসাপের, তিনি বাংলা পড়াতেন।
তার কাছে থেকেই পাঠ নিয়েছিলাম ভাষা আন্দোলনের নতুন ইতিহাস। জানিনা হটাৎ করেই শুরু করেছিলেন নাকি কোন কবিতা বা গল্প পড়াতে পড়াতে শুরু করেছিলেন ভাষা আন্দোলনের নতুন ইতিহাস লেখা, মনে পড়ে না। হয়তো কবর নাটক পড়ানোর সময়ই তিনি রচনা করেছিলেন বায়ান্নর নব ইতিহাস।
‘তোদের যে ইতিহাস পড়ানো হয় তা পুরোটাই বানোয়াট। ভাষার জন্য কয়টা ছেলে মিছিল করছে এই কারণে কেউ গুলি করে?’ তিনি ছুঁড়ে দিয়েছিলেন প্রশ্নের তীর।
আমাদের উত্তর জানা নেই। আমরা প্রশ্ন বাণে জর্জরিত তাঁর চেয়ে বেশি বিস্ময়ে বিমুঢ়। তবে কি কবিতায় পড়া সালাম, বরকত জব্বার এসবই গাল-গল্প? আমাদের প্রশ্ন মনে জাগে, আমরা পরস্পরের সাথে মুখ চাওয়া-চায়ি করি। আমাদের সবকিছু উলটে যেতে চায়। পুরো ক্লাস জুড়ে রাজ্যের নীরবতা! তবে হটাৎ আমাদের একবন্ধু আমাদের উদ্ধার করে নীরবতার সমুদ্রে ডুবে যাওয়া থেকে।
স্যার তাকে দগ্ধানন মর্কট বলে ডাকত। সেই দগ্ধানন মর্কট পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় উদাস মনেই সব থেকে পিছনের বেঞ্চ থেকে ‘ সালাম বরকতের যে নাম শুনি এগুলো কি কাল্পনিক চরিত্র?’ স্যার, হয়তো তার কথা শুনতেই পায়নি কিন্তু আমরা আমাদের বাকশক্তি ফিরে পাই। তার প্রশ্নটি আমরা নতুন করে ফিরিয়ে দিই স্যারকে। স্যারের কোন ভাবান্তর হয়না। তিনি হয়তো জানতেন এমন প্রশ্ন আসবেই।
তিনি বলতে থাকেন, আমাদের বিস্ময়ের পারদ উপরে উঠতে থাকে। আমরা জানতে থাকি সেদিনের ছোট-খাট একটা মিছিলের কথা, জানতে থাকি কিছু বখে যাওয়া ছেলের ভাষা নিয়ে বাড়াবাড়ির কথা। কিন্তু আমাদের অবাক হওয়ার পালা শেষ হয়না। আমরা পেয়ে যায় সালাম রফিক জব্বারের মৃত্যুর সঠিক কারণ।
‘ যে সময় মিছিল হচ্ছিল সেসময় মেডিকেল কলেজের কিছু ছেলে ক্যান্টিনে বসে আড্ডা মারছিল, হয়তো কেউ কেউ দাঁড়িয়েই ছিল।
এদিকে মিছিলের ছেলেগুলোকে ভয় দেখানোর জন্য পুলিশ তাদের মাথার উপর দিয়ে গুলি করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওই হতভাগ্য ছেলেগুলোর, কিছুই জানতে পারেনা কিন্তু খুন হয়ে যায় সেই গুলিতে, কেননা ক্যান্টিনের মেঝে ছিল বেশ উঁচু। ’
আমরা কি বিশ্বাস করেছিলাম হয়তো করিনি। হয়তো দগ্ধানন মর্কট হেসেছিল এই ইতিহাস শুনে। অনেক জ্ঞান আমরা লাভ করেছিলাম ইনার কাছ থেকে।
‘হাজার বছর ধরে’ পড়ানোর সময় আমরা জেনেছিলাম মকবুল বুড়ো আসলে জহির রায়হান নিজেই। মকবুল বুড়ো যেমন তার বৌ দিয়ে হাল চাষ করাতো, জহির রায়হান তার বৌ এবং শ্যালিকাদের দিয়ে ছবি করাতো। তিনিই আমাদের জানিয়েছিলেন জহির রায়হান কে হয়তো খুন করেছে মুক্তিযোদ্ধা নামধারী কোন একজন। ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নামক ডকুমেন্টারিতে নাকি তিনি দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কিছু নেতার অন্ধকাররূপ। আর তাই তাঁর এই অন্তর্ধান।
তিনি তাঁর কথার প্রমাণ দিয়েছিলেন জহির রায়হানের মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করে। দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে ১৬ই ডিসেম্বর কিন্তু জহির রায়হান হারিয়ে গেছেন ৩০শে জানুয়ারি। আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমাদের অজান্তেই নীল হতে শুরু করেছিলাম শিক্ষক নামধারী এই কালসাপের বিষে।
জাহিদ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।