অনেকে মনে করেন তার মৃত্যুর কারণ ট্রাম দূঘর্টনা নিছক দূর্ঘটনা নয়, আত্মহত্যার চেষ্টা। কবি জীবনানন্দ দাশ এর মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জট আজো খোলেনি। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কবি জীবনানন্দ দাশ চরম অর্থকষ্টে ভুগেছিলেন। ছাত্রজীবনে মাস্টার্স পর্যন্ত সব শ্রেণিতেই ভালো ফলাফল অর্জন করেছিলেন। কিন্তু পেশাগত জীবনে নানা কারণে একের পর এক চাকরি হারিয়েছেন।
দায়ে পড়ে টিউশনি, এমনকি বীমা কোম্পানির দালালি পর্যন্ত করেছেন। জীবন চালাতে টাকা ধার করতে হয়েছিলো ভাই-বোন, বৌদি, বীমা কোম্পানি, স্কটিশ ইউনিয়ন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সত্যপ্রসন্ন দত্ত, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, বাণী রায়, প্রতিভা বসুসহ আরো অনেকের কাছ থেকে। তাহলে কি অর্থকষ্ট কবির মৃত্যুর কারণ ?
অজানা সেই কারণ খুজতে পড়েই দেখুন মৃত্যুর কয়েকমাস আগে স্বরাজ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক হুমায়ূন কবিরের কাছে জীবনানন্দ তিনটি চিঠি তিনটি চিঠি। এসব চিঠির কোন উত্তর দেননি হুমায়ূন কবির। বলা হয়ে থাকে, জীবনানন্দ মারা যাওয়ার পর মরণোত্তর সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেতে হুমায়ূন কবিরের বড় ভূমিকা ছিল।
চিঠিগুলো সংকলিত হয়েছে ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত ‘শেষ ছ বছর—জীবনানন্দের অপ্রকাশিত ডায়েরি’ বইতে। বইটি প্রকাশ করেছে কলকাতার প্রতিক্ষণ।
চিঠি-১
১৭.৩.৫৪
আমার প্রিয় মিস্টার কবির,
আপনি এখন একটা খুব প্রভাবশালী জায়গায় আছেন। শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, সাহিত্য, প্রকাশনা এবং অন্যান্য অনেক বিষয় আপনার সাক্ষাৎ তত্ত্বাবধানে আছে, যাদের মাধ্যমে আপনি আমাকে কোনও একটা উপযুক্ত চাকরিতে বসিয়ে দিতে পারেন। দয়া করে কিছু একটা করুন এক্ষুনি।
আশা করে রইলাম তাড়াতাড়ি করে আপনি আমাকে কিছু জানাবেন।
শুভেচ্ছা এবং শ্রদ্ধা নিবেদন-সহ
আপনার জীবনানন্দ দাশ
চিঠি-২
১৬.৪.৫৪
আমার প্রিয় অধ্যাপক কবির,
বিশিষ্ট বাঙালিদের ভিতর আমি পড়ি না; আমার বিশ্বাস, জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কোনও কিছু– যা শেষ বিচারে একটা কোনও জিনিসের মতন জিনিস– কিন্তু, ভাগ্য এমনই যে, আজ তার পেটের ভাত জুটছে না। কিন্তু, আশা করি, একটা দিন আসবে যখন খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না। আপনার কথামতো আমি জ্যোতিবাবুর অথবা বি.সি. রায়’এর সঙ্গে এখনও দেখা করার চেষ্টা করি নি; আমার মনে হয়, আমার মতন মানুষের পক্ষে তারা দূরের মানুষ।
আমি যেন অনুভব করি, আপনিই আমাদের মতন লোকের জন্য একমাত্র মানুষ; আপনার উপর আমার গভীর আস্থা আছে। আমি সর্বদা বিশ্বাস করি যে, আপনার নিজের পরিপূর্ণ শাসনের ভিতরে আছে, এমন কোনও একটা, আমার পক্ষে মানানসই, জায়গায় আপনি আমাকে বসিয়ে দিতে পারেন; আমাকে একটা উপযুক্ত কাজ দিয়ে দেবার মতন সুযোগ-সুবিধা আপনার খুবই আছে। আমার আর্থিক অবস্থাটা এখন এতটাই শোচনীয় যে, যেকোন একজন সকর্মক ‘অপর’ মানুষ যে কাজ করতে পারে, কেন্দ্রীয় সরকার’র অধীনে সে কাজ আমারও করতে পারা উচিত। আমি মনে করি, এ রকম একটা কাজ একজন মানুষকে সেই সম্মানটা দিয়ে দিতে পারে, যা প্রতিটি মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে অর্জন করে নেয়; তার বেশি আমি আর কিছু চাই না। আমার দেশ আমার অস্তিত্বের সাপেক্ষে সেই যথাযোগ্য সুযোগটা আমাকে দিক, যাতে আমি আমার ন্যূনতম জীবনযাপন নিয়ে থেকে যেতে পারি।
প্রাইভেট কলেজের অধ্যাপকের কাজ ক্ষুদ্র কাজ ; অধিকন্তু অন্যান্য নানা কারণেও ওই কাজটা আমি আর করতে চাই না। আমার খুবই পছন্দ তেমন কোনও একটা মানানসই কাজ, যাতে অনেকটা গবেষণা করতে হয়, লিখতে হয় এবং ভাবনা-চিন্তা করতে হয়।
ইতি
আপনার জীবনানন্দ দাশ
চিঠি-৩
২৩.৪.৫৪
প্রিয় মিস্টার কবির,
আশা করি, ভালো আছেন। আপনি এখন খুব একটা উঁচু জায়গায় আছেন এবং খুব সহজেই আমার জন্য কিছু-একটা করতে পারেন। আপনার নিজের ডিপার্টমেন্ট আছে।
খুবই যুক্তিসঙ্গত ভাবে আপনার ডিপার্টমেন্টে কোন এক জায়গায় আপনি আমার জন্য একটা চাকরি খুঁজে পেতে পারেন, যেমন অল-ইন্ডিয়া রেডিও আছে। আমি আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, আমাকে সাহায্য করতে এক্ষুনি আপনি যথাসাধ্য করুন, আমি খুবই অসুবিধের ভিতর আছি।
শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ-সহ
আপনার জীবনানন্দ দাশ
tarunnopratidin.com/arts-culture/article-1066
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।