আমার অনেক কথা
‘দ্য ক্যাসেন্দ্রা ক্রসিং। ’ বহুদিন আগে দেখা ব্রিটিশ চলচ্চিত্রকার জর্জ প্যান কসম্যাটোসের বিখ্যাত এ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য আজকাল খুব মনে পড়ছে। প্লেগ আক্রান্ত এক সন্ত্রাসী জেনেভা থেকে স্টকহোমগামী এক ট্রেনে চেপে বসলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিরা যাত্রীসহ ট্রেনটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের ধারণা’ ছিল ওই সন্ত্রাসীর কাছ থেকে প্লেগের জীবাণু অন্য যাত্রীদের মধ্যে সংক্রমিত হবে এবং গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তারা বাইরের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশলে তা মহামারীর রূপ নেবে। দ্রুত তাঁরা রেল কর্তৃপক্ষর সঙ্গে যোগাযোগ করে ট্রেনের গতিমুখ পরিত্যক্ত এক রেল লাইনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যে পথে আর কোন ট্রেন চলাচল করেনি। কর্তৃপক্ষ জানত ও পথে ক্যাসেন্দ্র্রা ক্রসিং নামে উঁচু এক ব্রিজ আছে, যাতে ওঠা মাত্র ব্রিজভেঙ্গে ট্রেন নদীতে তলিয়ে যাবে। এতে কাজ হবে দুটো। প্লেগাক্রান্ত ওই সন্ত্রাসীসহ অন্য যাত্রীরা মারা পড়বে। তাতে প্লেগের সংক্রমণ বন্ধ হবে এবং একে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।
কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর ট্রেনের যাত্রী এক চিকিৎসক এবং তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী টের পান তাঁরা ভুল পথে যাচ্ছেন এবং সামনে অবধারিত মৃত্যু। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই চিকিৎসক তখন ইঞ্জিনসহ সামনের দিকের কয়েকটি বগির সংযোগ খুলে দেন এই ভেবে যে, আয়তনে ছোট এবং ওজন কম হওয়ায় ওগুলো ক্যাসেন্দ্রা ক্রসিং পার হতে পারবে। আর বাকি অংশ ব্রিজে ওঠার আগেই থেমে যাবে। কিন্তু তিনি যা ভেবেছিলেন হুবুহু তা হয়নি। ইঞ্জিনসহ বিচ্ছিন্ন অংশ ব্রিজে ওঠা মাত্র ব্রিজ ভেঙ্গে নদীতে পড়ে।
আর ট্রেনের গতি বেশি থাকায় বাকি অংশের অনেক বগিও নদীতে পড়ে যায়। গতি মন্থর হতে হতে শুধু পেছনের কয়েকটি বগি ব্রিজে ওঠার আগে থামতে পারে।
লং-শটে ক্যাসেন্দ্রা ব্রিজ থেকে একটি একটি করে বগি পড়ে যাওয়ার দৃশ্য এত নিখুঁত ও হৃদয়স্পর্শী যে তা স্মৃতিতে স্থায়ী হয়ে আছে। আঠারো দলীয় নিরবচ্ছিন্ন অবরোধকারীদের রেললাইন ওপড়ানোয় বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেনের বগিগুলো লাইনচ্যুত হতে দেখা ক্যাসেন্দ্রা ক্রসিং-এর ওই দৃশ্য মনে পড়ার কারণ। কেন জানিনা লাইনচ্যুত ওই বগিগুলো দেখলে ভীষণ কষ্ট হয়।
ওতে চলাচল করেন এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। বিএমডব্লিউ পাজেরো নোয়াহ্ তো দূরের কথা, দূরপাল্লার স্ক্যানিয়া এমন কি হিনো বাসে চড়াও যাদের কাছে স্বপ্নবিলাস মাত্র। তাদের যোগাযোগের অন্যতম নির্ভরতা এই রেল ও রেল লাইন ধ্বংস করা আন্দোলনের কোন ব্যাকরণের মধ্যে পড়ে জানি না। অবশ্য দেশে যা চলছে তাকে আন্দোলন বললে ‘আন্দোলন’ শব্দটিকে অসম্মান করা হয়। রেল ও রেলওয়ে জাতীয় সম্পদ, জনগণের সম্পদ, একে এভাবে ধ্বংস করার সনদ এরা কোথায় পেল? প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, অবরোধের ক’দিনে রেলে ছোট-বড় প্রায় এক শ’ ঊনসত্তরটি নাশকতা ও হামলা হয়েছে।
যার মধ্যে রয়েছে বগি পোড়ানো, রেললাইন উপড়ে ফেলা, ফিশপ্লেট খুলে ফেলা, সিøপার তুলে ফেলা, লাইনে আগুন দেয়া ইত্যাদি। এক জায়গায় লাইন মেরামত হতে না হতে অন্য জায়গা থেকে লাইন খুলে নেয়া হচ্ছে। লাইন থেকে ছিটকে পড়া ইঞ্জিন বগি উদ্ধার করার আগেই অন্য জায়গায় লাইনচ্যুত হচ্ছে। ক্ষতির আর্থিক পরিমাপ এখনও চূড়ান্ত না হলেও তা দশ কোটি ছাড়িয়েছে বলে মনে করছে রেলওয়ে সূত্র। সূত্রমতে, গত দু’ দশকের বেশি সময়ের মধ্যে রেলওয়ে একসঙ্গে এত অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার মুখোমুখি হয়নি।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধে রেলের প্রায় তিরিশ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ নষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয় দফা অবরোধের প্রথম দুদিনে একুশটি ট্রেনের যাত্রা বাদ হওয়ায় পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজার যাত্রী ঢাকা থেকে গন্তব্যে যেতে পারেনি। দু’দিনে আয় কমেছে কোটি টাকা।
হরতাল-অবরোধ এ দেশে আগেও হয়েছে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর থেকে যেভাবে এর রূপ প্রকাশ পাচ্ছে তার সঙ্গে এদেশের মানুষের আগে পরিচয় হয়নি।
রেললাইন উপড়ে ফেলা, পুলিশ ফাঁড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, জেলা- উপজেলার প্রশাসনিক নথি নষ্ট করা, পুলিশের ওপর নৃশংস আক্রমণ ও হত্যা, সবশেষ পেট্রোল বোমায় নিরীহ মানুষকে যেভাবে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে তার দৃষ্টান্ত এমনকি স্বদেশী আন্দোলনেও নেই। স্বদেশী আন্দোলনে বিভ্রান্তি ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু ওতে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁরা দেশকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার আদর্শে নিবেদিত ছিলেন। তাদের চোখে ছিল বিপ্লবের স্বপ্ন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় রাশিয়ায় জারতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটিয়ে বলশেভিক বিপ্লবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীনের বিপ্লবীরা রাশিয়ানদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন। ভারতীয় বিপ্লবীদের উল্লেখযোগ্য এক অংশের উদ্দেশ্যও তাই ছিল। কিন্তু রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভারতের মৌলিক পার্থক্য উদ্দেশ্য পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ও দেশ দুটো ছিল স্বাধীন। ভারত পরাধীন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ। ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রথম কাজ হয় তাই ব্রিটিশ উচ্ছেদ। এ কাজ করতে গিয়ে ব্রিটিশের কূট কৌশলে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিতে আক্রান্ত হন তাঁরা।
একটি বিষয় বিশেষভাবে খেয়াল করা দরকার। তাহলো, স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়েছিল জনগণের নামে।
কিন্তু জনগণ তাতে তেমন সাড়া দেননি। আন্দোলনের যে কৌশল তাঁরা নিয়েছিলেন তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারেননি। বর্তমান সন্ত্রাস-সহিংসতাও জনগণের নামে চলছে। কিন্তু জনগণ কি তা গ্রহণ করছেন? স্বাধীন দেশে পরিকল্পিতভাবে দেশের সম্পদ শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার জন্য ধ্বংস হচ্ছে। এর পেছনে কোন নীতি-আদর্শ বা জনগণের মুক্তির আকাক্সক্ষা নেই।
এ দেশকে নিজের দেশ মনে করলে বা দেশের প্রতি সামান্য মমতা থাকলে এত নৃশংসতা ঘটানো কিছুতেই সম্ভব নয়। অন্যদিকে, এও সত্য, চলমান নাশকতাকারীদের উল্লেখযোগ্য কোন শাস্তির দৃষ্টান্তও নেই। যানবাহনে পেট্রোলবোমা মেরে সন্ত্রাসীরা নির্বিঘেœ পালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার। যেন তাদের করার কিছুই নেই।
সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর যেভাবে পুলিশের ওপর নৃশংসতা চলেছে স্বদেশী আমলে তা কল্পনা করা সম্ভব ছিল কি? উনিশ শ’ আটাশ সালে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনে পাঞ্জাবের জাতীয়তাবাদী নেতা লালা লাজপত রায় পুলিশের আক্রমণে আহত ও পরে মারা গেলে পাঞ্জাবের তরুণ বিপ্লবী ভগৎ সিং দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে লাজপত হত্যার মূল নায়ক স্যান্ডর্সকে প্রকাশ্য রাজপথে হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। কিন্তু ওই এক ব্রিটিশ পুলিশ হত্যার দায়ে ভগৎ সিং-এরও প্রাণদ- হয়। দেশের চলমান ইতিহাসে চোরাগোপ্তা হামলায় নিহত হওয়াসহ কত পুলিশ মারাত্মক আহত হলেন কিন্তু কোনটারই কি তেমন উল্লেখযোগ্য বিচার ও শাস্তি হয়েছে?
বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ দেশে বহু পুরনো। এর বিকাশ এবং বিস্তৃতি সস্ত্রাস এবং নৈরাজ্যকে সহজে প্রশ্রয় দেয়। এ দুয়ের সমন্বয় দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এসব কর্মকা-ের নিয়ন্ত্রকদের তা নিয়ে ভাবার সময় নেই।
লুটেপুটে খাওয়ার জন্য তাদের কেবল রাষ্ট্র ক্ষমতা দরকার। ক্ষমতার জন্য এমন নির্লজ্জ তা অন্য কোন দেশে আছে কিনা জানি না।
নানা কারণে আজকের বাংলাদেশে বহুল উচ্চারিত দেশের নাম মালয়েশিয়া। অবৈধ পথে পাড়ি জমানো শ্রমিকরা প্রায় নিয়মিত বিরতিতে সংবাদ শিরোনাম হওয়ার পাশাপাশি যোগ হয়েছে ‘অতি’ বিত্তশালীদের সম্পদ গচ্ছিত রাখার খবর। কদিন আগে এক দৈনিকে প্রকাশিত এ রকম এক সংবাদে জানা যায়, প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশীর ‘সেকেন্ড হোম’ হচ্ছে মালয়েশিয়া।
যাদের মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, আমলা, অবসর নেয়া সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক এমন কী শিক্ষকদের একটি অংশ। এরা হু-িতে পাচার করেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। দেশের টাকা পাচার করে যে দেশের অর্থনীতিতে এরা বাড়তি গতিসঞ্চার করছে, সেই মালয়েশিয়াও এক সময় ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল।
ভারত ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছিল উনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালে আর মালয়েশিয়া উনিশ শ’ সাতান্ন সালে। আমাদের সঙ্গে ওদের ইতিহাসের আরও মিল রয়েছে।
সাতচল্লিশে ভাগ হওয়ার পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের যাত্রা শুরু উনিশ শ’ একাত্তর সালে আর বড় পরিসরে ‘মালয়’ রাষ্ট্র মালয়েশিয়া নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপ পায় উনিশ শ’ তেষট্টি সালে। শুরুতে বাংলাদেশের মতো মালয়েশিয়ার অর্থনীতিরও মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। এখন মালয়েশিয়ার অর্থনীতি শিল্প সমৃদ্ধিতে শক্তিশালী। আর আমাদের শিল্প আজও কোমর সোজা করে দাঁড়াতে হিমশিম খাচ্ছে। আমাদের থেকে পরে উপনিবেশ মুক্ত হয়েও অর্থনৈতিক উন্নতির যে স্তরে ওরা পৌঁছেছে, তা এখনও বাংলাদেশের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গত শতকের আশির দশকে ওরা একজন শক্ত মেরুদ-ের নেতা পেয়েছিল। যার নাম মাহাথির বিন মোহাম্মদ। যিনি শক্ত হাতে শিল্প সমৃদ্ধ মালয়েশিয়ার ভিত রচনা ও বিকশিত করেছিলেন। যার ওপর ভয় করে ক্রমশ সামনে এগোচ্ছে আজকের মালয়েশিয়া আর বাংলাদেশ স্বাধীনতার পাঁচ বছরের মধ্য সামরিক স্বৈরশাসনের কবলে পড়ে শক্ত মেরুদ-ে ভর করে দাঁড়ানোর সব যোগ্যতা একটু একটু করে ধ্বংস করেছে। সামরিক শাসনের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও মাহাথিরের মতো মেরুদ-শীল নেতা বাংলাদেশ এখনও পায়নি।
বিভিন্ন সময় বিশেষ করে পাঁচ বছর পর পর রাজনৈতিক অস্থিরতা তাই কূল ছাপিয়ে যায়। একটি স্বাধীন দেশ বহুজাতিক কোম্পানির বাজারে পরিণত হলে স্বাভাবিকভাবেই তা মেরুদ-হীন হয়ে পড়ে। তার অর্থনীতির ভিত ভেঙ্গে চুরমার হয়। বাংলাদেশে তাই হয়েছে। মালয়েশিয়া নিজেদের অন্যের বাজার করেনি।
সাংবিধানিক রাজতন্ত্রকে স্বীকার করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা ধারাবাহিকভাবে চলছে। রাজনৈতিক বিক্ষোভ সে দেশেও মাঝে মধ্যে মাথাচাড়া দেয় না, তা নয়। তবে বাংলাদেশের মতো নিজেদের সম্পদ ধ্বংসের রাজনীতি ওরা করে না। কারণ খুব সাধারণ। তা হলো দেশকে ওরা ভালবাসে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের এ সাধারণ কাজটি করতে আর কত সময় লাগবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।